জুলাইয়ে আমরা একটা  বৈষম্যমুক্ত সমাজ চেয়েছি : সৈকত আরিফ

বাসস
প্রকাশ: ২৮ জুলাই ২০২৫, ১৫:৪৫
সৈকত আরিফ। ছবি: সংগৃহীত

// রুদ্র আল মুত্তাকিন //

রাজশাহী, ২৮ জুলাই, ২০২৫ (বাসস) : সৈকত আরিফ বর্তমানে বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। সামনের সারিতে ছিলেন ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের। গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন জুলাই গণঅভ্যুত্থানে।

সৈকত আরিফ নওগাঁ সদর উপজেলায় বেড়ে উঠেন। সেখানে নামাজগড় গাউসুল আজম কামিল মাদ্রাসায় দাখিল পর্যন্ত পড়েন। নওগাঁ কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক শেষে তিনি ঢাকা কলেজে ইংরেজি সাহিত্য বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর করেছেন। তার বাবার নাম মো. মোয়াজ্জেম হোসাঈন, মায়ের নাম সন্ধ্যা আকতার।

সম্প্রতি জাতীয় বার্তা সংস্থা বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস)-এর রাবি প্রতিনিধি রুদ্র আল মুত্তাকিনকে দেওয়া এক একান্ত সাক্ষাৎকারে সৈকত আরিফ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে তার সম্পৃক্ততা ও আন্দোলনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতার নানা দিক তুলে ধরেন।

বাসস : ২০২৩ সালে ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্র ঐক্য গঠন হয়। আপনি সংগঠনটির অন্যতম সংগঠক ছিলেন। এই প্ল্যাটফর্মটি গঠনের পেছনের গল্পটা বলবেন?

সৈকত আরিফ : আমরা যখন বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রবেশ করছি তার ঠিক কিছুদিনের মধ্যেই গণজাগরণ মঞ্চ তৈরি হয়েছিল এবং গণজাগরণ মঞ্চের কিছুদিনের মধ্যেই আবার শাপলা চত্বরের মত ঘটনা ঘটেছিল। তার পরে আমরা দেখেছি ২০১৪ সালে বাংলাদেশের নির্বাচনব্যবস্থা কীভাবে ধ্বংস হয়েছে; আওয়ামী লীগ প্রথমে বিরোধী দলবিহীন নির্বাচন করল এবং ১৪ সালের পর থেকেই বাংলাদেশের মানুষের ভোটের অধিকার কেড়ে নেওয়া হলো।

তখন থেকেই কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিতে এইটাই প্রধান ইস্যু আকারে সামনে এসেছে। আমরা তখন থেকেই বুঝতে পারছিলাম বাংলাদেশে এক ধরনের ফ্যাসিবাদী শাসন কায়েম হতে যাচ্ছে। কারণ ২০০৯ সালে যখন আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল তখনই এসব নিয়ে আলাপ আলোচনা চলছিল। আওয়ামী লীগ যে ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থা কায়েম করতে পারে এর আলামত পাওয়া যাচ্ছিল।

২০১৮ সালের নির্বাচনটাও যখন আওয়ামী লীগ পাড়ি দিয়ে ফেলল, আমরা কোনো প্রতিরোধ তৈরি করতে পারলাম না, তখন থেকেই বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক এজেন্ডায় পরিণত হয়েছিল যে, কীভাবে আমরা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ফাইট করব এবং ফ্যাসিবাদ বিরুদ্ধে লড়াই করব! এই লড়াইয়ে আমরা অনেক বেশি ডেডিকেটেড ছিলাম। 

পুরো সময়টাতে জাতীয় রাজনীতি বলেন বা ছাত্র রাজনীতিই বলেন সমস্ত কিছুই আসলে এই ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ এবং শেখ হাসিনার পতনকে কেন্দ্র করে হয়েছে। কিন্তু কিছু বিভাজন নানা রকমভাবে সমাজের মধ্যে ছিল। যার কারণে একত্রিত হতে পারছিলাম না।

বাংলাদেশের বিগত সময়ে আমরা দেখেছি, প্রত্যেকটা দল নিজেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। বামপন্থীরা নিজের এরিনার বাইরে বের হতে পারে না, ইসলামপন্থীরা নিজেদের বাইরে বের হতে পারে না। কিন্তু আমরা বুঝেছিলাম, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে একটা সর্বদলীয় ঐক্য দরকার। নাহলে লড়াইটা সম্ভব না। 

আমরা তাত্ত্বিকভাবেই বুঝতাম যে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আসলে আমাদের সবার একটা ঐক্যবদ্ধ লড়াই দরকার। সেই লড়াই যুগপৎ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো নানা রকমভাবে শুরু করেছিল, তখন আমরা ভাবতেছিলাম যে ছাত্রদের দায়িত্ব ছাত্ররা কী করতে পারে, তখন আমরা ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্র ঐক্য গড়ে তুলি। 

এই ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্র ঐক্যকে গড়ে তোলার জন্য আমরা বিদ্যমান সকল ছাত্র সংগঠনের সাথে কথা বলেছি। তারা কেউ কেউ এসেছেন, কেউ কেউ আসেন নাই; যারা যারা এসেছেন তাদেরকে নিয়ে আমরা এটা গড়ে তুলেছিলাম। এখানে ইসলামপন্থী, বামপন্থী, প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক সবাই ছিল। সময়ের প্রয়োজনের তাগিদেই আমরা গড়ে তুলেছিলাম।

বাসস : জুলাই গণঅভ্যুত্থানের আগেও ফ্যাসিবাদ বিরোধী দীর্ঘ লড়াইয়ে আপনি মাঠে ছিলেন। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন সফল না হলে দেশের পরিস্থিতি কোন দিকে যেত বলে মনে করেন?

