ঢাকা, ১৫ মে, ২০২৫ (বাসস) : সকালে পাতলা এক টুকরো রুটি খেয়ে মাকে চুমু দিয়ে বিদায় জানায় বানেলে ফালাদি। এরপর পথ পেরিয়ে, গর্ত আর কাদা এড়িয়ে পৌঁছে যায় কগোলোলো অ্যাকাডেমিতে—রঙিন এক স্কুলঘরে।
দক্ষিণ আফ্রিকার আলেক্সান্দ্রা থেকে এএফপি জানায়, দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গ শহরের সবচেয়ে দরিদ্র এলাকাগুলোর একটি আলেক্সান্দ্রা। এই শহরতলির একটি বেসরকারি প্রাথমিক স্কুল হলো কগোলোলো অ্যাকাডেমি, যেখানে ছোট ছোট শ্রেণিকক্ষ, আগ্রহী শিক্ষক, আর প্রতিটি শিশুর নাম জানা থাকে সবার।
১২ বছর বয়সী বানেলে যখন সকালে স্কুলে পৌঁছায়, তখন শিক্ষক ও সহপাঠীদের কাছ থেকে পায় হাসিমুখে আলিঙ্গন ও হাই-ফাইভের অভ্যর্থনা।
স্কুলটির প্রতিষ্ঠাতা ওয়াহিদা টলবার্ট-এম্বাথা বলেন, ‘এভাবে প্রতিদিন সবার সঙ্গে দেখা হলে বুঝতে পারি কে কেমন মেজাজে আছে, কেউ অসুস্থ কিনা, কোথাও চোট লেগেছে কি না।’
সেটসোয়ানা ভাষায় ‘কগোলোলো’ শব্দের অর্থ হলো ‘মুক্তি’। এই নামের মতোই স্কুলটি শিশুদের মুক্ত চিন্তা ও শেখার সুযোগ করে দিতে চায়।
মাত্র ১৭৩ জন শিক্ষার্থী নিয়ে গড়ে উঠেছে এই স্কুল, প্রতিটি শ্রেণিতে গড়ে ২৫ জন করে। শিক্ষকরা বলেন, ‘পাশের সরকারি স্কুলে একেক ক্লাসে ৫০ জনের বেশি শিক্ষার্থী। সেখানে শিক্ষকরা কেবল ভালো ছাত্রদের নিয়েই কাজ করেন। আর এখানে আমরা পিছিয়ে থাকা শিশুদেরও সময় দিতে পারি।’
স্কুলটি ১০ বছর আগে প্রতিষ্ঠা করেন আমেরিকান শিক্ষক ওয়াহিদা ও তাঁর স্বামী থুলানি এমবাথা। থুলানি এই আলেক্সান্দ্রা শহরতলিতেই বড় হয়েছেন। একসময় তিনি পুরোনো একটি বাসে বসে হোমওয়ার্ক করতেন। তখন এক মার্কিন শিক্ষক তাঁকে পড়াশোনায় সাহায্য করেন, এমনকি পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ার খরচও জোগান।
ওয়াহিদা বলেন, ‘এই অভিজ্ঞতা তাঁর জীবন পাল্টে দেয়। কিন্তু সবাইকে এমন সুযোগ তো আর মেলে না। তাই আমরা এমন একটা জায়গা বানাতে চেয়েছি, যেখানে প্রতিটি শিশুই সুযোগ পাবে।’
নিজ এলাকাতেই মানসম্পন্ন শিক্ষা
ভালো শিক্ষার আশায় আলেক্সান্দ্রার মেধাবী শিক্ষার্থীরা সাধারণত ধনী এলাকায় স্কলারশিপ পেয়ে বড় স্কুলে যায়। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকায় এখনো বর্ণবাদী বৈষম্যের ছায়া রয়ে গেছে। ফলে দরিদ্র কৃষ্ণাঙ্গ শিশুরা সেসব সাদা-প্রধান স্কুলে গিয়ে সহজেই আলাদা হয়ে পড়ে।
কগোলোলো অ্যাকাডেমির প্রধান শিক্ষক নেলি এমলঙ্গো বলেন, ‘আমরা এমন শিক্ষা দিতে চাই, যাতে শিশুরা ভালো করে শুধু পড়াশোনাতেই নয়, জীবনেও। তাও নিজের এলাকার মধ্যেই।’
বানেলের মা ইভা বলেন, ‘টাউনশিপে একটা প্রাইভেট স্কুল থাকা মানে যেন আমাদের মধ্যে নতুন হাওয়া বইছে।’ ইভা একা ছেলে বড় করছেন, থাকেন ভাইবোন ও তাদের পরিবারের সঙ্গে।
স্কুলটির বার্ষিক ফি প্রায় ৩০,০০০ র্যান্ড (১,৬২৮ ডলার)। দরিদ্র এই এলাকায় এটি একটি বিশাল অঙ্ক। তবে এনজিও ও ব্যক্তিগত অনুদান থেকে এর অর্ধেকের বেশি মেটানো হয়। বাকি টাকা জোগাতে মা-বাবা ও দাদিরা কষ্ট করে টাকা জোগাড় করেন।
অর্থকষ্ট, বেকারত্ব আর অপরাধে জর্জরিত এলাকাটির শিশুরা নানা সমস্যার মুখোমুখি হয়। তাই স্কুলটিতে রয়েছে দুইজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ও একজন সমাজকর্মী। ওয়াহিদা বলেন, ‘এটা অনেক বড় পরিবর্তন এনেছে। এখন শিশুরা সাধারণ সমস্যার জন্যও কাউন্সিলরের কাছে আসে।’
অন্য বেসরকারি স্কুলগুলোর মতো এখানে ভর্তির ক্ষেত্রে পরীক্ষার ফল নয়, গুরুত্ব দেওয়া হয় মা-বাবার আগ্রহকে। ওয়াহিদা বলেন, ‘আমরা সব ধরনের শিক্ষার্থী নিতে পারি, কিন্তু সব অভিভাবক নয়। মা-বাবাকে এমন অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে যাতে তারা সন্তানকে সফল হতে সাহায্য করতে পারেন।’
দিনের প্রথম পাঠে যাওয়ার আগে বানেলে ও তার বন্ধুরা স্কুলের আঙিনায় খেলছিল সংগীতচেয়ারের খেলা। এই স্কুলে পড়া মানেই আনন্দ আর শেখার মেলবন্ধন। বানেলে বলে, ‘শিক্ষকেরা এমনভাবে পড়ান যে আমাদের সবকিছু মজার লাগে।’
আগামী বছর বানেলের জীবনে আরও একটি পরিবর্তন আসছে। কগোলোলোর ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থীর মতো সেও একটি নামী হাইস্কুলে পড়ার জন্য সম্পূর্ণ অর্থ সহায়তা পেয়েছে।