।। জীতেন বড়ুয়া ।।
খাগড়াছড়ি , ১৩ এপ্রিল ২০২৫ (বাসস) : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বর্ষবরণ উৎসবে মুখর হয়ে উঠেছে পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি। এ যেন উৎসবের নগরী। বাংলা নববর্ষকে বরণ করতে নানা আয়োজনে ব্যস্ত স্থানীয় বাসিন্দারা। খাগড়াছড়িতে মূলত ত্রিপুরা, চাকমা ও মারমা সম্প্রদায়ের বাস। বাংলা নববর্ষকে ঘিরে তিন সম্প্রদায়ের রয়েছে তিন উৎসব। প্রত্যেক সম্প্রদায়ের মানুষ তিন দিনব্যাপি নানা আয়োজনে নতুন বছরকে বরণ করেন। ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের বৈসু উৎসব, চাকমা সম্প্রদায়ের বিজু উৎসব এবং মারমা সম্প্রদায়ের সাংগ্রাই উৎসব।
আজ বর্ষবরণ উপলক্ষে খাগড়াছড়িতে শুরু হয়েছে ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের প্রধান সামাজিক উৎসব বৈসু উৎসব। বৈসু রীতি অনুযায়ী সকালে দেবী গঙ্গার উদ্দেশ্যে ফুল ও হাতে বোনা নতুন কাপড় ভাসিয়ে হারি বৈসু ্উদ্যাপন করা হয়। এর মধ্য দিয়ে পুরোনো বছরকে বিদায় ও নতুন বছরকে বরণের প্রস্তুতি নেন তারা। বৈসু উৎসব চলবে আগামী তিন দিন।
শেষ চৈত্রের ভোরের প্রথম আলোয় দেবী গঙ্গার উদ্দ্যেশ্যে ফুল ভাসানোর জন্য জড়ো হন ত্রিপুরা নারীরা। আজ সকালে খাগড়াছড়ির খাগড়াপুর এলাকায় নিজেদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক রিনা -রিসাই পরে অংশ নেন এই উৎসবে। বন থেকে সংগ্রহ করা মাধবীলতা, অলকানন্দ, জবাসহ বিভিন্ন ধরনের ফুল দিয়ে পুরাতন বছরের দুঃখ গ্লানি মুছে নতুন বছরকে বরণ করে নিতে দেবী গঙ্গার উদ্দেশ্যে পূজা করেন তারা। এসময় নিজেদের হাতে বোনা ছোট্ট কাপড় ভাসানো হয় জলে। ত্রিপুরা পঞ্জিকা অনুসারে চৈত্র মাসের ২৯ তারিখে এই উৎসবের আয়োজন করা হয়।
হারি বৈসুতে অংশ নেয়া রীতি ত্রিপুরা ও তুলিকা ত্রিপুরা বলেন ,‘ আমরা খুব সকালে ফুল সংগ্রহ করি। পরে সেই ফুল আমরা নদীতে এসে ভাসিয়ে দিই। এসময় জলে গঙ্গা দেবীর পূজা করি। এখানে অংশ নিতে পেরে আমরা খুবই খুশি । কারণ বছরে একবার মাত্র এই ধরনের উৎসব হয়।’
গায়ত্রী ত্রিপুরা বলেন, ‘আমি ঢাকায় থাকি। অনেক বছর পর আমি এ ধরনের উৎসবে অংশ নিয়েছি। খুবই ভালো লাগছে হারি বৈসু’র এই উৎসবে নিজেকে যুক্ত করতে পেরে।’
নতুন বছর বরণে হারি বৈসু (চৈত্রের শেষ দিন), বৈসুমা (বৈশাখের প্রথম দিন) এবং বিসিকাতাল (বৈশাখের দ্বিতীয় দিন) তিন দিন পৃথক আয়োজন করে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী। হারি বৈসুতে তারা জলে ফুল ও নতুন কাপড় ভাসায়। এছাড়া বৈসুমাতে ঘরে ঘরে অতিথি আপ্যায়ন করা হয়। বিসিকাতালের দিন নতুন বছরকে বরণ করা হয়।
ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের এই উৎসব দেখতে পর্যটকরাও যোগ দিয়েছেন। এমন বর্ণিল আয়োজন দেখে মুগ্ধ তারা। ঢাকা থেকে আসা সাবরিনা জানান,‘ আমি প্রথমবার এমন সুন্দর একটা আয়োজন দেখেছি। খুবই ভালো লাগছে পাহাড়ের মানুষের প্রাণ এই উৎসব দেখে। পাহাড়ের মানুষ সবসময়ই এমন ভালো থাকুক এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
বৈসু উদ্যাপন কমিটির সদস্য দীনা ত্রিপুরা জানান,‘ মূলত নারীদের অংশগ্রহণে নতুন বছর বরণের এই হারি বৈসু উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। ত্রিপুরা নারীদের অনেকেই রিনা রিসাই ( নিজেদের এতিহ্যবাহী পোশাক) বুনন করে। নতুন বছরে পোশাক বুননে যাতে দক্ষতা আরো নিপুণতা আসে সেজন্যই ফুলের সাথে ভাসানো হয় হাতের বোনা ছোট্ট কাপড়। তাদের বিশ্বাস, এতে গঙ্গা দেবীর আশীর্বাদে বুনন কাজে তারা আরো দক্ষ হয়ে উঠবে। ১৫ এপ্রিল শেষ হবে ত্রিপুরাদের বৈসু উৎসব।
এর আগে বর্ষ বরণ উপলক্ষে গতকাল তিন দিনব্যাপি শুরু হয়েছে বিজু উৎসব। গতকাল চাকমা সম্প্রদায় ফুল বিজু পালন করেছে। আজ চলছে মূল বিজু। আগামীকাল সোমবার পহেলা বৈশাখ বা গজ্জাপয্যা পালন করবে
চাকমা জনগোষ্ঠীর বিজু উৎসবের দ্বিতীয় দিন মূল বিজু উপলক্ষে আজ ঘরে ঘরে চলছে অতিথি আপ্যায়ন। এদিন পরিবেশন করা হয় প্রায় ১ শত রকমের সবজি দিয়ে তৈরি বিশেষ পাঁজন। সারাদিন চাকমাদের ঘরে ঘরে চলে অতিথি আপ্যায়ন ও ঘুরে বেড়ানো । মূল বিজুর প্রধান আকর্ষণ পাচন তরকারি, যা কমপক্ষে ৩২ প্রকার সবজি মিলিয়ে করে রান্না করা হয়। তবে শতের অধিক সবজি মিশিয়েও রান্না করে অনেকে।
পাহাড়ি জনগোষ্ঠী মনে করে এটি যেহেতু বিভিন্ন প্রকার সবজি মিশিয়ে রান্না করা হয়, সেহেতু এটি ঔষধি গুণ সমৃদ্ধ একটি তরকারি। পাচন ছাড়া প্রতিটি ঘরে ঘরে থাকে নানান ধরনের খাবারের আয়োজন।
আগামীকাল সোমবার পহেলা বৈশাখে খাগড়াছড়িতে শুরু হবে মারমা সম্প্রদায়ের সাংগ্রাই উৎসব। তিন দিনব্যাপি চলবে এই উৎসব। এ উৎসবের প্রধান আকর্ষণ ঐতিহ্যবাহী জলকেলি বা পানি খেলা। এছাড়াও জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হবে বর্ষবরণের উৎসব।