সৈকত আরিফ :  জুলাই অভ্যুত্থান যে ধরনের সম্ভাবনা তৈরি করেছিল তাতে পেছনে তাকানোর পরিস্থিতি ছিল না। যদিও আন্দোলনটা প্রথম দিকে কোটাকে কেন্দ্র করে শুরু হয় এবং কোটা আন্দোলনে আমরা দেখেছি বিপুল পরিমাণ শিক্ষার্থী এই আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়েছেন। এই আন্দোলনের লক্ষ্য কোনভাবে সরকার পতন ছিল না। এটি কেবল কোটা সংস্কারের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল।

যদি রাজনৈতিক লক্ষ্যের জায়গা থেকে বলি, তাহলে প্রথমদিকে সেটা কোনভাবেই সরকার পতনের আন্দোলন ছিল না। কিন্তু আওয়ামী লীগের ব্যাপক নিপীড়ন-নির্যাতনের কারণে আন্দোলনটা অভ্যুত্থানে রূপ নিয়েছে।

জুলাই অভ্যুত্থানকে যদি আমরা ভেতর থেকে খেয়াল করি, তাহলে আমরা দেখব যে প্রথম ১৫ দিন ছাত্রদের আন্দোলন ছিল। তাদের ওপর যে অমানবিক নির্যাতন হয় তাতে করে এতে জনগণও যুক্ত হয়ে পড়ে।

১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলা হয়। আবার সেদিন রাতেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভয়াবহ হামলা হয়। এসব দেখে সারারাত আমরা আর কেউ ঘুমাতে পারছিলাম না।

আমরা দেখতেছিলাম কী হচ্ছে এবং ১৫ বছরের যে রাগ-ক্ষোভ-ভয় আমাদের সকলের মধ্যে জমা হয়েছিল, ১৬ তারিখে আবু সাঈদের দুই হাত প্রসারিত করা ছবিটা আসলে মানুষের সমস্ত ভয়কে ভেঙে দিতে সাহস জুগিয়েছে। তার প্রতিক্রিয়ায় আমরা দেখেছি পরবর্তী দিনগুলোতে ক্রমাগত হত্যার সংখ্যা বেড়েছে পাশাপাশি মানুষের প্রতিরোধ বেড়েছে।

যদি আন্দোলন অসফল হতো নিশ্চিতভাবে এখানে ফ্যাসিবাদী শাসন আরো শক্তিশালীভাবে জেঁকে বসতো। এখানে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আমরা যারা দীর্ঘদিন ধরে লড়াই করেছি এবং ১৮ সালের আন্দোলনেও যারা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, রাষ্ট্রযন্ত্রকে কাজে লাগিয়ে শেখ হাসিনা তাদের সকলকে নিঃশেষ করে দিত। আন্দোলনের সময়ও নেতৃবৃন্দকে ধরপাকড়, খুন করার চেষ্টা ব্যাপকভাবে ছিল। ফলে আওয়ামী লীগ যদি এ যাত্রায় টিকে যেত তাহলে হয়তোবা আমরা শেষ হয়ে যেতাম।

বাসস : ছাত্রলীগ বা রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দারা আন্দোলনের সময় ছাত্র ফেডারেশনের নেতাদের গতিবিধি নজরদারিতে রেখেছিল কি না? ছাত্র ফেডারেশনের গুরুত্বপূর্ণ নেতা হিসেবে আন্দোলনের সময় আপনি কারো হুমকি বা নজরদারি অনুভব করেছিলেন কিনা?

সৈকত আরিফ : এই আন্দোলনে একটা ব্যাপার হলো যে প্রথম দিক থেকে ছাত্র সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে যারা ছিলেন তারা আন্দোলনের সম্মুখ সারিতে থাকতে চান নাই। বিশেষত আমরা যারা ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের পরিচিত মুখ ছিলাম তারা সামনে যাই নাই। এখানে বরং ছাত্র সংগঠনগুলোর সেকেন্ড লেয়ারের নেতৃত্ব ছিল।

আন্দোলনের সম্মুখে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উমামা ফাতেমা, সীমা আক্তার, নারায়ণগঞ্জে মুনাসহ টাঙ্গাইলের নেতৃবৃন্দ। ফলে সেকেন্ডারি লিডারশিপ এই আন্দোলনে ব্যাপকভাবে যুক্ত ছিলেন। আমরা আসলে পেছনের কাজগুলো করছিলাম; যেমন তাদেরকে সাপোর্ট দেওয়া, আন্দোলনগুলো সমন্বয় করা এই ধরনের কাজগুলো আমাদেরকে নানাভাবে করতে হয়েছে।

সেই সময়ে তো হুমকি-ধামকি এমন একটা পর্যায়ে চলে গেছে এটা আসলে বলার মত অবস্থা ছিল না। পেলে খুন করে ফেলবে এই ধরনের সিচুয়েশনের জায়গাতে ছিল তবুও আমরা সকলেই ছিলাম। বিশেষত ১৫-১৬ তারিখের পরে আমাদের নেতৃত্বে যারা আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন তাদের সিকিউরিটির প্রশ্নটা আমাদেরকে অনেক গুরুত্বপূর্ণভাবে ডিল করতে হয়েছে।

তারা কই আশ্রয় নেবেন? তাদের সিকিউরিটি এনশিউর করা থেকে শুরু করে এই ধরনের বিষয়গুলো ভাবতে হয়েছে। আমি আমার নিজ এলাকা নওগাঁতেও নানা রকমভাবে থ্রেট পাচ্ছিলাম। সেখানকার ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আমাকে নানা রকমভাবে থ্রেট করতেছিল।

ঢাকায় ১৮ তারিখে আমার ওপর হামলা করে ছাত্রলীগ। এরপরে আমি হাসপাতালেই ছিলাম বেশ কিছুদিন। এই সময়টাতে আমার ছোট ভাইয়ের নামে একটা মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়েছিল নওগাঁতে, যেটা আসলে পলিটিক্যালি আমাদের পরিবারকে চাপ দেওয়া বা আমাকে চাপ দেওয়ার জন্য। সে সময় অভ্যুত্থানের সম্মুখ সারিতে যারা ছিলেন তাদেরকে খুন করার জন্য তারা নানা রকমভাবে তৎপরতা চালিয়েছে। কিন্তু আমরা সে ব্যাপারে অত্যন্ত কনসার্ন ছিলাম।

বাসস : জুলাইয়ে লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতির নিষিদ্ধকরণের দাবি উঠেছিল। এই সম্পর্কে ছাত্র ফেডারেশনের অবস্থান কী? আপনারা কেমন ছাত্র রাজনীতি চান?

