মো. আসাদুজ্জামান
সাতক্ষীরা, ২ সেপ্টেম্বর ২০২৫ (বাসস) : গরিবের ডাক্তার খ্যাত ডা. মো. এবাদুল্লাহ মাত্র ১০ টাকায় চিকিৎসাসেবা দিয়ে মানবতার এক উজ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
চেম্বারের সামনে রোগীর ভিড় দেখেই আঁচ করা যায় ডা. এবাদুল্লাহর জনপ্রিয়তা। সাতক্ষীরাবাসী তাঁেক চেনে গরিবের ডাক্তার হিসেবে। একসময় তিনি মাত্র ৫ টাকা ফি নিয়ে রোগী দেখতেন। দ্রব্যমূল্যের এই ঊর্ধ্বগতির সময়ে তিনি এখন নিচ্ছেন মাত্র ১০ টাকা। প্রতিদিন তিনি ১০০ থেকে প্রায় ১৫০ জন রোগী দেখেন। সাতক্ষীরা জেলার বাইরে খুলনা ও যশোর জেলা থেকেও অসহায় গরিব রোগীরা তার কাছে চিকিৎসা নিতে আসেন। তার কাছে আসা রোগীদের অধিকাংশ নিম্ন আয়ের মানুষ। মধ্যবিত্তরাও এখানে চিকিৎসা নিতে আসে। যুগ যুগ ধরে চিকিৎসা প্রদান করে তিনি সাধারণ মানুষের মনের মণিকোঠায় স্থান করে নিয়েছেন। অনেকের আবার পারিবারিক ডাক্তারও তিনি। গরিব মানুষেরা যারা তার কাছে চিকিৎসা নিতে আসেন তারা সবাই ডাক্তারের প্রশংসা করেন।
সাতক্ষীরার সাবেক সিভিল সার্জন ডা. মো. এবাদুল্লাহ। তিনি সাতক্ষীরা শহরের পাকাপোল মোড়স্থ খান মার্কেটের দ্বিতীয় তলায় নওয়াব ক্লিনিকে দীর্ঘ প্রায় ৪৫ বছর ধরে চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন। ১৯৭৭ সালে এমবিবিএস পাস করার পর থেকে তিনি দীর্ঘদিন সততার সাথে সরকারি দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৯ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত তিনি সাতক্ষীরার সিভিল সার্জন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পিতামহ নওয়াব আলি সরদারের দেওয়া শিক্ষাকে ধারণ করে মানবসেবায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. এবাদুল্লাহ আমৃত্যু মানবসেবায় নিজেকে নিয়োজিত রাখার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
ডা. এবাদুল্লাহ ১৯৫৩ সালের ৩০ এপ্রিল সাতক্ষীরার আশাশুনির কাদাকািট গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা আবদুল মোতালেব সরদার পেশায় একজন কৃষক ছিলেন। মাতা আমিরুন্নেসা গৃহবধূ। ১১ ভাই-বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। আশাশুনি উপজেলার হামিদ আলী হাইস্কুল থেকে ১৯৬৮ সালে প্রথম বিভাগ পেয়ে মাধ্যমিক পরীক্ষা (এসএসসি) পাশ করেন। ১৯৭০ সালে খুলনা বিএল কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক (এইচএসসি) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হন। ১৯৭১ সালে তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। যুদ্ধ থেকে ফিরে আবারো লেখাপড়ায় মন দেন। ১৯৭৭ সালে এমবিবিএস পাশ করে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেই যোগদান করেন। ১৯৮০ সালে সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বদলি হয়ে আসেন। ২০১০ সালে তিনি সিভিল সার্জন হিসেবে কর্মরত থেকে অবসরে যান।
সাতক্ষীরা জেলা নাগরিক কমিটির যুগ্ম আহবায়ক আলীনুর খান বাবুল বাসসকে বলেন, ডা. এবাদুল্লাহ সাতক্ষীরা জেলাব্যাপী গরিবের ডাক্তার হিসেবে পরিচিত। ৭২ বছর বয়সের একজন মানুষ নিরলসভাবে মাত্র ১০ টাকায় সাধারণ মানুষকে চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছেন। এটি একটি অনন্য দৃষ্টান্ত। শুধু সাতক্ষীরা জেলা নয় এর আশেপাশের বিভিন্ন জেলা থেকেও হাজার হাজার অসহায় গরিব মানুষ সাবেক এই সিভিল সার্জনের কাছে চিকিৎসাসেবা নিচ্ছেন। সেবা দিয়েই তিনি মানুষের আস্থাভাজন হয়েছেন। মানুষের প্রিয় হয়েছেন। তার মতো মানুষ আমাদের সমাজে খুবই প্রয়োজন।
