ঢাকা, ২৩ আগস্ট, ২০২৫ (বাসস) : গাজায় দুর্ভিক্ষের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছে জাতিসংঘ। শুক্রবার এই প্রথম মধ্যপ্রাচ্যের কোন অঞ্চলে এমন ঘোষণা দিলো সংস্থাটি। ৫ লাখ মানুষ ‘ভয়াবহ’ ক্ষুধার ঝুঁকিতে রয়েছে বলে সতর্ক করেন বিশেষজ্ঞরা।
রোম থেকে এএফপি এই খবর জানায়।
জাতিসংঘের জরুরি ত্রাণ সমন্বয়ক টম ফ্লেচার বলেন, ‘এটি দুর্ভিক্ষ, গাজার দুর্ভিক্ষ।’
তিনি আরো জানান, আইপিসি প্যানেলের মূল্যায়নে গাজা শহর ও তার আশপাশে দুর্ভিক্ষ নিশ্চিত হয়েছে।
তিনি ইসরাইলকে দোষারোপ করে বলেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ত্রাণ সহায়তা পৌঁছানোর পথে ‘পরিকল্পিতভাবে বাধা’ দিচ্ছে দেশটি।
অন্যদিকে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু জাতিসংঘ সমর্থিত এই প্রতিবেদনকে ‘সম্পূর্ণ মিথ্যা’ বলে নাকচ করেছেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দাবি করেছে, ‘গাজায় কোনো দুর্ভিক্ষ নেই।’
দুর্ভিক্ষের এই মূল্যায়ন করেছে আইপিসি (ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্লাসিফিকেশন ইনিশিয়েটিভ)। জাতিসংঘের দায়িত্বপ্রাপ্ত এই জোট আগাম মানবিক বিপর্যয়ের সতর্কতা দেয়।
তাদের সংজ্ঞায়, কোনো অঞ্চলে ২০ শতাংশ পরিবারে চরম খাদ্যাভাব, পাঁচ বছরের নিচে ৩০ শতাংশ শিশু মারাত্মক অপুষ্টিতে ভুগলে ও প্রতিদিন প্রতি ১০ হাজারে অন্তত দু’জন পুরোপুরি খাদ্যাভাব বা অপুষ্টি ও রোগে মারা গেলে সেটিকে দুর্ভিক্ষ ধরা হয়।
জাতিসংঘ দীর্ঘদিন ধরে গাজার মানবিক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ জানাচ্ছে, বিশেষ করে ইসরাইল হামাসের বিরুদ্ধে অভিযানে গতি বাড়ানোর পর থেকে।
রোমভিত্তিক আইপিসি জানায়, ‘১৫ আগস্ট, ২০২৫ পর্যন্ত, যথেষ্ট প্রমাণের ভিত্তিতে গাজা অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ (আইপিসি ফেজ ৫) নিশ্চিত করা হয়েছে।’ জাতিসংঘের হিসাবে ওই অঞ্চলে প্রায় ১০ লাখ মানুষ বসবাস করছে।
আইপিসি’র প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, ‘গাজা উপত্যকার প্রায় পাঁচ লাখেরও বেশি মানুষ বর্তমানে অনাহার, চরম দারিদ্র্য ও মৃত্যুর মতো বিপর্যয়কর অবস্থার মুখোমুখি।’
এতে আরো বলা হয়, সেপ্টেম্বরের শেষ নাগাদ দেইর আল-বালাহ ও খান ইউনিসেও দুর্ভিক্ষ ছড়িয়ে পড়তে পারে। তখন ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা বেড়ে ৬ লাখ ৪১ হাজারে পৌঁছাবে।
আইপিসি জানায়, মধ্যপ্রাচ্যে এই প্রথম কোনো দুর্ভিক্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত হলো।
একজন মুখপাত্র এএফপিকে জানান, ২০১৮ সালে ইয়েমেনে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা করা হয়েছিল, কিন্তু সেখানে মানবিক সংকট সত্ত্বেও তা কখনও আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা হয়নি।
আইপিসি বলেছে, গাজার এই দুর্ভিক্ষ ‘সম্পূর্ণ মানবসৃষ্ট’। জুলাই মাসে সংঘাতের ব্যাপক বিস্তার, মার্চের মাঝামাঝি থেকে বিপুল সংখ্যক মানুষের বাস্তুচ্যুতি এবং খাদ্য সরবরাহ সীমিত হওয়ার ফলে এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