সৈকত আরিফ : জুলাই অভ্যুত্থানের একটা সংকটের জায়গা ছিল, সেটা হচ্ছে যে বিশেষত ১৫ বা ১৭ তারিখের পর থেকেই এখানে একটা মারাত্মক ক্র্যাকডাউন চলেছে। সেই সময় আসলে আমাদের ভেতরকার অনেক যোগাযোগ আসলে ভেঙে পড়েছিল। নানা কারণেই সেটা ভেঙ্গে পড়েছিল। প্রথমে ৮ দফা দেওয়া হয়েছিল, যেটা পরবর্তীতে অত্যন্ত বিতর্কিত হয়েছে।

পরে ৯ দফার মধ্যে এই জিনিসটা সন্নিবেশিত করা হয়। এটা কোন রাজনৈতিক পক্ষের সাথে তারা আলাপ-আলোচনা করেন নাই কিন্তু ওই মুহূর্তে আবার যে ধরনের নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা ছিল সেই মুহূর্তে আসলে ওইটা নিয়ে আলাপ করার মত বাস্তবতায় আমরাও কেউ ছিলাম না।

ওই সময় আমাদের প্রধান ফোকাসের জায়গা ছিল যে শেখ হাসিনার পতন ঘটানো। বাকি সমস্ত কিছু আসলে পরে ডিল করা হবে এই ভেবে। সেই জায়গা থেকে ওই সময় আমরা কোন বিরোধিতার জায়গায় যাইনি। আর বাংলাদেশের লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতির যে আলাপ আলোচনাটা উঠতেছে সেই আলাপ-আলোচনার সাথেও আমাদের বেশ কিছু অবজারভেশন আছে।

আমরা সবার আগে ছাত্র ফেডারেশনের দিক থেকে আলাপটা তুলেছিলাম যে ছাত্রদের কাজ হচ্ছে ছাত্রদের সংগঠিত করা। কোনো নেতাদের গোলামী করা বা কোন পার্টির গোলামি করা না। তার নিজস্ব আইডিওলজি থাকবে। কোনো মাদার পার্টির এজেন্ডা বাস্তবায়নের দিকে ছাত্র রাজনীতি কখনোই যেতে পারে না। এইটা বিশেষত গিয়েছিল কারণ ৯০ পরবর্তী সময়ে ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন বন্ধ করে দেওয়া হয়।

আমরা সবসময় বলেছি যে এখানে ছাত্র সংগঠনগুলো থাকবে এবং একই সাথে নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচন দিতে হবে। তাহলেই ছাত্র রাজনীতির অনেকগুলো সংকট আমরা মোকাবেলা করতে পারবো। আমরা দেখছি যে এই আলোচনাটা সামনে আনা হচ্ছে না।

এখন পর্যন্ত ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের তৎপরতা হলে তার বিরুদ্ধে আমরা লড়াই করব এবং কোনভাবেই ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করা চলবে না। বরং অভ্যত্থানের পর আমাদের নিজেদেরও আকাঙ্ক্ষা ছিল যে এখানে ছাত্র রাজনীতির যে ‘ট্রাডিশনাল’ ধারা সেটা ভেঙে কীভাবে ছাত্র রাজনীতিকে আরো অনেক বেশি করে শিক্ষার্থীদের কল্যাণে কাজে লাগাতে পারি, সেটা নিয়ে আলোচনা করা।

জুলাই অভ্যুত্থানের পরে আমরা সকল ছাত্র সংগঠন আমাদের জুলাই অভ্যুত্থানের যে মঞ্চ ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ তাদেরকে আমরা বলেছিলাম যে, এখানে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের কথা বলে আপনারা একটা সংকট তৈরি করেছেন, যেটার কোনো মানে ছিল না। যেহেতু আপনারা এটা করেছেন এর একটা সুরাহা করে যাওয়াও আপনাদেরই দায়িত্ব। 

যেহেতু এই মঞ্চে আমরা সকল ছাত্র সংগঠন কাজ করেছি ফলে এই মঞ্চের মধ্য দিয়ে আলাপ আলোচনার হলে আমরা নতুন ছাত্র রাজনীতির একটা দিকনির্দেশনা তৈরি করতে পারব। পরে নানা কারণে হয় নাই। সেটার ব্যাখ্যা নিশ্চয় পরবর্তীতে আবারও আসবে।

বাসস : কোটা সংস্কার আন্দোলনে আপনি কখন, কীভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন? আন্দোলনের প্রথমদিকে আপনাদের দলীয় অবস্থান কী ছিল?

