পরিবেশ রক্ষায় প্লাস্টিক বর্জন অপরিহার্য : আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় উদ্যোগে গুরুত্ব আরোপ

বাসস
প্রকাশ: ১৯ আগস্ট ২০২৫, ১০:৩০ আপডেট: : ১৯ আগস্ট ২০২৫, ১১:১২

\ সেলিনা শিউলী \

ঢাকা, ১৯ আগস্ট, ২০২৫ (বাসস) : পৃথিবীতে ক্রমবর্ধমান হারে প্লাস্টিক দূষণ বেড়ে চলেছে। প্রতিদিন প্রকৃতির নানা অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। নানা পদক্ষেপ, কর্মসূচি এবং পরিকল্পনা থাকলেও পরিবেশকে রক্ষা করতে এখনো কার্যকর সমাধান যথেষ্ট প্রয়োগ করা হয়নি। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, পরিবেশ রক্ষায় দূষিত প্লাস্টিক ব্যবহারের বিকল্প গ্রহণ করা এখন একমাত্র উপায়।

বিশ্বব্যাপী সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে পরিবেশ সংরক্ষণ এবং দূষণ প্রতিরোধকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। সম্প্রতি বিশ্ব পরিবেশ দিবস-২০২৫ উদ্যাপনের সময় পরিবেশ সচেতনতার বার্তা বিশেষভাবে প্রচার করা হয়েছে। জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি (UNEP)এবারের বিশ্ব পরিবেশ দিবসের প্রতিপাদ্য হিসেবে ‘এন্ডিং প্লাস্টিক পলিউশন’ বা বাংলায় ‘প্লাস্টিক দূষণ আর নয়’ নির্ধারণ করেছে। বিশ্ব পরিবেশ দিবসের স্লোগান ছিল, ‘বিট প্লাস্টিক পলিউশন’ বাংলায় হলো ‘প্লাস্টিক দূষণ বন্ধ করার এখনি সময়’।

বিশ্ব পরিবেশ দিবস উদযাপনে আন্তঃসরকারি আলোচনা এবং অনুষ্ঠানগুলোতে বিশেষভাবে জোর দেওয়া হয়েছে প্লাস্টিক বর্জ্য কমানো, পুনর্ব্যবহার এবং টেকসই বিকল্প ব্যবহারের ওপর। বাংলাদেশেও এই উদ্যোগে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিশ্ব পরিবেশ দিবসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উল্লেখ করেছেন, ‘পৃথিবীর সর্বনাশের জন্য যারা দায়ী, তারা আমরা সবাই এখানে হাজির। আমরা আসামি।’

ড. ইউনূস বলেন, ‘প্লাস্টিকের ব্যবহার পৃথিবীতে তিন ধরনের সংকট বাড়িয়েছে- জলবায়ুগত সংকট, প্রকৃতিগত সংকট এবং জীববৈচিত্র্যের ক্ষয়। প্লাস্টিক শুধু পরিবেশকে নয়, পৃথিবীর জীববৈচিত্র্যকেও ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে।’

তিনি আশাপ্রকাশ করেন, “প্লাস্টিক ব্যবস্থাপনা ঠিকঠাক না থাকায় পৃথিবীর জলাশয়গুলো পলিথিন এবং অন্যান্য প্লাস্টিক দিয়ে ভর্তি হয়ে গেছে। ফলে জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের মুখে। প্লাস্টিক এমন একটি বস্তু, যার জন্ম আছে কিন্তু মৃত্যু নেই। এটি ক্রমবর্ধমানভাবে পরিবেশে ধ্বংস এবং দূষণ ছড়াচ্ছে। আমরা যদি আমাদের লাইফস্টাইল পরিবর্তন না করি, তাহলে মানুষের পরাজয় অবধারিত।”

ড. ইউনূস আরও বলেন, “প্লাস্টিক পরিবেশের জন্য বিষাক্ত। এটি কেবল মানুষ নয়, পৃথিবীর সকল প্রাণীর জন্য ক্ষতিকর। বিশ্বে মানুষ বাড়ছে, বাংলাদেশেও বাড়ছে এবং এর সঙ্গে বাড়ছে জনপ্রতি প্লাস্টিকের ব্যবহার। আজ থেকেই আমাদের মনে মনে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে আমরা প্লাস্টিক বর্জন করব।”

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “দেশের প্রতিটি নাগরিক যদি সপ্তাহে অন্তত একদিন একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক বর্জন করে, তাহলে ধাপে ধাপে প্লাস্টিকের ব্যবহার কমানো সম্ভব হবে। তবে এর জন্য দৃঢ় সংকল্প দরকার। সংকল্প ছাড়া এই পথ অতিক্রম করা কঠিন।”

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান মন্ত্রণালয়ে যোগদানের পর পরিবেশ দূষণ রোধে বিভিন্ন কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। সচিবালয়ে সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক ব্যবহার বন্ধের উদ্যোগ গ্রহণ, শপিংমল, খুচরা বাজার এবং কাঁচাবাজারে প্লাস্টিকের ব্যবহার সীমিত করা, এমন উদ্যোগের মধ্যে উল্লেখযোগ্য।

এছাড়াও, ১৩ আগস্ট ২০২৫-এ সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় অনুষ্ঠিত প্লাস্টিক দূষণবিষয়ক আন্তর্জাতিক আলোচনাসভার দ্বিতীয় পর্বে প্রস্তাবিত গ্লোবাল প্লাস্টিকস চুক্তির খসড়া বাংলাদেশ কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, খসড়াটি দুর্বল ও অপর্যাপ্ত। এতে প্লাস্টিকের পূর্ণ জীবনচক্র, স্বাস্থ্য প্রভাব, ক্ষতিকর রাসায়নিক, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অগ্রাধিকার এবং আন্তঃসীমান্ত দূষণ রোধে বাধ্যতামূলক পদক্ষেপ অন্তর্ভুক্ত নয়।

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, “প্লাস্টিক দূষণ নিয়ন্ত্রণে সবাইকে সম্মিলিতভাবে উদ্যোগ নিতে হবে। প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য ‘এক্সটেন্ডেড প্রডিউসার রেসপন্সিবিলিটি (EPR)’ নির্দেশিকা কার্যকর করা দরকার। আমাদের সমাজের সকল স্তর সচেতন হলে প্লাস্টিক দূষণ নিয়ন্ত্রণে সম্ভব হবে।”

বাংলাদেশ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক মো. আলমগীর কবির জানান, বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ঘোষিত পলিথিন বর্জন কার্যকরভাবে হচ্ছে না। ২০১৯ সালের গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিবছর বাংলাদেশে প্রায় ৮৭ হাজার টন সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয়, যার ৯৬ শতাংশ সরাসরি পরিবেশে ফেলা হয়। অবশিষ্ট ৪ শতাংশ ল্যান্ডফিল্ডে জমা হয়। নদী, খাল ও সমুদ্রেও প্লাস্টিকের উপস্থিতি শনাক্ত হয়েছে।

তিনি উল্লেখ করেন, “পলিথিন সহজে ধ্বংস হয় না। আগুনে পোড়ালে কার্বন মনোক্সাইড, ডাইঅক্সিন ও ফিউরান নির্গত হয়, যা মানবদেহে ক্যান্সারসহ নানা রোগের কারণ হয়ে থাকে। মাটিতে মিশতে ৪০০-৭০০ বছর সময় লাগে। কৃষি জমির উর্বরতা হ্রাস পাচ্ছে, মাছের মধ্যে মাইক্রো প্লাস্টিকের উপস্থিতি ধরা পড়েছে। তাই আমাদের সচেতন হতে হবে এবং পরিবার থেকে শুরু করে দৈনন্দিন জীবনে প্লাস্টিক বর্জনের কাজ শুরু করতে হবে।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের চেয়ারম্যান ড. ইশরাত নাজিয়া বলেন, “পলিথিনের কারণে স্বাস্থ্য ঝুঁকি সৃষ্টি হয়, জলাবদ্ধতা এবং জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়। শতশত বছর ধরে প্লাস্টিক মাটিতে মিশে যায় না। আমাদের বর্তমান প্রজন্ম এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিরাপত্তার জন্য সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা জরুরি।”

উল্লেখ্য, বাংলাদেশে সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক ২০০২ সালে নিষিদ্ধ করা হয়। জনসচেতনতা বৃদ্ধির চেষ্টা থাকলেও ২০২৪ সালে ১৭টি সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক সামগ্রী চিহ্নিত করা হলেও বাস্তবায়ন কার্যকর হয়নি। বিশ্বব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সারাবিশ্বে মাথাপিছু গড় প্লাস্টিক ব্যবহার ৩৫ কেজি, বাংলাদেশে মাত্র ৫ কেজির কম।

বাংলাদেশ পরিবেশ রক্ষায় আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় উদ্যোগকে সমন্বিতভাবে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তবে সাফল্য পেতে হলে প্রতিটি নাগরিককে সচেতন হয়ে দৈনন্দিন জীবনে প্লাস্টিক বর্জনের কাজ শুরু করতে হবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
কূটনীতি ব্যর্থ হলে রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের আহ্বান ম্যাখোঁর
কূটনীতি ব্যর্থ হলে রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের আহ্বান ম্যাখোঁর
ফেনীতে স্বেচ্ছাসেবক দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে র‌্যালি
পিরোজপুরে স্বেচ্ছাসেবক দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালিত
সাতক্ষীরায় ফার্মেসি মালিককে ভ্রাম্যমাণ আদালতের জরিমানা 
উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করা হবে:  কিম 
কুমিল্লায় সাংবাদিকদের ওপর হামলা মামলার প্রধান আসামি গ্রেফতার
সারাদেশের জলাশয় রক্ষায় কাজ করে যাব: মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা
২০২৪ সালে রেকর্ড ৩৮৩ সাহায্য কর্মী নিহত : জাতিসংঘ
মানসিক ভারসাম্য হারানো ছাত্রদল নেতার দায়িত্ব নিলেন তারেক রহমান
১০