তিনি বলেন, বর্তমানে চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। এছাড়া সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা পাওয়াও খুবই কঠিন। বর্তমানে একজন গরিব মানুষের ভালো ডাক্তার দেখাতে গেলে তার এক মাসের খাওয়া খরচই চিকিৎসা বাবদ চলে যায়। আর সেখানে ডা. এবাদুল্লাহর মতো একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক মাত্র ১০ টাকায় চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন এটি সারাদেশের মানুষের কাছে মানবতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
নওয়াব ক্লিনিকে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, খুব কম খরচে চিকিৎসা পাওয়া যায় বলে তারা সবসময় এখানেই চিকিৎসা নিতে আসেন। তারা বলেন, অন্য ডাক্তারের কাছে গেলে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা ডাক্তারের ফি দিতে হয়। সেখানে আমাদের এই গরিবের ডাক্তারের ফি মাত্র ১০ টাকা। আমরা তার কাছে চিকিৎসা নিলে একই টাকায় ডাক্তারের ফিসহ ওষুধপত্রও কিনতে পারি। আমরা তার দীর্ঘায়ু ও সুস্থতা কামনা করি।
ডা. এবাদুল্লাহর পুত্র নাদিম মোস্তফা বলেন, কর্মব্যস্ততার কারণে আমরা বাবার আদর- স্নেহ থেকে বঞ্চিত হলেও আক্ষেপ নেই। বরং বাবা আর্ত-মানবতার সেবায় নিয়োজিত থাকায় গৌরব বোধ করি।
ডা. মো. এবাদুল্লাহ বাসসের সাথে আলাপকালে জানান, জীবনের শুরু থেকেই তিনি আর্ত-মানবতার সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। চাকরি জীবনে তিনি বিকেলে নিজ চেম্বারে ৫ টাকা ফি নিয়ে অসহায় গরিব মানুষকে চিকিৎসাসেবা দিতেন। অবসরে যাওয়ার পর তিনি ১০ টাকা ফি নেন।
তিনি বলেন, অনেক গরিব রোগী আছে যারা ডাক্তারের ফির ভয়ে চিকিৎসা নিতে আসেন না। তাই স্বল্পমূল্যে তাদের চিকিৎসেবা নিশ্চিত করতে আমি এই উদ্যোগ নেই। অল্প টাকা নিয়ে তাদের প্রেসক্রিপশনটা করে দিলে তারা কষ্ট করে অন্তত ওষুধটি কিনে খেতে পারেন। কিন্তু ডাক্তারকে ৫০০ টাকা ফি দিতে হলে তারা ওষুধ কিনবেন কী দিয়ে।
কৈশরের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, যখন ছোট ছিলাম তখন কলেরা ও বসন্ত রোগে এলাকার অর্ধেক মানুষ মারা যেতো। তাদের চিকিৎসা দেয়ার মতো ডাক্তার ছিল না। এমনকি শহরেও এক দুইজন ডাক্তার থাকতেন। আমি যখন সাতক্ষীরা শহরে ডাক্তারি শুরু করি তখন এখানে আমরা মাত্র ৪ জন ডাক্তার ছিলাম। সেসময় সারাদিনই রোগী দেখতাম। বর্তমানে সাতক্ষীরা জেলার বাইরে খুলনা ও যশোর জেলা থেকেও অসহায় গরিব রোগীরা এখানে চিকিৎসা নিতে আসেন। বয়সের ভারে কিছুটা নুয়ে পড়লেও এখনও সাধ্যমতো সেবা দিচ্ছেন ডা. এবাদুল্লাহ।
তিনি বলেন, ‘এখনও মানুষকে সেবা দিতে পারছি, এটাই জীবনের বড় সার্থকতা। আমৃত্যু মানুষকে এই সেবা দিয়ে যেতে চাই।’
সাতক্ষীরার বর্তমান সিভিল সার্জন ডা. আব্দুস সালাম বাসসকে বলেন, ‘ডা. মো. এবাদুল্লাহ একজন এমবিবিএস ডাক্তার ও সাবেক সিভিল সার্জন হয়েও ৪৫ বছরের বেশি সময় ধরে খুবই সামান্য ফি নিয়ে গরিব অসহায় মানুষকে সেবা দিয়ে আসছেন। তিনি যে ভিজিট নেন, এটা কোনো টাকা নয়। এটি একটি টোকেন মানি। মাত্র ১০ টাকা ফি নিয়ে একটি প্রেসক্রিপশন করা খুবই প্রশংসনীয় কাজ। তিনি তার সামাজিক দায়িত্ব দক্ষতা ও নিষ্ঠার সাথে পালন করছেন। তার কাছ থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে।’ তিনি মহৎপ্রাণ ডা. এবাদুল্লাহর সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করেন।