বাসস
  ২৪ নভেম্বর ২০২৩, ১২:৪৩

বরগুনা ও পটুয়াখালীর উপকূলবাসী দুর্যোগ মোকাবেলায় গড়ে তুলেছে ফুডব্যাংক ও বীজব্যাংক

// একেএম খায়রুল বাশার বুলবুল //
বরগুনা, ২৪ নভেম্বর, ২০২৩ (বাসস): প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের কারনে উপকূলে ব্যাপক প্রাণহানি ও সম্পদহানি ঘটে। এতে এখানকার মানুষেরা নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। তাইতো দুর্যোগ পরিস্থিতি মোকাবেলায় বরগুনা ও পটুয়াখালীর উপকূলবাসী ‘গ্রাম দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি’র মাধ্যমে গড়ে তুলেছে ফুডব্যাংক ও বীজব্যাংক।
১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর প্রলয়ংকারি ঘূর্ণিঝড় ‘গোর্কি’র তান্ডবে উপকূলে ব্যাপক প্রাণহানী ও সম্পদহানি ঘটে। ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর ‘সিডর’এ আবারো সেই ক্ষয়-ক্ষতির সম্মুখিন হন উপকূলবাসী। এ বছরও ১৭ নভেম্বর তারিখে উপকূলে আছড়ে পড়ে ঘূর্ণিঝড় ‘মিধিলি’। আগামী ২৬ নভেম্বরের দিকে আরেকটি ঝড়ের আশংকা করছেন আবহাওয়াবিদরা। এটির নাম ‘মিগজাউম’ বা ‘মিচাং’ দিয়েছে মিয়ানমারের আবহাওয়া বিজ্ঞানীরা। এছাড়াও আইলা, মহাসেন, নার্গিস, বুলবুল, সিত্রাংসহ ১৫৩৭ সাল থেকে বিভিন্ন সময়ে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট যে ঝড়-জলোচ্ছ্বাস বাংলাদেশে আঘাত হেনেছে তার প্রধান শিকার ছিলো উপকূলীয় জেলা সমূহ।
২০০৭ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় সিডরের পর থেকে আইলা ও মহাসেনসহ একাধিক শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ের কারনে বরগুনার অধিবাসীরা দুর্যোগ ইস্যুতে অনেক সচেতন হয়ে উঠছেন। প্রান্তিক মানুষেরা এখন প্রতিমাসে ‘গ্রাম দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি’র নিয়মিত মাসিক সভা করে দুর্যোগ প্রস্তুতির খুঁটি-নাটি বিষয়গুলো আলোচনায় এনে দুর্যোগকালীন একে অপরের সহযোগিতায় এগিয়ে আসছেন। দুর্যোগকালীন ও দুর্যোগ পরবর্তী সময়ে পরিবারের খাদ্য নিয়ে আর দুশ্চিন্তা না করতে গড়ে তুলেছেন ‘ফুডব্যাংক’। ‘ফুডব্যাংক’ তাদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অতিবৃষ্টি, জলোচ্ছ্বাস আর লবনাক্ততার আগ্রাসনে উপকূলের কৃষি যাতে বিপন্ন না হয়, কৃষককে যাতে বীজ সংকটে পড়তে না হয় সেই জন্য গড়েছেন ‘বীজব্যাংক’। 
স্পেন সরকারের অর্থায়নে এসিএফ নামের একটি আন্তর্জাতিক সংগঠনের সহযোগিতায় সিডর ও আইলা পরবর্তী সময়ে কমিউনিটি ম্যানেজড্্ ডিজাস্টার রিস্ক রিডাকশন নামের প্রকল্প বরগুনায় এই ‘গ্রাম দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি’র কার্যক্রম শুরু করিয়ে দেয়। কমিটির সদস্যরা জানান, বরগুনার সাগরতীরবর্তী গ্রামগুলোতে নিয়মিত চলে দুর্যোগ বিষয়ক মাসিক সভা। দুর্যোগের আগাম কোন সংকেত থাকুক আর নাই থাকুক সেখানকার অধিকাংশ গ্রামের সভায় আলোচনা করা হয় চলতি মাসের সম্ভাব্য আপদ- বিপদ, করনীয়সহ নানা অনুষঙ্গ। অতিবৃষ্টির সময় কী কী উপায়ে ঘরের লাকড়িসহ (জ্বালানী), খাদ্য শস্য এবং অন্যান্য গৃহসামগ্রী সংরক্ষণ করতে হবে, হাঁস-মুরগীসহ গবাদি পশুর কী-কী রোগ-বালাই হতে পারে এবং তা থেকে পরিত্রাণের উপায়গুলো কী; সারাবছরের মৌসুমী আপদগুলোর কথাও আসে আলোচনায়। এছাড়া ঘূর্ণিঝড় এবং জোয়ার জলোচ্ছ্বাস মোকাবেলায় করণীয় নতুন-নতুন পরিকল্পনা নিয়েও আলোচনা চলে এ সভাগুলোতে। সভায় অংশগ্রহণকারী সদস্যদের সকলেই বেড়িবাঁধের উপরে এবং বাইরে বসবাসকারী হতদরিদ্র পরিবারের নারী ও পুরুষ। 
ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির উপ-পরিচালক গোলাম কিবরিয়া মত প্রকাশ করেন, তুলনামুলকভাবে বরগুনার স্থানীয় অধিবাসীদের মাঝে দুর্যোগ ইস্যুতে সচেতনতা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। ঘূর্ণিঝড়-বন্যায় গ্রাম দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির নারী ও পুরুষ সদস্যরা ঝুকিপূর্ণ এলাকাগুলো থেকে সাধারণ জনগণকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিতে প্রসংশনীয় দায়িত্বও পালন করেছে। 
ঝড়, বন্যাসহ নানা প্রাকৃতিক দূর্যোগের সাথে প্রতিনিয়ত লড়াই করা বরগুনার ৬ উপজেলাসহ পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলাতেও দাতা সংস্থা অক্সফামের আর্থিক সহায়তায় সরকারি সংস্থা দূর্যোগ প্রস্তুতি কর্মসূচি বিভাগ, সমাজ সেবা বিভাগ, মহিলা অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য বিভাগ, এনজিও এনএসএস প্রভৃতির কারিগরি সাহায্য নিয়ে গ্রামোন্নয়ণ সংগঠনগুলোতে তৈরী হয়েছে ‘ফুড ব্যাংক’। এই ফুড ব্যাংকের মূল উদ্দেশ্য হলো- সমন্বয়ের মাধ্যমে সংগঠিত হয়ে জমা রাখা অর্থ দুর্যোগ ও আপাদকালীন সময়ে কাজে লাগানো।
গ্রামোন্নয়ণ সংগঠনের সদস্যরা জানিয়েছেন, সংসারের প্রতিদিনের চাল-ডাল থেকে তারা নিয়মিত কিছুটা আলাদা ভাবে সঞ্চয় ও সংরক্ষন করে রাখেন। যে কোন ঝড়, বন্যা বা অন্য আপদকালীন সময়ে তাৎক্ষণিক প্রয়োজন মেটাবার জন্য। ফুড ব্যাংকের প্রাথমিক কার্যক্রম এভাবেই শুরু হয়। মাসে তারা ২০ টাকা থেকে শুরু করে ৫০ বা টাকাও জমা করেন। এই সঞ্চিত টাকা সংগঠনের ক্যাশিয়ার জমা নেন ও পাশ বইয়ে এন্ট্রি দেন। সম্মিলিত সঞ্চয় উপজেলা শহরের নির্ধারিত ব্যাংকে জমা রাখেন।
উদ্যোক্তা সংস্থা এনএসএস’র নির্বার্হী পরিচালক এড. শাহাবুদ্দিন পাননা জানিয়েছেন, দূর্যোগে জীবন রক্ষার পরপরই প্রয়োজন খাদ্য এবং সর্বদাই খাদ্য নিরাপত্তা। সঞ্চয় ভবিষ্যত সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেয়। এ ধারণা থেকেই ফুডব্যাংক তৈরী হয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রমে ফুডব্যাংক নতুন ধারণা হলেও তা কার্যকরী ইতিবাচক মাত্রা যোগ করতে সক্ষম হয়েছে। শুধু দরিদ্র মানুষ নয় সমাজের প্রত্যেকটি পরিবার ও মানুষের জন্য সামর্থ ও অবস্থান অনুযায়ী নিজ-নিজ ফুডব্যাংক তৈরী রাখা দরকার।
বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার রায়হানপুর ইউনিয়নের মাদারতলী গ্রামে শতাধিক স্থানীয় কৃষক ২০০৭ সালে সিডর পরবর্তী সময়ে দেশী জাতের ধানের ব্যতিক্রমধর্মী ‘বীজব্যাংক’ গড়ে তুলেছেন। কৃষকরা জানান, এ বীজ ব্যাংকের লক্ষ্য হচ্ছে প্রাকুতিক দুর্যোগপ্রবণ উপকূলীয় প্রান্তিক কৃষকের মৌসুমে বীজের চাহিদা পূরণ ও বৈচিত্র্যময় দেশী জাতের ধানবীজ সহজলভ্য করা। এখানে তারা দেশী প্রজাতির প্রায় ৮০ জাতের ধানের বীজসহ ১৩০ প্রজাতির ধানের বীজ সংরক্ষণ করছেন। উদ্যোক্তা কৃষকরা এ বীজ ব্যাংকে তাদের উৎপাদিত পরিপুষ্ট বীজ জমা রেখে আবাদ মৌসুমে ধানের বীজ সংকটও মোকাবেলা করছেন। 
জেলা কৃষি বিভাগের সহকারী উপ-পরিচালক এসএম বদরুল আলম জানান, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অতিবৃষ্টি, জলোচ্ছ্বাস আর লবনাক্ততার আগ্রাসনে উপকূলের কৃষি বিপন্ন হয়। বীজ সুরক্ষার এ কৃষক বীজব্যাংক উপকূলীয় এলাকাকার কৃষকদের জন্য একটা অনুসরণের দৃষ্টান্ত হতে পারে। স্থানীয় কৃষকদের উৎপাদিত ভালো মানের বীজ  এই বীজব্যাংকে জমা রাখার জন্য কৃষকদের পরামর্শ দিচ্ছি।