মার্চের শুরুতে ইসরাইল, গাজায় ত্রাণ সহায়তা প্রবেশে পুরোপুরি নিষেধাজ্ঞা দেয়। মে মাসের শেষ দিকে অল্প কিছু সরবরাহ প্রবেশের অনুমতি দিলেও তা চাহিদার তুলনায় অতি নগণ্য। এর ফলে খাবার, ওষুধ ও জ্বালানির তীব্র সংকট দেখা দেয়।
জেনেভায় সাংবাদিকদের ফ্লেচার বলেন, এই দুর্ভিক্ষ ‘আমাদের সকলকে তাড়া করবে’।
তিনি বলেন, ‘যদি আমাদের সুযোগ দেওয়া হতো, তবে আমরা এই দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ করতে পারতাম। কিন্তু ইসরাইলের পরিকল্পিত বাধার কারণে খাদ্য সীমান্তেই আটকে আছে।’
জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান ভলকার তুর্ক বলেন, ‘যুদ্ধের পদ্ধতি হিসেবে অনাহারকে ব্যবহার করা যুদ্ধাপরাধ।’
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি ও গাজায় পুনরায় পূর্ণ মানবিক সহায়তা প্রবেশের আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘আমরা এই পরিস্থিতিকে কোনোভাবেই বিনা বিচারে চলতে দিতে পারি না।’
আন্তর্জাতিক রেড ক্রস এই দুর্ভিক্ষ ঘোষণাকে ‘ভয়াবহ এবং পুরোপুরি পূর্বাভাসযোগ্য’ বলে অভিহিত করেছে।
সংস্থাটি এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনে বলা আছে, দখলদার শক্তি হিসেবে ইসরাইলের দায়িত্ব হলো গাজার সাধারণ মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ নিশ্চিত করা।’
জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর মতে, শুধু জুলাই মাসেই ১২ হাজারের বেশি শিশু মারাত্মক অপুষ্টিতে ভুগেছে। জানুয়ারির তুলনায় এই সংখ্যা ছয় গুণ বেশি।
ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক ক্যাথরিন রাসেল বলেন, ‘লক্ষণগুলো স্পষ্ট রয়েছে। শিশুদের শরীর শুকিয়ে গেছে, কাঁদারও শক্তি নেই, খেতেও পারে না, আর শিশু ও নবজাতকেরা অনাহার ও প্রতিরোধযোগ্য রোগে মারা যাচ্ছে।’
আইপিসি জানায়, গাজার স্থানীয় খাদ্যব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। প্রায় ৯৮ শতাংশ আবাদি জমি নষ্ট হয়ে গেছে বা ব্যবহার অযোগ্য বা উভয়ই। গবাদিপশুর বড় অংশ ধ্বংস হয়ে গেছে এবং মাছ ধরা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
তথ্য সংগ্রহও অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছে। সংস্থাটি জানায়, গাজার উত্তরাঞ্চলের পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে, তবে পর্যাপ্ত তথ্য পাওয়া যায়নি।
এদিকে ইসরাইলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দাবি করেছে, সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে গাজায় ‘বিপুল পরিমাণ ত্রাণ প্রবেশ করেছে’। ইসরাইলি প্রতিরক্ষা সংস্থা ‘কোগাট’ অভিযোগ করেছে, প্রতিবেদকরা আংশিক তথ্য ব্যবহার করেছেন।
তবে জাতিসংঘ বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির খাদ্য নিরাপত্তা বিশ্লেষণ পরিচালক জ্যঁ-মার্টিন বাউয়ার বলেন, এ ধরনের মূল্যায়নের ক্ষেত্রে আইপিসি ‘সোনালি মানদণ্ড’ হিসেবে স্বীকৃত।