সৈকত আরিফ : কোটা নিয়ে ৪ জুন যে রায় হয় তা নিয়ে নানা রকমভাবে প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। ৪ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মিছিলেই ছাত্র ফেডারেশনের নেতাকর্মীদের কিছু অংশ তারা মিছিলে অংশগ্রহণ করেছিল। কোটার এই রায়ের বিরুদ্ধে ৯ জুন ছাত্র ফেডারেশন একটা সমাবেশ করেছিল। সমাবেশে আমরা ঘোষণা দিয়েছিলাম যে এই আন্দোলনে আমাদের সমর্থন থাকবে এবং আমরা সেই সমাবেশ থেকে আমাদের সারাদেশের নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলাম যে আপনারা সর্বোচ্চভাবে এই আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে থাকবেন।

ঈদের পরেও আন্দোলন গাঠনিক প্রক্রিয়ার মধ্যে ছিল। পরবর্তীতে পহেলা জুলাই থেকে আন্দোলন পুনরায় শুরু হয় এবং আমরা সে আন্দোলন পুরোদমে ঝাঁপিয়ে পড়ি।

ছাত্র ফেডারেশনের কয়েকজন নেতাই সমন্বয়ক আকারে সেখানে কাজ করেছেন। কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক আকারে কাজ করেছেন আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতৃত্ব। জেলা নেতৃত্ব মানে টাঙ্গাইল, রাজশাহী, যশোর কিংবা নারায়ণগঞ্জ, বরিশাল এ সকল জায়গাতে আসলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রধান নেতৃত্ব আকারে ছাত্র ফেডারেশনের নেতৃত্ব ছিল। ফলে সেইখানে তারাই বিশেষত সংগঠিত করে আরো অনেকজনকে ডেকে নিয়ে যায়।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বদের সাথে ছাত্র সংগঠনগুলোর এক ধরনের যোগাযোগ ছিল সেটা খুবই ইনফরমাল। আমার মনে পড়ে যে প্রথম সম্ভবত ১১ তারিখ (তারিখটা ভুল হতে পারে) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মিলনায়তনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের সাথে আমাদের ছাত্র সংগঠনগুলোর একটা বৈঠক হয়েছিল। সেখানে আমরা কিছু আলাপ আলোচনা করেছিলাম পরবর্তী কর্মসূচি থেকে শুরু করে নানা বিষয় নিয়ে। 

আমরা শুরু থেকেই আন্দোলনকে সমর্থন করে গেছি। আমরা অভ্যুত্থানের পুরো সময়ই সক্রিয় ছিলাম। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের একটা বড় অংশ যখন ডিবি হেফাজতে ছিলেন বা জেলে ছিলেন বা হাসপাতালে ছিলেন, ওই সময়গুলোতে ছাত্র সংগঠনের নেতারা পিছন থেকে আন্দোলনকে আরো কিভাবে গতিশীল করা যায় সে সকল বিষয়ে আলাপ আলোচনা করেছেন।

বাসস : ১৫-১৬ জুলাই আন্দোলনের অভিজ্ঞতা কেমন ছিলো?

সৈকত আরিফ : যদি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি তাহলে ১৫-ই জুলাই যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যে সমাবেশ হচ্ছিল তখন আমি টিএসসি’তে ছিলাম। হঠাৎ করে জানতে পারলাম যে বিজয় ৭১ হলে একটা সমস্যা হয়েছে।

রাজু ভাস্কর্য থেকে একটা মিছিল সেখানে যাচ্ছে সেটা আমাকে জানানো হয়েছিল আমাদের নেতাকর্মীরা যাচ্ছিলেন তারাই জানিয়েছিলেন যে, আমরা মিছিলের দিকে যাচ্ছি এবং সেখানে যাওয়ার পরে সংঘর্ষ বাধে। মিছিলে ছাত্রলীগ ভয়াবহভাবে হামলা করে এবং সেই হামলায় অনেকে আহত হয়েছে। এর পরে আমরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যাই, সেখানে ছাত্রলীগের হামলায় আহত উমামা ফাতেমা ছিলেন, সীমা ছিলেন।

আহতদের প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে আমাদের কাছে তথ্য আসে যে এখানে হামলা হবে মানে ঢাকা মেডিকেল কলেজেও ছাত্রলীগ হামলা চালাবে, ফলে তখন আসলে সেখানে উপস্থিত ছাত্র নেতৃবৃন্দকে আমরা যাতে দ্রুত হাসপাতাল থেকে বের করে আনতে পারি সেই চেষ্টা করি।

তারপর আসলে হাসপাতালেও আক্রমণ হয়েছিল এবং ১৫ তারিখে এই সমস্ত কিছু শেষ করে যখন আমি বাসায় ফিরতেছি, সম্ভবত রাত ১০টা বা ১১টার সময় জাহাঙ্গীরনগরে হামলার ঘটনাটা জানতে পারি। এসব আমাদের ঘুমকে হারাম করে দেয়।

১৬ তারিখ থেকে আন্দোলন গণআন্দোলনে রূপ নেয়। আন্দোলনে আমরা যে যেভাবে পেরেছি এই যুদ্ধে থেকেছি। এই আন্দোলনের নিয়ন্ত্রণ আসলে তখন কারো হাতেই ছিল না। এই আন্দোলনটা তখন অত্যন্ত স্বতঃস্ফূর্তভাবে সারা দেশের মানুষ নেমে এসেছে। তারা লড়াই করেছে এবং সে লড়াইয়ে আমরা বিজয়ী হয়েছি।

আমি ১৮ তারিখে ছাত্রলীগের হামলার শিকার হয়েছিলাম। আমার মাথায় ছয়টা সেলাই পড়েছিল। চার হাত পায়ে ফ্র্যাকচার হয়েছিল। ফলে আমি তখন হাসপাতালে ভর্তি। চিকিৎসা শেষে সন্ধ্যার দিকে আমাকে লুকিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে করে কমিউনিটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানে আমরা ট্রিটমেন্ট নিচ্ছিলাম। পরবর্তী ১৯ তারিখ সকালবেলা আমাদের নেতা জুনায়েদ সাকির ওপর আক্রমণ হয়। পরবর্তীতে উনাকে চিকিৎসার জন্য লুকিয়ে কমিউনিটি হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়।

