ঢাকা, ৩ আগস্ট ২০২৫ (বাসস) : বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টি-সেক্টরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশন (বিমসটেক)-এর ষষ্ঠ সম্মেলনে ২০২৫-২০২৭ মেয়াদের জন্য বাংলাদেশের চেয়ারম্যান পদ গ্রহণ দেশটির জন্য ‘ব্যাংকক ভিশন ২০৩০’ বাস্তবায়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন ও বৃহত্তর অঞ্চলের সাথে আরও ঘনিষ্ঠভাবে একসাথে কাজ করতে সহায়তা করবে বলে মন্তব্য করেছে ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স-বাংলাদেশ (আইসিসিবি)।
আজ রোববার প্রকাশিত আইসিসিবির ত্রৈমাসিক বুলেটিনের (এপ্রিল-জুন ২০২৫) সম্পাদকীয়তে সংগঠনটি জানিয়েছে, এই নেতৃত্ব বাংলাদেশের জন্য শুধু বিমসটেক নয়, বৃহত্তর আঞ্চলিক রাজনীতিতেও একটি শক্তিশালী অবস্থান গড়ে তোলার পথ সুগম করেছে।
সম্পাদকীয়তে উল্লেখ করা হয়, এ বছর (২০২৫) বিমসটেক গঠনের ২৫ বছর পূর্তি হয়। ১৯৯৭ সালের ৬ জুন এই জোট প্রতিষ্ঠিত হয়।
গত ৪ এপ্রিল ২০২৫ ব্যাংককে অনুষ্ঠিত বিমসটেকের ৬ষ্ঠ শীর্ষ সম্মেলনে ‘ব্যাংকক ভিশন ২০৩০’ নামে নতুন পরিকল্পনা নেওয়া হয় । যেখানে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) এবং থাইল্যান্ডের পরিবেশবান্ধব বায়ো-সার্কুলার-গ্রিন (বিসিজি) অর্থনৈতিক মডেলকে গুরুত্ব দেয়া হয়।
আইসিসিবি মনে করে, সংযোগ হচ্ছে বিমসটেকের কৌশলগত পরিকল্পনার মূল বিষয়, বিশেষ করে ব্যাংকক ভিশন ২০৩০-এর অধীনে। এর একটি প্রধান লক্ষ্য হলো বিমসটেক ট্রান্সপোর্ট কানেকটিভিটি মাস্টার প্ল্যান (২০১৮-২০২৮) দ্রুত বাস্তবায়ন করা। এই পরিকল্পনায় ২৬৭টি অবকাঠামো প্রকল্প রয়েছে। এর মধ্যে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ দুটি প্রকল্প হলো ভারত-মিয়ানমার-থাইল্যান্ড ত্রিপাক্ষিক মহাসড়ক ও কালাদান মাল্টি-মোডাল ট্রান্সপোর্ট প্রকল্প। এই দুটি প্রকল্প দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে সড়ক ও নৌপথে সহজ ও নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ নিশ্চিত করতে সাহায্য করবে। সদস্য দেশগুলো এই সংযোগ উন্নয়নে এখন আরও বেশি রাজনৈতিকভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ।
সম্পাদকীয়তে বলা হয়, বিমসটেকের স্থায়ী সচিবালয়ের স্বাগতিক দেশ এবং বর্তমানে সংগঠনটির চেয়ার হওয়ার কারণে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নমূলক নানা উদ্যোগে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য ভালো অবস্থানে রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে সড়ক, বন্দর ও বাণিজ্যপথ, বিশেষ করে সমুদ্রপথ উন্নয়নের কাজগুলোকে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যাওয়া দরকার। ব্যাংকক সম্মেলনে সদস্য দেশগুলো সমুদ্রপথে পরিবহন উন্নয়নে আগ্রহ দেখিয়েছে, যা এই অঞ্চলের বাণিজ্য ও পণ্য পরিবহনের সমস্যাগুলো কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করতে পারে। তবে এই পরিকল্পনাগুলোর সফলতা নির্ভর করবে সদস্য দেশগুলোর রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও প্রতিশ্রুতির ওপর। উদাহরণস্বরূপ, মিয়ানমারের চলমান সংকট আঞ্চলিক সহযোগিতার পথে এখনো বড় বাধা হয়ে রয়েছে।
