ঢাকা, ২৮ এপ্রিল, ২০২৫ (বাসস) : ভারতশাসিত কাশ্মিরে গত সপ্তাহের প্রাণঘাতী হামলার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করে হামলাকারীদের খুঁজে বের করতে ব্যাপক ধরপাকড় চালানোর ঘটনায় সোমবার জনমনে ক্ষোভ তীব্র আকার ধারণ করেছে।
ভারতের শ্রীনগর থেকে এএফপি জানায়, নয়াদিল্লি গত ২২ এপ্রিলের ওই হামলার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করেছে। ওই হামলায় ২৬ জন নিহত হন, যা মুসলিম-অধ্যুষিত বিতর্কিত কাশ্মিরে গত পঁচিশ বছরের মধ্যে বেসামরিক নাগরিকদের ওপর সবচেয়ে ভয়াবহ হামলা।
পাকিস্তান হামলার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করে একে ‘নিরর্থক’ বলে উল্লেখ করেছে এবং ভারতের যেকোনো পদক্ষেপের জবাব দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
পারমাণবিক শক্তিধর এই দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক বছরের পর বছর পর সবচেয়ে নিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে, যা সামরিক সংঘাতের আশঙ্কা বাড়িয়েছে বলে বিশ্লেষকরা সতর্ক করেছেন।
কাশ্মিরে হামলাকারীদের ধরতে ব্যাপক ধরপাকড় চালাচ্ছে ভারতীয় নিরাপত্তাবাহিনী। তারা সন্দেহভাজন বিদ্রোহীদের নয়টি বাড়ি ধ্বংস করেছে এবং প্রায় ২,০০০ জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করেছে বলে একজন জ্যেষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তা এএফপিকে জানিয়েছেন।
জম্মু ও কাশ্মিরের মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ এক বিবৃতিতে বলেন, ‘অপরাধীদের কঠোর শাস্তি দিন, তাদের প্রতি কোনো করুণা দেখাবেন না, কিন্তু নিরপরাধ মানুষদের যেন বলির পাঠা না বানানো হয়।’
কাশ্মিরের একজন ফেডারেল আইনপ্রণেতা আগা রুহুল্লাহ বলেন, ‘কাশ্মির ও কাশ্মিরীদের সম্মিলিতভাবে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে।’
হামলাকারীদের খোঁজার নামে চলমান অভিযান চলাকালে ভারত ও পাকিস্তানের সেনারা দুর্গম হিমালয় অঞ্চলের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর একে অপরের দিকে গুলি চালিয়েছে।
'ঘুরে ফিরে গ্রেপ্তার' -
ভারতীয় সেনাবাহিনী সোমবার জানিয়েছে, চতুর্থ রাতের মতো ভারত ও পাকিস্তানের সেনাদের মধ্যে গুলি বিনিময় হয়েছে।
তবে কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি। পাকিস্তান তাৎক্ষণিকভাবে গুলি বিনিময়ের বিষয়টি নিশ্চিত করেনি।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিবৃতিতে বলা হয়, ‘২৭-২৮ এপ্রিল রাতের বেলা পাকিস্তানি সেনা চৌকিগুলো প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর উসকানিমূলক ছোট অস্ত্রের গুলিবর্ষণ শুরু করে।’
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘ভারতীয় সেনারা দ্রুত ও কার্যকরভাবে জবাব দিয়েছে।’
মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মির অঞ্চল ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতার পর থেকেই ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বিভক্ত। উভয় দেশই পুরো কাশ্মিরকে নিজেদের অংশ বলে দাবি করে।
ভারতশাসিত অঞ্চলে ১৯৮৯ সাল থেকে বিদ্রোহ চলছে; বিদ্রোহীরা স্বাধীনতা অথবা পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার দাবিতে আন্দোলন করছে।
ভারতীয় পুলিশ পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বার (জাতিসংঘ ঘোষিত সন্ত্রাসী সংগঠন) সদস্য বলে দাবি করা তিন ব্যক্তির (দুই পাকিস্তানি ও এক ভারতীয়) বিরুদ্ধে 'ওয়ান্টেড' বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে।
তাদের প্রত্যেকের গ্রেপ্তারের জন্য ২০ লাখ রুপি (২৩,৫০০ মার্কিন ডলার) পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে।
ভারত নিজ দেশের কয়েকজন নাগরিককেও সন্দেহভাজন হিসেবে খুঁজছে, যাদের সম্পর্কে ধারণা করা হচ্ছে যে তারা হামলাকারীদের বিষয়ে তথ্য জানে।
একজন জ্যেষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ‘পুলিশ স্টেশনগুলোতে এক প্রকার ঘুরে ফিরে গ্রেপ্তারের চিত্র দেখা যাচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘কিছু মানুষকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, আবার নতুন করে অনেককে ডাকা হচ্ছে।’
সন্দেহভাজনদের বাড়িঘর রাতের আঁধারে ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে।
পলাতক আশিফ শেখের বোন ইয়াসমিনা অভিযোগ করে বলেন, ‘আমরা তিন বছর ধরে আশিফের কোনো খোঁজ পাইনি, তবু আমাদের বাড়ি ভেঙে ফেলা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আমার ভাই যদি জড়িতও হয়, তবু তার পরিবারের অপরাধ কী? এই বাড়ি তো শুধু তার একার না।’
'সংযমের আহ্বান' -
কাশ্মিরে হামলার পর ভারতের পক্ষ থেকে পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক নিম্নমুখী করা হয়েছে, পাকিস্তানিদের ভিসা বাতিল করা হয়েছে, পানিবণ্টন চুক্তি স্থগিত করা হয়েছে এবং প্রধান স্থল সীমান্ত বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
এর জবাবে পাকিস্তান ভারতীয় কূটনীতিক ও সামরিক উপদেষ্টাদের বহিষ্কার করেছে, ভারতীয় নাগরিকদের ভিসা বাতিল করেছে এবং পাকিস্তানের আকাশপথে ভারতীয় বিমান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।
ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং সোমবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠক করেছেন। তিনি আগেই সতর্ক করেছিলেন যে, কাশ্মিরে হামলার জন্য দায়ীদের ‘প্রবল ও স্পষ্ট’ জবাব দেওয়া হবে।
জাতিসংঘ দুই দেশের প্রতি ‘সর্বোচ্চ সংযম’ দেখানোর আহ্বান জানিয়েছে এবং সমস্যাগুলোর ‘অর্থবহ পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ সমাধান’ খুঁজে বের করার তাগিদ দিয়েছে।
ভারত ও পাকিস্তান উভয়েরই প্রতিবেশী চীন সোমবার দুই পক্ষকে ‘সংযম প্রদর্শন’, ‘অর্ধেক পথ এগিয়ে আসা’ এবং ‘গঠনমূলক সংলাপের মাধ্যমে মতপার্থক্য সমাধানের’ আহ্বান জানিয়েছে বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র গুও জিয়াকুন জানিয়েছেন।
ইরান ইতোমধ্যে মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়েছে এবং সৌদি আরব জানিয়েছে, তারা ‘উত্তেজনা প্রতিরোধে’ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।