তখন কমিউনিটি হাসপাতাল থেকে তাকে যখন ছাত্রলীগ-যুবলীগের সন্ত্রাসীরা তুলে নিয়ে যায় তখন আমরা সবাই কমিউনিটি হাসপাতালের ১০ম তলায় দাঁড়িয়ে আছি। আমরা তখন ভেবেছিলাম ভাইকে মেরে ফেলবে কিনা কারণ ওই সময়ে আসলে আওয়ামী লীগ যে পরিস্থিতির মধ্যে ছিল তাকে খুন করাটাই অত্যন্ত স্বাভাবিক ছিল। পরবর্তীতে সাকি ভাইকে, স্থানীয় জনতা, যারা বিভিন্নভাবে বিক্ষোভ করছিলেন, তাকে রেসকিউ করেন এবং পরবর্তীতে তাকে চিকিৎসার জন্য নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়।

১৯ তারিখ সন্ধ্যার দিকে আমাদেরকে বলা হয় যে হাসপাতালে ছাড়তে হবে। কারণ ছাত্রলীগ বা আওয়ামী লীগের লোকজন হাসপাতালে রেইড দিবে। এরকম একটা আলাপ-আলোচনা আমরা শুনছিলাম। তখন পর্যন্ত আসলে দাঁড়ানো বা হাঁটার মত শারীরিক পরিস্থিতিতে আমরা ছিলাম না। ১৯ তারিখ রাত্রে আমরা যেকোনভাবে হাসপাতালে অবস্থান করার সিদ্ধান্ত নিই। তার কারণ সেসময় আমাদের বের হয়ে যাওয়ার উপায় ছিল না।

২০ তারিখ দুপুরের পরে আমরা হাসপাতাল ত্যাগ করি এবং হাসপাতাল ত্যাগ করে আমরা আমাদের বড় আপার বাসায় আশ্রয় নেই। সেইখানে আমি দুইদিন ছিলাম। দুইদিন থাকার পরে আমার কাছে জায়গাটা পরিবর্তন করার নির্দেশনা আসে। সেখান থেকে আমি একরাতে আমার বন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ফেডারেশনের সাবেক সভাপতি আবু রায়হানের বাসায় অবস্থান করি এবং ওইদিন সকালেই ঢাকার একদম শেষ প্রান্তের একটা স্থানে গিয়ে আশ্রয় নিই এবং এরপর থেকে আবার যোগাযোগগুলো মেইনটেন করি।

আমার নিজের ফোনের নাম্বারও বদলাতে হয়। আমাকে আক্রমণ করার সময় আমার ফোনটা হারিয়ে ফেলি। ওই সময়টাতে তো ইন্টারনেট ক্র্যাকডাউন ছিল। তাই সিম তোলাও সম্ভব ছিল না। আমার কাছে একটা নতুন সিম এবং নতুন ফোন নাম্বার ছিল। সেই সময় আসলে আমাদের যোগাযোগটা অনেক লিমিটেড হয়ে গিয়েছিল।

বিশেষত সেসময় ছাত্র ফেডারেশনের প্রধান নেতৃত্বদের সাথে নানা রকমভাবে আমরা যোগাযোগটা স্থাপন করেছিলাম। কিন্তু এর বাইরে যে আরো অনেক ধরনের মানুষের সাথে যোগাযোগ  সম্ভব হতে পারতো, যেটা আমরা সবসময় করে এসেছি, সেটা আসলে সেসময় করা যায়নি। ২৪ তারিখের পর থেকে এই যোগাযোগটা আমরা আবার শুরু করতে পেরেছিলাম।

বাসস: বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকে দলীয় জায়গায় থেকে এবং দলের বাইরে থেকে কীভাবে দেখেন?

সৈকত আরিফ : বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নিয়ে আমার যে অবজারভেশন সেটা হচ্ছে যে আমি প্রথমেই যেরকমটা বলতেছিলাম, এই আন্দোলন তো একটা ‘অরাজনৈতিক’ আন্দোলন। এই আন্দোলনে কোনো রাজনৈতিক দাবি সেই অর্থে ছিল না। কোটা সংস্কারের কিছু দাবি ছিল এবং সেই আন্দোলনের উপর যে ব্যাপক দমন-পীড়ন তার ফলে কিন্তু এই আন্দোলন ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলন যেতে বাধ্য হয়েছে।

আপনি দেখবেন যে আন্দোলনের সমন্বয়ক নেতৃবৃন্দ বিশেষত ১৭ তারিখের পর থেকে আমরা বলা শুরু করছিলাম যে, ‘লাশের ওপরে আর কোনো সংলাপ হবে না, কোন আলোচনা হবে না, আর কোন আপস নয়। যে ধরনের হত্যাকাণ্ড আওয়ামী লীগ ঘটিয়েছে, এরপরে শেখ হাসিনার পতন ছাড়া আমাদের সামনে আর কোন রাজনৈতিক কথা নেই।’

খেয়াল করলে দেখা যায়, আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কদের কেউই কিন্তু সে কথা কখনো বলেন নাই যে, এই  আন্দোলনে এত মানুষ কেন নেমে এসেছিল? এইটার একটা গুরুত্বপূর্ণ অবজারভেশন সেসময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছিল। মিরপুরের এক নারীকে এক সাংবাদিক জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনি কেন আসছেন? ওই নারী বলতেছিলেন, ‘আমি তো এসএসসিতে ফেল করছি, এইচএসসিতেও কোন রকমে পাস করছি, আমার তো কয়দিন পর বিয়ে হয়ে যাবে। কিন্তু আমি ঘুমাইতে পারতেছি না যে ছোট ছোট বাচ্চাগুলোকে মেরে ফেলতেছে।’