বিমসটেক দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ এখনো অনেক কম। মোট বাণিজ্যের মাত্র ৭ শতাংশ হয় বিমসটেক সদস্য দেশগুলোর মধ্যে। অন্যদিকে আসিয়ান দেশগুলো নিজেদের মধ্যে প্রায় ২৫ শতাংশ বাণিজ্য করে। এভাবে বিমসটেকে বাণিজ্য কম হওয়ার একটি বড় কারণ হলো ফ্রি ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট (এফটিএ) বা মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি সই না হওয়া। এটি নিয়ে ২০০৪ সাল থেকে আলোচনা চলছে, কিন্তু অগ্রগতি খুব ধীর। এর পেছনে বড় বাধাসমূহ হচ্ছে অশুল্ক বাধা (যেমন বিভিন্ন কাগজপত্র ও অনুমতির জটিলতা), কিছু স্পর্শকাতর পণ্যকে রক্ষা করার প্রবণতা এবং অনেক দেশের বাজার খুলতে অনিচ্ছা। ব্যাংকক ভিশন ২০৩০ এই এফটিএ দ্রুত বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে, তবে অগ্রগতি এখনো ধীর এবং অসম।
বিমসটেকের বর্তমান চেয়ার হিসেবে বাংলাদেশের উচিত সদস্য দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য বাড়ানোর ওপর জোর দেওয়া। এ জন্য বাংলাদেশের কিছু কাজ করতে হবে যেমন- ভিসা নিয়ম সহজ করা, কাস্টমস প্রক্রিয়া আরও দ্রুত ও সহজ করা এবং ডিজিটাল পেমেন্ট ব্যবস্থাকে উৎসাহ দেওয়া।
বিমসটেকের সঙ্গে সম্পর্ক আরও জোরালো হলে বাংলাদেশের পোশাক, কৃষি, ওষুধ এবং হালকা শিল্প খাতের ব্যবসা আরও বেশি লাভবান হবে, বাণিজ্য খরচ কমবে এবং নতুন বাজারে সহজে পণ্য পাঠানো যাবে। এছাড়া, বিদেশি কোম্পানিগুলোর কাছেও বাংলাদেশ আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে, বিশেষ করে অবকাঠামো, বিদ্যুৎ ও ডিজিটাল প্রযুক্তি খাতে। যদি পরিষ্কার ও স্থিতিশীল আঞ্চলিক বাণিজ্য নিয়ম থাকে, তবে বিনিয়োগ আরও বাড়বে। এর ফলে শুধু বাংলাদেশ নয়, পুরো অঞ্চল উপকৃত হবে।
২৫ বছর পার হলেও বিমসটেক এখনো অনেক বড় চ্যালেঞ্জের মুখে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ পরিবহন প্রকল্প এখনো বিলম্বিত, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং মাঝে মাঝে ভারতের সঙ্গে উত্তেজনা এ সবই আঞ্চলিক সহযোগিতাকে বাধাগ্রস্ত করছে। এর সঙ্গে মিয়ানমারের চলমান অস্থিরতা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে, ফলে গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা কঠিন হয়ে পড়ছে। এসব কারণে বিমসটেকের ভেতরের ঐক্য নিয়েও এখন প্রশ্ন উঠছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বিমসটেকের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য এখন ৪০ বিলিয়ন ডলারের কিছুটা বেশি। কিন্তু সম্ভাবনা রয়েছে ২৫০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি বাণিজ্যের।
বিমসটেক ট্রেড ফ্যাসিলিটেশন স্ট্র্যাটেজিক ফ্রেমওয়ার্ক ২০৩০, যা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) তৈরি করেছে, এটি সদস্য দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য সহজ করার একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ। বাংলাদেশ এখন বিমসটেকের দুই বছরের জন্য নেতৃত্বে রয়েছে। এই সময়ে বাংলাদেশের সামনে সুযোগ আছে অন্য সদস্য দেশগুলোকে রাজি করানোর, যাতে তারা এডিবি ফ্রেমওয়ার্ক ২০২৩ বাস্তবায়ন করে।