নওগাঁ, ১২ এপ্রিল, ২০২৫ (বাসস) : নওগাঁ সদর উপজেলার তিলকপুর ইউনিয়নের দেবীপুর গ্রামের বাঁশি তৈরির কারিগররা পহেলা বৈশাখকে সামনে রেখে ব্যস্ত সময় পার করছেন ।
ওই গ্রামে প্রবেশ পথে দেখা মিলবে রাস্তার দুইপাশে বাঁশি তৈরির উপকরণ নল গাছ। গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়ির বারান্দা, আঙিনা ও বাড়ির বাইরের খোলা জায়গায় গাছের ছায়ায় কারিগররা বসে বাঁশি তৈরির কাজ করছেন।
পরিবারের নারী-পুরুষ সবাই ব্যস্ত। কেউ নল খাগড়া বা নলের গাছ কেটে বাঁশির বিভিন্ন ভাগ তৈরি করছেন। আবার কেউ সেই বাঁশিতে জরি ও বেলুন লাগাচ্ছেন। এভাবেই তৈরি করা হচ্ছে গ্রাম-বাংলার পরিচিত নলের বাঁশি। এ বাঁশি সাধারণত শিশুদের কাছে খেলনা হিসেবে পরিচিত। এ গ্রামের প্রায় তিনশটি পরিবার বাঁশি তৈরির কাজে জড়িত। বৈশাখ মাস উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন স্থানে বসবে বৈশাখী মেলা। তাই কাক ডাকা ভোর থেকে রাত অবধি কাজ করে যাচ্ছেন বাঁশি কারিগররা। আর এসব বাঁশি স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে চলে যায় দেশের বিভিন্ন স্থানের মেলাগুলোতে।
আজ থেকে প্রায় ৫০ বছর আগে ওই গ্রামের বাসিন্দা মৃত আলেক মন্ডলের হাত ধরে বাঁশি তৈরির যাত্রা শুরু হয়। এরপর গ্রামের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে এ কাজে। বাঁশির গ্রাম হিসেবে পরিচিতি পায় দেবীপুর। বড় ধরনের মেলা যেমন বৈশাখী, রথ, মহরম, দশমির মেলা ও দুর্গাপূঁজা এবং দুই ঈদে প্রায় ২ কোটি টাকার বাঁশি উৎপাদন ও বেচাকেনা হয় এ গ্রাম থেকে। স্থানীয়ভাবে উদ্ভাবিত এ কুটির শিল্পকে এগিয়ে নিতে সঠিক পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এসব কারিগররা আর্থিক দিক থেকে আরো উন্নয়ন করতে পারবেন বলে মনে করেন তারা।
বাঁশি তৈরির প্রধান কাঁচামাল নল গাছ। এ গাছ কাটার পর পরিষ্কার করে সাইজ মতো কেটে রোদে শুকিয়ে অন্তত ১৫ ধাপে তৈরি হচ্ছে একেকটি বাঁশি। প্রতিটি বাঁশির তিনটি অংশ থাকে যাকে বলা হয় খাপ-চুঙ্গী-কল। বাঁশি তৈরিতে ভূমিকা পালন করে নারী-পুরুষ সমানভাবে। প্রতিটি বাঁশি তৈরিতে স্থানীয় ভাষায় যাকে বলা হয় সাদা বাঁশি। এছাড়াও নলের অব্যবহৃত অংশ জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয় প্রতিটি বাড়িতে। প্রতি হাজার বাঁশিতে জরি ও বেলুন লাগানো মজুরি ১৬০ টাকা। দুই দিনে এক হাজার কাজ করা যায়। অনেক নারী একদিনেই জরি জড়াতে পারেন দুই হাজার বাঁশিতে। যা আয় হয় সংসারের কাজে ব্যয় করা হয়। এছাড়া নিজেদের ব্যবসার জন্যও তৈরি করা হয়। বাঁশি তৈরির শেষ ধাপটি হয় প্রতিটি প্যাকেটে এক’শটি বাঁশি ভরে পলিথিনের প্যাকেটের মুখ মোমবাতির আগুনে গলিয়ে আটকে দেয়ার মধ্য দিয়ে।