এই যে মানুষের ওপর ক্র্যাকডাউন চলতেছে ফলে মানুষ কিন্তু তার ওপরে যে নিপীড়ন নির্যাতন এবং এই যে ১৫ বছরের নির্যাতন সেই নির্যাতনের যে ভয়াবহ ট্রমা সেটাই মানুষকে রাস্তায় নেমে নিয়ে এসেছে এবং ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তাদেরকে যুক্ত করেছে।

অভ্যুত্থানের পরে একটা জিনিস রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত খারাপ হয়েছে বলে আমি মনে করি, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যে দীর্ঘ লড়াই রাজনৈতিক দলগুলো করেছে তাদেরকে নানা রকমভাবে ডিলেজিটিমাইজ করার চেষ্টা করা হয়েছে। যেটা আসলে অভ্যুত্থানের পরে অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের দিকে নিয়ে যাওয়ার দরকার ছিল সেটা অত্যন্ত ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অথচ এই রাজনৈতিক দলগুলোর এতবছরের আন্দোলন এবং জুলাই অভ্যুত্থানে রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় ছিলেন।

আমরা যদি নেতৃত্বের দিকেও তাকাই তাহলেও এই সত্যটা আমাদের চোখে ধরা পড়বে। বিভিন্ন জায়গায় ইভেন ছাত্র আন্দোলনের ক্ষেত্রে যে সকল জায়গাতে আন্দোলন অত্যন্ত শক্তিশালী ছিল তা বেশিরভাগই রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা করেছে। তারা নানা রকমভাবে সাধারণের চেহারা নিয়ে এসেছিলেন অথচ সকলেই রাজনৈতিক মুখ এবং রাজনৈতিকভাবেই আন্দোলনকে তারা পরিচালনা করেছেন। সেই জায়গা থেকে যদি বলি, অভ্যুত্থানের সময়টাতেই বিশেষত ২৪-২৫ তারিখের দিক থেকে ফ্যাসিবাদবিরোধী লড়াইয়ের দীর্ঘ সময় ধারাবাহিকভাবে যে মানুষেরা ছিলেন তারাই বেশি ছিলেন।

বাসস : আধিপত্যবিরোধী একটা জোয়ার দেখা যাচ্ছে এ বিষয়ে আপনার মতামত কী?

সৈকত আরিফ : এই বিষয়ে ছাত্র ফেডারেশনে একটা স্পষ্ট কথা আছে যে তারা সকল ধরনের আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে আছি। আমরা তো ছাত্রদের তরফ থেকে সবসময় খুব পরিষ্কারভাবে বলেছি, বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র; ফলে যেকোনো ধরনের নীতি প্রণয়ন থেকে শুরু করে আমাদের ওপর সাম্রাজ্যবাদী যে প্রভাব, ইভেন যে কালচারাল প্রভাব আমাদের মধ্যে আছে তার বিরুদ্ধে আমরা সবসময় লড়াই চালিয়ে যাব। সাম্প্রতিক সময়ে এই লড়ায়ের অনেক জোরেসোরে আসছে এটা সত্য। কিন্তু এর মধ্যে কিছু ফাঁপা ব্যাপারও আছে।

ব্যাপারটা হলো আপনি দেখবেন যে এখন খুব ভারতবিরোধিতা চলতেছে, সবাই খুব ভারতবিরোধী অবস্থান নিচ্ছে কিন্তু আমরা যেমন বলতেছি যে, অন্তর্বর্তী সরকারকে আমরা যখন বলতেছি, ভারতের সাথে তো বাংলাদেশে অনেক চুক্তি আছে সেই চুক্তিগুলো আমাদের নতুন করে আবার দেখা দরকার, আমরা যেহেতু হাসিনাকে বারবার বলছিলাম যে হাসিনা দেশটা ভারতের কাছে লিজ দিয়ে দিছে। লিজ তো সে দিয়েছে চুক্তিগুলোর মাধ্যমে। সেই চুক্তিগুলো খোলাসা করেন। আমাদের নতুন করে সেটাকে রিভিজিট করা, নতুন করে পর্যবেক্ষণ করার দরকার আছে।

আবার যারা খুব ভারতবিরোধিতা করতেছেন তারাও কিন্তু দেখবেন যে ওপরে উপরে এই ভারতবিরোধীদের একটা সাম্প্রদায়িক চেহারা দিচ্ছে বা ভেতরে ভেতরে এই ভারতবিরোধীদের একটা সাম্প্রদায়িক চেহারা আছে। ভারতকে একটা হিন্দুত্ববাদী আইডেন্টিটি আকারে দাঁড় করানোর প্রবণতা আছে। কিন্তু চুক্তিগুলো নিয়ে তারা চুপচাপ থাকেন। সেই চুক্তির বিষয়গুলো নিয়ে তারা খুব বেশি কথা বলেন না।

আবার এইখানে সাম্রাজ্যবাদ বা সাম্রাজ্যবাদী যে সকল তৎপরতা আছে তা নিয়ে খুব বেশি কথা বলা হচ্ছে না বরঞ্চ এইখানে পপুলার পলিটিক্সের জায়গা থেকে ব্যবহার করা হচ্ছে।

আমরা মনে করি, বাংলাদেশ সার্বভৌম রাষ্ট্র সেই রাষ্ট্র তার সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে যাতে একদম স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্তগুলো নিতে পারে এবং আমরা যাতে সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তের মধ্যে না পড়ি। আমরা যাতে একই সাথে অন্যান্য যেকোনো ধরনের কালচারাল হেজেমনির বাইরেও যেতে পারি।

বাসস: জুলাই পরবর্তী সময়ে নতুন বাংলাদেশকে নিয়ে আপনার ভাবনাটা কেমন?

সৈকত আরিফ : জুলাই পরবর্তী নতুন বাংলাদেশ নিয়ে প্রচুর মানুষের আশা তৈরি হয়েছে। লড়াইটা তো আসলে জীবন বাজি রেখে লড়াই ছিল। ফলে মানুষ যে সর্বোচ্চ স্বপ্নটা দেখেছে সেটা নিয়েই এখন পর্যন্ত কথা বলছে বা হচ্ছে। জুলাইয়ে আমরা এমন সমাজ চেয়েছি যে সমাজে বৈষম্য থাকবে না।

এটাতো আসলে অনেক দীর্ঘ লড়াইয়ের জায়গা থেকে এসেছে। এই আকাঙ্ক্ষা দ্রুততম সময়ে অর্জন হবে না, আমাদের চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু রাষ্ট্র আকারে আমরা কীভাবে হাজির হচ্ছি বা গড়ে তুলতে চেয়েছি সেটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা চাই রাষ্ট্র সকল নাগরিককে সমান মর্যাদা দেবে। সকল নাগরিকের অধিকার সমান থাকবে; তার সুযোগ সুবিধার ক্ষেত্রে সে যাতে একটা সামঞ্জস্যতা তৈরি করতে পারে জুলাইয়ে এগুলো খুব কমন জায়গা ছিল। এই শক্তিটা কাজে লাগানো।

একই সাথে এইখানে আমরা যারা হাসিনার বিরুদ্ধে লড়াই করেছি, যে রাজনৈতিক দলগুলো দীর্ঘদিন আন্দোলন করেছে তারা নতুন বন্দোবস্ত কীভাবে তৈরি করবে সেটা বুঝতে হবে। যেমন বিএনপি’র ৩১ দফা যদি বলি তারা তাদের প্রস্তাবনাটা কিন্তু সে সময় মানুষের সামনে দিয়েছিল কিন্তু জুলাইয়ের ঘটনা প্রবাহ এত দ্রুত হয়েছে যে সে সময় কিন্তু এই প্রস্তাবনার কথা আমরা কেউ ভাবতেও পারি নাই।

ধরেন জুলাইয়ে রাষ্ট্রের কী ধরনের সংস্কার করা হবে এটার কোনো প্রস্তাবনা আমাদের কাছে আছে নাই। জুলাইয়ের প্রস্তাবনার সামনে ছিল আমরা একটা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করছি।

একটা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করছি মানে আমরা একটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য লড়াই করছি। তাহলে সেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাও কিন্তু একেকজনের জন্য একেক রকম। যেরকম একজন বামপন্থীর জন্য এই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অনেক বেশি র‌্যাডিকাল জায়গায় যেতে পারে। একটা ইসলামিস্ট রাজনৈতিক কর্মীর জন্য তার ভাবনা অন্যরকম হতে পারে বা লিবারেল পলিটিক্যাল ভিউ-এর মানুষগুলো ভাবনাও কিন্তু আলাদা হতে পারে।

ওই কারণে আমরা অভ্যুত্থানের পরপরই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের যখন বৈঠকগুলো হয়েছে বিশেষত প্রথম ১২ই আগস্টের বৈঠকেই ছাত্র ফেডারেশন থেকে আমরা সে সময় অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়নের প্রস্তাব করেছিলাম।এই কথা আমরা বারবার বলছি। এই অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা তো একেকজনের কাছে একেক রকম। আমার কাছে একরকম। ইসলামী সংগঠন করা ছেলেটার কাছে একরকম। বামপন্থী ছেলেটার কাছে আরেকরকম।

তাহলে আমাদের কমন গ্রাউন্ডটা কী? সেই কমন গ্রাউন্ডটা আমরা তৈরি করতে পারি কি না। আমরা সকলে যেহেতু বৈষমবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে একসাথে কাজ করেছি ফলে আমরা সকলে আলোচনা করে আমাদের জুলাই আকাঙ্ক্ষার কমন গ্রাউন্ড এবং আমরা কতদূর পর্যন্ত তা অর্জন করতে পারি সেটা ঠিক করতে পারি।

আকাঙ্ক্ষা যতদূর হোক আমি সবটা অর্জন নাও করতে পারি ফলে আমরা সে সময় বলেছিলাম যে, এই আকাঙ্ক্ষাটা নির্ধারণ করা এবং এটা আমরা কতদূর পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারি তার জন্য কাজ করা। এই প্রস্তাবনাগুলোকে পাশ কাটিয়ে এক-একটা পক্ষ নিজেদের মত করে অভ্যুত্থানকে ব্যাখ্যা করেছেন এবং অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষাটাকে নিজেদের রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষাটাকেও অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা বলে চালিয়ে দিয়েছেন। সেটা আসলে এই অভ্যুত্থান যে রাজনৈতিক অর্জনের দিকে যেতে পারত তা অত্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

বাসস : জুলাইয়ে মনে দাগ কাটা কিছু স্মৃতি ?

সৈকত আরিফ : জুলাইয়ে মানুষের তো অজস্র স্মৃতি। আমাদের সকলের অনেক অনেক স্মৃতি আছে। আমি ছাত্রলীগের হাতে মার খাওয়ার আগে একটা স্মৃতির কথা বলি, তখন আমরা পল্টন এলাকায় আন্দোলন করছিলাম। সেখানে এক ভদ্রলোক আসলেন, মধ্যবয়স্ক, ৪০-৫০ বছর বয়স হবে। উনি একটা পর্যায়ে উনার হাতে একটা ফোন ছিল,  স্যামসাং, ওইটা আমার হাতে দিয়ে বললেন, বাবা আমি তো আর এসব নিতে পারতেছি না! এই যে ছেলেমেয়েগুলোকে খুন করতেছে তা দেখে আমি আর বেঁচে থাকতে পারতেছি না। এটা বলেই উনি লাইটারটা হাতে নিয়ে উনার চুলে আগুন ধরিয়ে দিলেন। আমি তখন তার হাতটা ধরছি। তখন আমি খেয়াল করলাম, উনি উনার পুরো শরীরে পেট্রোল মেখেছেন। উনি নিজের শরীরটাতে আগুন লাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতেছেন।

