// আব্দুর রাজ্জাক //
কুষ্টিয়া, ৩ মার্চ ২০২৫ (বাসস): বৈশ্বিক উষ্ণায়নে তীব্র তাপদাহ মোকাবেলায় কার্যকর কোনো উদ্যোগ না থাকায় প্রতি বছরই শুষ্ক মৌসুমে দুর্বিষহ হয়ে উঠছে কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুরের জনজীবন, কৃষি ও জীববৈচিত্র্য।
সেচের অভাবে চরম বিপন্নের মুখে দেশের খাদ্য উৎপাদনে প্রথম সারিতে থাকা এই তিন জেলার জীববৈচিত্র্য ও কৃষি। একদিকে গত ৬ বছর ধরে দেশের বৃহৎ সেচ প্রকল্প গঙ্গাকপোতাক্ষ বা জিকে খালের সেচ সরবরাহের পাম্প হাউজ অকেজো থাকায় অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছে ভূ-উপরিস্থ জলাধার। এতে গৃহস্থালি ও পানীয় জলস্তরের উপর ভর করে চলছে কৃষি সেচ।
তিন জেলার কৃষি বিভাগের পরিসংখ্যান মতে, ‘এখানে প্রায় ২ লাখ ৩২ হাজার হেক্টর সেচযোগ্য অতি উর্বর তিন ফসলী জমিতে সেচ সরবরাহে চালু রয়েছে ৫৮৩টি গভীর নলকূপ, ৩২৭টি এলএলপি এবং ১ লাখ ১৩ হাজার ৯৫১টি অগভীর নলকূপ। এই পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যায়, সরাসরি গৃহস্থালি ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ভুগর্ভস্থ পানির যোগানস্তরের উপর কৃষি কাজের সেচ সরবরাহে ব্যবহৃত প্রায় সোয়া লাখ অগভীর নলকূপে পানির যোগান দিতে অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে ভূ-গর্ভস্থ পানিস্তর।
বিশেষজ্ঞদের মতে, জরুরি ভিত্তিতে অগ্রাধিকার বিবেচনায় নিয়ে পরিস্থিতি উত্তরণে পরিকল্পিত পানি ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।
কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার কবরবাড়িয়া গ্রামের রাবিয়া খাতুন বাসসকে বলেন, ‘পানির সমেস্যা কি একটু আইট্টু হয়চে নাকি? পানির অভাবে সেচ দিতি না পাইরি ধানের মাঠ ফাইটি ছেড়াবেড়া হয়ে গেচে। একন আমরা ছাওয়াল পাল লিয়ে কি খাবো সেই চিন্তাই করতিচি, বাড়িত টিউকলের পানিও ওটতেচে না; গরু বাচুর, ছাগল বকরি, হাঁস মুরগি লিয়ে একন কোন যাই কি করি, কোন দিশা হচ্চে না’। কবে ইর সুমাধান হবি আর কবেই বাঁচতি পারবো, সেই বেবেস্তা সরকার কইরি দিক’।
মেহেরপুর সদর উপজেলার ফতেপুর গ্রামের কৃষক মিরাউল হক বলেন, ‘আমারে যত কষ্ট এই শুষ্ক মৌসুমে, ধরেন সারা বছরই আমারে এই মাঠে আবাদ করি বাঁচতি হয় শ্যালো পাম্পের (অগভীর নলকূপ) পনির উপর। প্রতি বছরই নতুন নতুন কইরি পানির লিয়ার (স্তর) নীচে নাইমি যাচ্ছে। দেকা যাইচ্ছে, ২ থেইকি ৫ ঘন্টা পর্যন্ত মটর চালিউ এক বিগি ভুঁই ভিজাইত পাচ্চিনি’। এতে যে খচ্চা হইচ্চে, তাতে আবাদ কইরি খরচই উইটপে না। সরকার যদি মাটের মধ্যি মধ্যি মোটা পাইপের ডিপটি (গভীর নলকূপ) বসা দিতি তাহলি হয়ত আমারে জানডা এট্টু বাঁইচতি’।
ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় ভবিষ্যত হুমকি সম্পর্কে পরিবেশবিদ গৌতম কুমার রায় বলেন, ‘আমাদের জীবনের মূল চলকশক্তি হলো পানি। পৃথিবীর মধ্যে বাংলাদেশিরাই ভাগ্যবান যে এতো সহজে সুপেয় পানির চাহিদা পূরণ করতে পারছি। পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশেও এমন এ্যাক্সেস নাই। অথচ সমন্বিত পরিকল্পনার অভাবে আমরা দিন দিন মরুময়তার দিতে ধাবিত হচ্ছি।’
তিনি বলেন, ‘বর্ষা মৌসুমে যে পানি আমরা পাই সেগুলোকে যদি ধরে রাখার জলাধার সৃষ্টি করতে পারতাম তাহলে আজ এমন হাপিত্যেস করতে হতো না। আমাদের সমুদ্র উপকূলের মানুষ জীবন ধারণের জন্য বর্ষা মৌসুমের পানি ধরে রেখে সারা বছর সুপেয় পানির সংস্থান করে থাকে। এমন উদাহরণ তো আমাদের দেশেই আছে। মানুষ তার প্রয়োজনে সব পারে’।
গৌতম রায় আরো বলেন, আমাদের ভূ-গর্ভস্থ সু-পেয় পানির স্তরের ওপর যে মাত্রাতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে গৃহস্থালী ও জীববৈচিত্র্যকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলা হয়েছে সেই সংকট উত্তরণে এখনই কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। যথাসময়ে উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ হলে অবশ্যম্ভাবী মহামারি থেকে আমরা কেউই মুক্তি পাবো না।
কুষ্টিয়া জনস্বাস্থ্য বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী ইব্রাহিম মো. তৈমুর বাসসকে বলেন, ‘বৈশ্বিক উষ্ণায়নে পরিবেশ বিপর্যয়ের ভয়াবহতা থেকে উত্তরণে অগ্রাধিকার বিবেচনায় সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ এবং পানি সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর পক্ষ থেকে বাস্তবানুগ উদ্যোগ নেওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প পথ নেই।’
তিনি ভূ-উপরিস্থ জলাধার সংরক্ষণ এবং অত্যাবশ্যক প্রয়োজন বিবেচনায় গভীর নলকূপ স্থাপন করে ভূ-গর্ভস্থ অগভীর স্তরের সু-পেয় পানির মজুত সুরক্ষার উদ্যোগ নেয়ার পরামর্শ দেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আগামীতে এই সংকট ক্রমশ বাড়বে। বিজ্ঞানীরা বলেছেন, ২০৭০ সাল নাগাদ পৃথিবীর তাপমাত্রা আরও ৩ ডিগ্রি বৃদ্ধি পাবে। সেক্ষেত্রে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কয়েকটি জেলার ভূ-গর্ভস্থ পানির মজুত সংকট নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।
কৃষি জমিতে নিরাপদ ও সাশ্রয়ী খরচে সেচ সরবরাহ অতি নগন্য হলেও বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি) গভীর নলকূপ ও এলএলপি পাম্পের মাধ্যেমে উপরিস্থ জলাধারের পানি থেকে সেচ ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করে চাষিদের ফসল উৎপাদন খরচ কমানোর দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। এই ধরনের সেচ ব্যবস্থা আরও শতগুন বেশি সম্প্রসারণের দাবি জানিয়েছেন চাষীরা।
চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার দিগড়ী গ্রামের সুভিধাভোগী চাষি দেলুয়ার হোসেন বলেন, ‘আমাদের মাঠ অতি উর্বব দো’আশ মাটি হলেও অনেক উচু হওয়ায় সেচ সংকটে দীর্ঘদিন ধরেই দো-ফসলি ছিল। গত দুই বছর আগে বিএডিসির ‘মুজিবনগর সেচ সম্প্রসারণ প্রকল্প’ গভীর নলকূপ স্থাপন করায় এর আশপাশে প্রায় ৩০০ বিঘা জমি এখন তিন ফসলি হয়ে উঠেছে। বিদ্যুৎ চালিত সরকারি এই পাম্পে সেচ খরচ অনেকটাই কমেছে। আগে এই ৩০০ বিঘা জমিতে ছিল ৭২টি অগভীর শ্যালোমেশিন। যা এখন বন্ধ হয়ে গেছে।
মেহেরপুরের রশিকপুর গ্রামের চাষী তাহের উদ্দিন বলেন, দুই বছর আগে আমাদের ভৈরব নদীর পানি দিয়ে সেচের ব্যবস্থা করে দিয়েছে বিএডিসি।