দেবীপুর গ্রামের বাঁশির কারিগর আলতাফ হোসেন বাসস’কে বলেন, এখানকার বাঁশি রংপুর, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, খুলনা, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে পাইকাররা এসে কিনে নিয়ে যায়। এখন আগের মতো অন্য জেলা থেকে পাইকারা আর স্ব-শরীরে তেমন একটা আসেন না। কন্ডিশনে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে তাদের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এছাড়া ওই গ্রামের পুরুষেরা বিভিন্ন মেলায় বাঁশি নিয়ে গিয়ে বিক্রি করেন। প্রতি বছর প্রায় ২ কোটি বাঁশি তৈরি হয় এ গ্রামে। বাঁশি তৈরি হয় বছর জুড়ে।গ্রামের লোকজন সারা বছরই বাঁশি তৈরি করেন। তবে বৈশাখ ও জ্যেষ্ঠ মাসে তাদের ব্যস্ততা বেড়ে যায়। কারণ এ সময় আশপাশের বিভিন্ন অঞ্চলে গ্রামীণ মেলা বসে। এসব মেলায় বিক্রির জন্য ফেরিওয়ালা ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা দেবীপুরের কারিগরদের কাছ থেকে বাঁশি কিনে নিয়ে যান।
ওই গ্রামের বাচ্চু মন্ডল ও নাসিমা দম্পতি বাসস’কে বলেন, বাঁশি তৈরি তাদের প্রধান পেশা। দীর্ঘ ২৮ বছর ধরে পরিবারের ৬ সদস্যের সবাই বাঁশি বানায়। এবার বৈশাখী মেলা উপলক্ষে ইতোমধ্যে ৩০ হাজার বাঁশি বিক্রি করেছেন। এখনো প্রায় ২০ হাজার বাঁশির অর্ডার আছে।
বাঁশির উদ্ভাবক দেবীপুর গ্রামের মৃত আলেক মন্ডলের ছেলে আনিসুর রহমান বাসস’কে বলেন, যখন তার বাবা এ ব্যবসা শুরু করেন তখন এলাকায় খুব অভাব ছিল। দূর থেকে মালামাল নিয়ে এসে বাঁশি তৈরি করতো। তখন আমি ছোট ছিলাম। আর এখন বাঁশি এখানেই চাষ করা হয়। এ বাঁশির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে সারাদেশে। আমার বাবার হাত ধরেই আজ প্রায় ৩০০টি পরিবার এ পেশার সঙ্গে জড়িত।
বাঁশি ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেন বাসস’কে বলেন, তিনি প্রতি বছর ১০ লাখ টাকার বাঁশি বিক্রি করে থাকেন। এমনকি কোন কোন ব্যবসায়ী বছরে ৩০ লাখ টাকার বাঁশিও বিক্রি করে থাকেন।
বাঁশির কারিগর কোহিনুর বেগম, কমলা বানু, নাসিমা বানু ও সাজেদা বিবি বাসস’কে বলেন, পুরুষের রোজগারের পাশাপাশি নারীরাও এ শিল্প থেকে অর্থের যোগান দিয়ে থাকে। প্রায় ২৫-৩০ বছর ধরে আমরা এ পেশার সঙ্গে জড়িত। এ কাজ করে আমাদের সংসার চলে। ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া চলে। তাই এ শিল্পটিকে টিকিয়ে রাখতে সরকারের কাছে তারা সহজ শর্তে আর্থিক সহায়তার আশা করছেন।
শিক্ষার্থী আল মাহিম ও মিলি আক্তার বাসস’কে বলেন, বাবা-মা এ কাজ করে থাকেন। আমরা লেখাপড়ার ফাঁকে ফাঁকে সময় বের করে তাদেরকে সাহায্য করে থাকি।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) নওগাঁর উপ-ব্যবস্থাপক শামীম আক্তার মামুন বাসস’কে বলেন, নওগাঁর দেবীপুরে প্রায় ৩০০টি পরিবার এ পেশার সাথে যুক্ত রয়েছে। এখানকার বাঁশি দেশের বিভিন্ন স্থানে চলে যায়। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থাসহ কারিগরি প্রশিক্ষণ দেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন তিনি। ।
নওগাঁ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইবনুল আবেদীন বাসস’কে বলেন, পহেলা বৈশাখ আমাদের প্রাণের উৎসব। এ উৎসব উপলক্ষে নওগাঁ সদর উপজেলার দেবীপুর গ্রামের বাঁশি সারাদেশে চলে যায়। এ শিল্পটি আরো এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য যা যা করণীয় আমরা প্রশাসনের পক্ষ থেকে করা হবে।