এই ঘটনা অতীতেও নানা বিদ্রোহের সময় আমরা দেখছি, মিয়ানমারে এই ঘটনা ঘটেছে, তিউনেশিয়াতে ঘটেছে। তখন আমি তাকে নিবৃত্ত করেছি। আসলে মানুষের ডেডিকেশন কতদূর পর্যন্ত গিয়েছে সেটা বোঝার জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ।

আরেকটা অভিজ্ঞতার কথা যদি বলি। হামলার পরে ২৪ তারিখে আমি যখন আবার মাঠে ফেরত আসতেছি তখন আমি যে জায়গায় ছিলাম সেদিক দিয়ে ফেরত আসার জন্য জিগাতলা এলাকাটা ব্যবহার করি। তখন আমার মাথায় সেলাই, আমি টুপি দিয়ে সেটা ঢেকে রেখেছি। তো ওইখানে এসে আমি ছাত্রলীগের একটা চেকআপের মধ্যে পড়ি। তো চেকআপের মধ্যে পড়ার সময়টাতেই এক ভদ্র মহিলা তাকে আমি চিনি না, কখনো দেখিও নাই। উনি ছাত্রলীগকে বললেন, এটা আমার ছেলে, ও পড়ে গিয়ে মাথা কেটে গেছে। আমি ওকে নিয়ে হাসপাতালে যাচ্ছি! ওই যাত্রায় আমি বেঁচে গিয়েছিলাম।

৪ আগস্ট আরেকটা ঘটনা ঘটেছিল। সারাদেশের অবস্থা অত্যন্ত ভয়াবহ ছিল। আমরা সারাদিন বিক্ষোভ করছিলাম। বিকেলবেলা শাকিলের গুলি লাগার খবর পাইলাম। সে হাসপাতালে ভর্তি আছে। সেদিন ঢাকা শহরের ট্রান্সপোর্টেশনের অবস্থা খুব খারাপ ছিল। গাড়ি পাওয়া যাচ্ছিল না। এক সিএনজি ড্রাইভারকে যখন আমরা বললাম যে আমাদের এখানে যাইতেই হবে, আপনি আমাদেরকে নিয়ে যান উনি নিয়ে গেলেন।

ওইদিন আমি হাসপাতালে মোটামুটি এক ঘণ্টা ছিলাম। এক ঘণ্টায় ২১জন মানুষ এসেছেন যাদের প্রত্যেকের মাথায় গুলি লেগেছে। কেউই বাঁচবেন বলে মনে হয়নি। ভয়াবহ এক অভিজ্ঞা। এটা এক ধরনের মানসিক অবস্থা তৈরি করেছিল ওটা অত্যন্ত ভয়াবহ এবং জুলাইয়ের পরে আমি মনে করি যে অভ্যুত্থানে যারা অংশ নিয়েছিল তারা অনেকেই মেন্টাল ট্রমার মধ্যে দিয়ে গেছে।

বাসস : জুলাইকে সংরক্ষণ করে রাখার জন্য ছাত্র ফেডারেশন কি কি করেছে?

সৈকত আরিফ : জুলাইয়ে জনগণের যে আকাঙ্ক্ষা এটা আমরা কীভাবে বাস্তবায়নের দিকে যেতে পারি সেটাই আমাদের প্রাথমিক লক্ষ্য। যে অভ্যুত্থানে হাজারো মানুষ প্রাণ দিয়েছে, সেই অভ্যুত্থান যাতে শুধুমাত্র একটা ক্ষমতা পালাবদলের ঘটনায় পরিণত না হয় সেই জায়গা থেকে আমরা কাজ করছি। আমরা সকলে মিলে যদি জুলাইয়ের রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা ঠিক করতে পারতাম সেটি নিশ্চয়ই আমাদের জন্য অনেক অগ্রগতির জায়গা তৈরি করত।

জুলাইয়ে মানুষের লড়াইকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আমরা ডকুমেন্টারি করার চেষ্টা করতেছি। আমাদের লড়াইটাকে নানা রকমভাবে সংরক্ষণ করা এবং পরবর্তী আমাদের প্রজন্মের কাছে যাতে আমরা সেটা হাজির করতে পারি সেই ধরনের কর্মসূচিগুলো আছে। আহতদের নিয়ে আমাদের সংগঠনের অনেকে কাজ করছে। আমাদের কাছে রাজনৈতিক লড়াইটাই মুখ্য।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
ঢাবিতে প্রথমবারের মতো হলভিত্তিক ‘জুলাই সেন্টার’-এর উদ্বোধন
জিয়াউর রহমান সাড়ে ৩ বছরে দেশে আমূল পরিবর্তন করেছিলেন : ফরহাদ হালিম ডোনার
কুমিল্লায় ছাত্রদের পুনরায় সংগঠিত হওয়ার দিন
নতুন সৌদি রাষ্ট্রদূতের সাথে মীর নাছিরের সৌজন্য সাক্ষাৎ
টানা দ্বিতীয় জয় বাংলাদেশের
সবার জন্য একটি উন্নত খাদ্য ভবিষ্যৎ গড়তে প্রস্তুত বাংলাদেশ: খাদ্য  উপদেষ্টা
চরফ্যাশনে মেয়াদোত্তীর্ণ দুই ইউপিতে প্রশাসক ও সদস্য নিয়োগে হাইকোর্টের নির্দেশ
দুদককে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করার বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে : অধ্যাপক আলী রীয়াজ
‘জুলাই পুনর্জাগরণ উৎসব-২০২৫’ উপলক্ষ্যে নৌবাহিনীর মেডিকেল ক্যাম্প
সাবেক সিইসি নুরুল হুদার বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান শুরু
১০