শিরোনাম
ঢাকা, ৫ নভেম্বর ২০২৪ (বাসস) : বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের চার নেতাকে গুম করার পর গভীর রাতে হাত ও চোখ বাঁধা অবস্থায় পায়ে গুলি করে পঙ্গু করার অভিযোগে র্যাব-ডিবি ও পুলিশের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে।
ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন কার্যালয়ে এসে ভিক্টিম ছাত্রশিবির নেতারা ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার চেয়ে আজ এ অভিযোগ দায়ের করেন। এ সময় তাদের সাথে ছিলেন ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় আইন সম্পাদক আবদুল্লাহ আল নোমান ও সহকারী আইন সম্পাদক আমানুল্লাহ আদিব।
গুম হওয়া ইসলামী ছাত্রশিবিরের চার নেতা হলেন- মো. আবুজর গিফারী, ওমর আলী, মো. রুহুল আমিন ও ইস্রাফিল হোসেন। মো. আবুজর গিফারী ২০১৫ সালে গুম হওয়ার সময় জয়পুরহাট জেলার ছাত্রশিবিরের সভাপতি এবং ওমর আলী একই জেলার ছাত্রশিবিরের সেক্রেটারী ছিলেন। অপরদিকে মো. রুহুল আমিন ছাত্রশিবিরের যশোর জেলা পশ্চিম চৌগাছা উপজেলা সাহিত্য সম্পাদক ছিলেন এবং ইস্রাফিল হোসেন একই থানার সেক্রেটারী হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন।
অভিযোগ দায়ের করার বিষয়ে ছাত্রশিবিরের আইন সম্পাদক আবদুল্লাহ আল নোমান বলেন, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার গত ১৫ বছরের শাসন আমলে ছাত্রশিবিরের ওপর সর্বোচ্চ বর্বরতা চালানো হয়। অভিযোগ দায়েরকারী চার শিবির নেতা এই বর্বরতার শিকার। পুলিশের বর্বর নির্যাতনের কারণে তাদের পা কেটে ফেলা হয়েছে এবং কৃত্রিম পা লাগানো হয়েছে। রাত ৩টার দিকে আবুজর গিফারী ও ওমর আলীর পায়ে গুলি করে তাদের পা ঝাঁঝরা করে দেয়া হয়। একইভাবে রুহুল আমিন ও ইস্রাফিল হোসেনকে গভীর রাতে নির্জন স্থানে নিয়ে হাতে হ্যান্ডকাপ পরানো হয় এবং চোখ বাঁধা অবস্থায় তাদের দুজনের দু পায়ে গুলি করে ঝাঁঝরা করে দেয়া হয়।
তিনি বলেন, ছাত্রশিবিরের দায়িত্ব পালন করার কারণে এই সহিংসতার শিকার হতে হয়েছে। এই রকম অসংখ্য নজির রয়েছে। আমরা সেগুলো ক্রমন্বয়ে উপস্থাপন করব। তাদেরকে ট্রাইব্যুনালে নিয়ে আসব।
ভিক্টিম ছাত্রশিবির নেতা আবুজর গিফারী বলেন, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার গত ১৫ বছরের শাসনকালে ছাত্রশিবিরের অসংখ্য নেতাকর্মীদের ওপর জুলুম নির্যাতন করা হয়েছে। এই জুলম নির্যাতনের বিচারের প্রক্রিয়া স্বরূপ আজ আমরা এখানে এসেছি।
ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা অভিযোগে যা বলা হয়েছে : ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা অভিযোগে বলা হয়েছে, আবুজর গিফারী জয়পুরহাট জেলার তৎকালীন জেলা সভাপতি এবং ওমর আলী ছিলেন তৎকালীন জেলা সেক্রেটারী। ২০১৫ সালের ৮ ডিসেম্বর জেলা শাখার বার্ষিক প্রতিবেদন জমা দেয়ার জন্য জয়পুরহাট থেকে হানিফ বাসে করে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হয়। আব্দুল্লাহপুর আসলে ৯ ডিসেম্বর সকাল ৬টার দিকে সাদা পোশাকে র্যাব পরিচয়ে দুজনকেই মাইক্রোবাসে উঠিয়ে উত্তরা র্যাব ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত জিজ্ঞাসাবাদের নামে তাদের উপর অমানবিক নির্যাতন চালানো হয়। ১৫ ডিসেম্বর সকাল ১১ টার দিকে তাদেরকে মাইক্রোবাসে করে হাত এবং চোখ বেঁধে রাজশাহী র্যাব ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ১৫ ডিসেম্বর রাত এবং ১৬ ডিসেম্বর সারাদিন আবারো চালানো হয় অবর্ণনীয় নির্যাতন। ১৬ ডিসেম্বর রাত ২টার দিকে রাজশাহী থেকে তাদেরকে নিয়ে যাওয়া হয় পাঁচবিবি থানার শিমলতলী এলাকায়। অত:পর সেখান থেকে তাদের সঙ্গে বোমা ও অস্ত্র দিয়ে দেওয়া হয়। তারপর তাদেরকে রাত ৪টার দিকে জয়পুরহাট র্যাব ক্যাম্পে নিয়ে আসা হয়। ১৭ ডিসেম্বর সকাল ৭টায় আবারো শুরু হয় জিজ্ঞাসাবাদের নামে নির্মম নির্যাতন। এরপর সকাল ১০ টার দিকে অস্ত্র এবং বোমাসহ সংবাদ সম্মেলন করেন জয়পুরহাট র্যাবের তৎকালীন মিডিয়া উয়িং। অস্ত্র মামলা দিয়ে দুপুরে তাদেরকে পাঁচবিবি থানায় হস্তান্তর করা হয়।
এ দুই শিবিরি নেতাকে সেখানে রাত ২টা পর্যন্ত দফায় দফায় পুলিশ নির্যাতন চালায়। রাত আনুমানিক ৩টার দিকে তাদেরকে হাত ও চোখ বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয় আওলায় ইউনিয়নের একটি পরিত্যাক্ত জায়গায়। পুলিশ দুজনের হাটুতে গুলিকরে পা ঝাঝরা করে দেয়। তাদেরকে স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক বগুড়া জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজে রেফার করে দেয়। সেখানেও তাদের চিকিৎসা না দিয়ে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে রেফার করে দেয়। সেখানে অপারেশন করে হৃদরোগ ইন্সটিটিউটে রেফার করা হয়। দুজনেরই প্রচুর রক্তক্ষরণ হওয়ায় এবং হাটুর মাংস ৭৫ শতাংশ পঁচে যাওয়ায় ২০১৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর দুজনের অনুমতি সাপেক্ষে ২টি পা কেটে ফেলা হয়। হাসপাতাল থেকে রিলিজ হলে ১২ ফেব্রুয়ারি ঢাকা থেকে জয়পুরহাট কারাগারে পাঠানো হয়।
মো. রুহুল আমিন এবং ইস্রাফিল হোসেনের গুমের ঘটনা : মো.রুহুল আমিন ইসলামী ছাত্রশিবিরের যশোর জেলা পশ্চিম চৌগাছা উপজেলা সাহিত্য সম্পাদক ছিলেন। ইস্রাফিল হোসেন একই থানা সেক্রেটারী হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন। ২০১৬ সালের ৩ আগষ্ট সাংগঠনিক কাজ শেষ করে রুহুল আমিন বাড়ি যাওয়ার পথে বন্দুলীতলা শফি মল্লিকের ইটভাটার মোড় থেকে চৌগাছা থানার একজন এস আই এবং দুজন এ এস আই তাদেরকে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যায়। ৪ আগষ্ট তাদেরকে ডিবি কার্যালয়ে পাঠানো হয়। সারাদিন
জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাদেরকে আবার চৌগাছা থানায় নিয়ে আসার পথে কয়ারপাড়া এলাকায় আসলে দুজনেরই দুই হাত পিছমোড়া করে হ্যান্ডকাপ পরানো হয় এবং চোখ বেঁধে ফেলা হয়। গভীর রাতে তাদের নিয়ে যাওয়া হয় বন্দুলিতলার নির্জন মাঠে। সেখানে নিয়ে দুজনের হাটুতে পুলিশ গুলিকরে পা ঝাঁঝরা করে দেয়। সেখান থেকে তাদেরকে উপজেলা সরকারী হাসপালে নিয়ে যাওয়া হয়। রাতেই তাদের রেফার করা হয় যশোর সদর হাসপাতালে। সেখানে দুদিন চিকিৎসার পর কোন উন্নতি না হওয়ায় তাদেরকে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়া হয়। ভর্তি হওয়ার সাতদিন পর পায়ে পঁচন ধরলে চিকিৎসক পা কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত দেয় এবং পা কেটে ফেলা হয়। ইত্যেমধ্যে বিভিন্ন মিডিয়াতে প্রচার করা হয় বন্ধুক যুদ্ধে দ্ইু শিবির নেতা আহত। তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র মামলা দায়ের করা হয় এবং দুইমাস চিকিৎসার পর এ দুই নেতাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে।