নেত্রকোনা, ১৩ এপ্রিল, ২০২৫ (বাসস): বাংলা নববর্ষ ১৪৩২ কে বরণ করে নিতে নেত্রকোনায় ব্যস্ততম সময় পার করছেন জেলার মৃৎশিল্পের কারিগররা।
পহেলা বৈশাখে জেলার বিভিন্ন জায়গায় বসবে বৈশাখী মেলা। এ মেলায় রয়েছে মাটির তৈরি জিনিসের প্রচুর চাহিদা। এ চাহিদার বিপরীতে পণ্য যোগান দিতে রাতদিন এক করে কাজ করে যাচ্ছেন কারিগররা। সভ্যতার ক্রম বিকাশে মাটির তৈরি জিনিসের পরিবর্তে প্লাস্টিকের আধিপত্য থাকলেও বৈশাখ এলেই বাঙালির মন টানে শিকড়ের দিকে।
জেলায় অনেক জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাস করছেন মাটির জিনিসপত্র তৈরির কারিগররা। তারা বংশপরম্পরায় পাওয়া এ শিল্পকর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন। জেলার সদর উপজেলার সাতপাই পালপাড়া, আমতলা ইউনিয়নের পালপাড়া, শ্যামগঞ্জের পালপাড়াসহ বেশ কয়েকটি স্থানে মৃৎশিল্প কারিগরদের বসবাস।
জেলার সদর উপজেলার আমতলা ইউনিয়নের ছায়া সুনিবিড় গ্রাম পালপাড়া, এ গ্রামের প্রায় ৪০টি পরিবার শত বছর ধরে বংশপরম্পরায় মাটির তৈরি বিভিন্ন জিনিসপত্র তৈরি করে যাচ্ছেন।
সরেজমিনে এ গ্রামের বিভিন্ন মৃৎশিল্পীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মৃৎশিল্পে জড়িত কারিগরদের প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান না থাকলেও এ শিল্পের কাজে তারা দক্ষ জনশক্তি। পুরুষদের তুলনায় নারীরা অধিক দক্ষ ও পরিশ্রমী।
যুগ যুগ ধরে এ গ্রামগুলোর প্রায় ৪০টি পরিবার ঐতিহ্যবাহী এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত ছিল। প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতা আর প্রযুক্তি বিকাশের এ যুগে এ শিল্পের প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ সাধিত না হওয়ায় তা আজ আর প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না। ফলে বাপ-দাদার পেশা ছেড়ে অনেকে অন্য পেশার দিকে ঝুঁকে পড়েছেন।
বাসস প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলেছিলেন, পালপাড়ার ৭০ বছর বয়সী কারিগর সাধন চন্দ্র পাল।
তিনি জানান, ছোটবেলা থেকেই মাটির তৈরি জিনিসপত্র তৈরি করার কাজ করে যাচ্ছেন। তার বাবা সুরেশ চন্দ্র পাল আমৃত্যু এ কাজ করেছেন। বাবা মারা যাওয়ার পর তিনি বাবার কাজের হাল ধরেন, বয়সের ভারে নুয়ে নুয়ে হাঁটলেও একাগ্রচিত্তে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। সারাবছরই কাজ করেন তিনি। অনেকে অর্ডার দিয়ে তার কাছ থেকে মাটির তৈরি বিভিন্ন জিনিসপত্র সংগ্রহ করেন। একসময় জেলার বিভিন্ন এলাকায় মেলায় গিয়ে দোকান নিয়ে বসতেন তিনি।
একসময় বিভিন্ন ধরনের মাটির তৈরি জিনিসপত্র বানাতেন, মাটির তৈরি বাঘ, ঘোড়া, হাতি, ষাঁড়, ব্যাংক, টেপা পুতুল, কলসি, টমটম, বিভিন্ন ধরনের ফল, ছোট ছোট হাঁড়ি পাতিল, কড়াই, ঘর, ফুলদানি, পাটা, মাছ, নৌকাসহ প্রায় একশত প্রকার মাটির জিনিস বানাতেন তিনি। মাটির তৈরি জিনিসের ব্যবহার কমে যাওয়ায় অনেকে তাদের এ পৈত্রিক পেশা বদল করে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন ফলে দিনদিন বিলুপ্ত হচ্ছে এ শিল্পকর্ম।
একই গ্রামের বাসিন্দা ও মৃৎ শিল্পী রিতা রানী পাল জানান, ‘এ গ্রামেই আমার জন্ম। স্বামী মারা যাওয়ার পর বাবার বাড়ি চলে আসি। ছোটবেলা থেকেই আমরা মাটির তৈরি বিভিন্ন জিনিসপত্র তৈরি করার কাজে সম্পৃক্ত। স্বামী মারা যাওয়ার পর বাবার বাড়িতেই থাকি এবং বংশপরম্পরায় এ কাজ করে যাচ্ছি। এখন মানুষের আগ্রহ কম থাকায় এবং প্রয়োজনীয় উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়ায় অনেকে এ পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন। সরকারি, বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে হারানো এ পেশা ও ঐতিহ্য বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পাবে।’
প্রাচীনকাল থেকে মাটির তৈরি জিনিসপত্র ও নানান ব্যবহারিক সামগ্রীর সঙ্গে ওতোপ্রোতো ভাবে জড়িয়ে আছে বাঙালির সংস্কৃতি। প্লাস্টিকের তৈরি বাহারি পণ্যের ব্যবহার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মাটির তৈরি পণ্যের চাহিদা কমে যাওয়া, মূলধনের অভাব, কাঁচামালের দুষ্প্রাপ্যতা এবং স্বল্প আয়ের কারনে জনপ্রিয় এ শিল্প এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। আগেরকার দিনে মৃৎশিল্পের প্রয়োজনীয় উপকরণ যেমন: এঁটেল মাটি, রঙ, যন্ত্রপাতি ও জ্বালানি ছিল সহজলভ্য। কিন্তু বর্তমানে এসব প্রয়োজনীয় উপকরণের মূল্য বৃদ্ধি হওয়ার কারনে তারা হিমশিম খাচ্ছেন। তাই জীবিকার তাগিদে এ পেশা ছেড়ে সবাই অন্য পেশা বেছে নিয়েছে। মাত্র কয়েকটি পরিবার এখনো তাদের বংশ পরম্পরায় চলে আসা ঐতিহ্যকে আঁকড়ে ধরে জীবিকা নির্বাহ করছেন।