ঢাকা, ১৫ মে, ২০২৫ (বাসস) : উরুগুয়ের সাবেক প্রেসিডেন্ট হোসে ‘পেপে’ মুজিকার মৃত্যু লাতিন আমেরিকার চার দশত দীর্ঘ এক ঐতিহাসিক প্রেমগাথার অবসান ঘটাল।
৮৯ বছর বয়সে নিজ খামারবাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন মুজিকা। পাশে ছিলেন তার স্ত্রী লুসিয়া তোপোলানস্কি, বয়স ৮০।
মন্টেভিডিও থেকে এএফপি জানায়, তাদের প্রথম পরিচয় ষাটের দশকে, মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী গেরিলা সংগঠন তুপামারোসে। ‘ধনীদের কাছ থেকে লুটে গরিবদের দেওয়া’র রবিনহুড নীতিতে চালিত এই সংগঠনের সহপ্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মুজিকা।
ধীরে ধীরে তুপামারোস তাদের কর্মপদ্ধতিকে বিস্তৃত করে বোমা হামলা ও রাজনৈতিক হত্যা পর্যন্ত নিয়ে যায়।
তোপোলানস্কি ১৯৬৯ সালে তুপামারোসে যোগ দেন এবং আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় মুজিকার সঙ্গে তার দেখা হয়।
গত বছরের নভেম্বরে এএফপিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন মুজিকা বলেন, ‘আমরা তখন ভয়ংকর এক সময় পার করছিলাম... এমন পরিস্থিতিতে হয়তো মানুষ অবচেতনভাবে প্রেমের প্রয়োজন বেশি অনুভব করে।’
সত্তরের দশকের মাঝামাঝি তারা উভয়েই কারাবন্দী হন, আলাদা দুটি কারাগারে। সেখানে তারা বন্দী থাকেন ১৯৭৩ থেকে ১৯৮৫ সালের সামরিক শাসনামলের শেষ পর্যন্ত।
মুক্তির পর পুনরায় তাদের সম্পর্ক শুরু হয়।
‘আমি পেপের কাছে গেলাম... আর পরদিনই প্রচারণা শুরু করলাম,’ ২০২১ সালে আর্জেন্টিনার এনকুয়েনত্রো টিভিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন তোপোলানস্কি।
তিনি বলেন, ‘মুক্তির পর সবকিছু শূন্য থেকে শুরু করতে হয়েছিল।’
সেন্টার-রাইট শাসিত উরুগুয়েতে যখন বামপন্থার উত্থান ঘটছিল, তখন এই দম্পতির সম্পর্কও পরিণত হচ্ছিল।
মন্টেভিডিওর উপকণ্ঠে তাদের ছোট্ট খামারে তারা ফুল চাষ করতেন, উরুগুইয়ানদের প্রিয় তেতো হের্বাল চা ‘মাতে’ পান করতেন, আর কুকুরদের যত্ন নিতেন। এর মধ্যে অন্যতম ছিল তিন পায়ের কুকুর ‘মানুয়েলা’, যার সঙ্গে সমাহিত হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন মুজিকা।
পেপের রাজনৈতিক উত্থানের পাশাপাশি তোপোলানস্কিও নিজস্ব পথ নির্মাণ করেন, প্রথমে সংসদ সদস্য, পরে সিনেটর হিসেবে।
২০১০ সালে পেপে মুজিকার শপথ গ্রহণের সময় দৃশ্যমান হয় তাদের রাজনৈতিক যুগল-সম্পর্ক। সিনেটর হিসেবে সর্বাধিক ভোট পাওয়া তোপোলানস্কিই তাকে শপথবাক্য পাঠ করান।
‘বিশ্বের দরিদ্রতম প্রেসিডেন্ট’ হিসেবে পরিচিত মুজিকার খামারবাড়ি তার শাসনামলে হয়ে ওঠে বিশ্বজুড়ে বামপন্থী নেতাদের তীর্থভূমি।
‘আমরা রাজনীতি নিয়েই কথা বলি’ -
মুজিকার মেয়াদ শেষে, যখন তিনি পুনরায় প্রার্থী হতে পারছিলেন না, তোপোলানস্কি রাষ্ট্রপতি তাবারে ভাসকেসের অধীনে ভাইস-প্রেসিডেন্ট হন।
‘ওর সঙ্গে থাকা যেন এক মধুর অভিজ্ঞতা,’ বলেছিলেন মুজিকা।
২০১৪ সালে তিনি বলেন, ‘আমরা রাজনীতি নিয়ে কথা বলি, অন্য বিষয় নিয়েও বলি, ফুটবল দেখি, আমরা সহযোদ্ধা, আমরা বন্ধু।’
চার দশকেরও বেশি সময় এক সাথে থাকার পর ২০০৫ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে করেন এই জুটি। লুসিয়া ছিলেন মন্টেভিডিওর এক সচ্ছল পরিবারের সন্তান, আর পেপে বেড়ে উঠেছিলেন কৃষক পরিবারে।
‘আমি তার সঙ্গে ৪০ বছরের বেশি সময় কাটিয়েছি, শেষ পর্যন্ত পাশে থাকব, এটাই আমি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম।’ মুজিকার শেষ সময়ের সংবাদ জানাতে গিয়ে সোমবার বলেন তোপোলানস্কি।
বিয়ে করার অনেক আগেই তারা আরেকটি অঙ্গীকার করেছিলেন, জীবনভর সক্রিয় রাজনীতিক থাকার।
মুজিকার জন্য এর অর্থ ছিল সন্তান না নেওয়া। ‘আমি নিজেকে দুনিয়া পাল্টানোর জন্য উৎসর্গ করেছিলাম,’ বলেছিলেন তিনি এএফপিকে।
পরবর্তীতে এটিকেই নিজের জীবনের একমাত্র আক্ষেপ বলে মন্তব্য করেন তিনি।
তার রাজনৈতিক উত্তরসূরি ছিলেন বামপন্থী নেতারা, যেমন প্রেসিডেন্ট ইয়ামান্দু অর্সি। ক্যান্সারে ভুগতে ভুগতেও গত বছর তার পক্ষে সক্রিয় প্রচারণায় অংশ নিয়েছিলেন মুজিকা।
বুধবার, মন্টেভিডিওর রাজপথ ধরে হাজারো মানুষের অংশগ্রহণে আয়োজিত মুজিকার শবযাত্রার নেতৃত্ব দেন তোপোলানস্কি ও প্রেসিডেন্ট অর্সি।