।। তানভীর হায়াত খান।।
নেত্রকোনা, ২ সেপ্টম্বর, ২০২৫ (বাসস) : জেলায় গাছের নার্সারি ব্যবসা জনপ্রিয় একটি পেশায় পরিনত হয়েছে। ধানের জমিতে ধান চাষ করে যতটুকু মুনাফা আসে তারচেয়ে বেশি পরিমাণ মুনাফা আসে নার্সারি থেকে। জেলায় মোট নিবন্ধিত নার্সারি রয়েছে ১০৪ টি, নিবন্ধন করা হয়নি এমন নার্সারির সংখ্যা পাঁচ শতাধিক।
সদর উপজেলার চল্লিশা ইউনিয়নের রাজেন্দ্রপুর গ্রামেই রয়েছে বেশ কয়েকটি নার্সারি। নার্সারির জন্যে এ গ্রাম জেলায় বেশ পরিচিত। জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে গাছের চারা সংগ্রহ করার জন্যে এখানে আসেন বৃক্ষপ্রেমীরা। সুন্দরবন, বনফুল, জান্নাতসহ বেশ কয়েকটি নার্সারি রয়েছে এ গ্রামে। জেলা শহর থেকে একদম কাছে হওয়ায় এবং ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে এসব নার্সারিতে প্রতিদিনই বৃক্ষপ্রেমীরা ভিড় জমান।
সুন্দরবন নার্সারির মালিক উদ্যোক্তা মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম বলেন, ‘এটা তাদের একটি পারিবারিক ব্যবসা। ১৯৯৪ সালে তাদের এ নার্সারি প্রতিষ্ঠা করা হয়। তাদের একজন আত্মীয় কৃষি অফিসে চাকরি করতেন, উনার কাছ থেকে পরামর্শ এবং জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে ২৫ কাঠা জমিতে যৌথ উদ্যোগে এ নার্সারি গড়ে তুলেন।’
তিনি জানান, একই পরিমাণ জমিতে ধান চাষ করলে যে মুনাফা হয় তারচেয়ে বেশি মুনাফা হয় নার্সারিতে। এ নার্সারিতে তিনশ ৫০ প্রজাতির দেশি, বিদেশি গাছ রয়েছে, তার মধ্যে আম গাছের ২১ টি, কমলার ৫ টি, মালটার ৪ টি, কাঠালের ২টি জাতসহ বেশ দুর্লভ প্রজাতির গাছ রয়েছে। এছাড়াও ফুলের একশ প্রজাতির গাছ রয়েছে। এখানে তিনজন শ্রমিক কাজ করে থাকনে। ২৫ কাঠা জমির এ নার্সারি থেকে বছরে প্রায় ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা আয় করে থাকেন তারা।
জেলার সদর উপজেলার কয়রাটি গ্রামের জাতীয় পুরষ্কারপ্রাপ্ত মাহাদী নার্সারির স্বত্বাধিকারী উদ্যোক্তা হুমায়ূন আহমেদ জানান, ‘জেলায় গাছের নার্সারির সংখ্যা বাড়ছে, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের কাছে এটা এখন বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও প্রাথমিক সহায়তা পেলে এ পেশার মাধ্যমে বেশ লাভবান হওয়া যায়। যে জমিতে অন্য ফসল করে বছর শেষে মুনাফা বেশি পাওয়া যায় না, সেখানে নার্সারি করে আমি অধিক লাভবান হচ্ছি।
তিনি আরও বলেন, এসব নার্সারি থেকে গাছের চারা পাইকারি দামে ক্রয় করে জেলা, উপজেলা শহরগুলোতে অনেকে খুচরা মূল্যে বিক্রি করে থাকেন, ফলে সৃষ্টি হচ্ছে কর্মসংস্থান এবং একই সাথে দূর দূরান্তের মানুষেরা সহজেই পেয়ে যাচ্ছেন ভালো মানের চারা।
সরকারের নানাবিধ উদ্যোগের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা নার্সারি বৃদ্ধিতে ভূমিকা পালন করছে। বেসরকারি সংস্থা বারসিক’র সহযোগিতায় হাওরের পরিবেশ উন্নয়নে, হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধ, ইউনিয়ন পরিষদ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাওরের রাস্তা, গুচ্ছগ্রাম ও বসতভিটায় এলাকা উপযোগী বনায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করে আসছে। কিন্তু পানি সহনশীল গাছের চারা (হিজল, করচ, বরুণ, তমাল) এলাকায় সহজলভ্য না হওয়ায় বনায়ন করতে গিয়ে অনেক সমস্যার সম্মূখীন হতে হয়েছে। পানি সহনশীল হিজল ও করচ গাছের চারা সুনামগঞ্জ জেলা থেকে সংগ্রহ করতে হয়েছে এবং সেখানেও উপযোগী চারা সহজলভ্য না হওয়ায় সঠিক সময়ে বনায়ন বাধাগ্রস্ত হয়েছে।
বারসিক হাওরের জনগোষ্ঠীর জন্য হাওর এলাকা উপযোগী (পানি সহনশীল) গাছের চারা সহজলভ্যকরণে হাওরাঞ্চলে নার্সারি স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। তারা জেলার হাওরাঞ্চলে ২ টি, পাহাড়ি এলাকায় ২ টি নার্সারিসহ মোট আটটি নার্সারি প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা করেছেন।
নার্সারির সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার প্রসঙ্গে পরিবেশবিদ অহিদুর রহমান বাসসকে জানান, ২০১৫ সালে মাত্র ৩৬ টি নার্সারি ছিলো নেত্রকোনা জেলায়, বর্তমানে জেলার সদর উপজেলাতেই রয়েছে ৩৭ টি নার্সারি। পরিবেশ রক্ষায় সামাজিক আন্দোলন, বৃক্ষমেলার আয়োজন, বেসরকারি, সরকারি প্রতিষ্ঠানের নার্সারি উদ্যোক্তার তৈরি বৃক্ষরোপণে সহায়তা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বৃক্ষরোপণে এবং সামাজিকভাবে সচেতনতায় গাছের চাহিদা বাড়ছে, সাথে সাথে গাছের চাহিদা পূরণের জন্য নার্সারির সংখ্যাও বাড়ছে। "
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মোহাম্মদ নুরুজ্জামান বাসস’কে জানান, 'জেলায় মোট নার্সারি আছে ১০৪ টি, আমরা নার্সারির মালিক যারা আছেন তাদের বিভিন্ন গাছের চারার পরিচর্যা, কলম সংক্রান্ত বিষয় এবং যেভাবে তৈরি চারাগুলোর গুনগত মান ভালো থাকবে এসব বিষয়ে আমরা প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকি।
সরকারি, বেসরকারি ও ব্যক্তিগত পর্যায়ের বৃক্ষরোপণ কর্মসূচিতে ইউক্যালিপটাস ও আকাশমণিগাছের চারা তৈরি ও রোপণ এবং বিক্রয় নিষিদ্ধ করেছে সরকার।
পরিবেশ, প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের স্বার্থে ও জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার পূরণে এ দুটি প্রজাতির গাছের চারা তৈরি, রোপণ এবং বিক্রয় নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
তিনি আরও জানান, 'এ বছর আমাদের ইউক্যালিপটাস এবং আকাশমনি গাছের চারার জন্যে একটি প্রণোদনা প্রোগ্রাম দেওয়া হয়েছিল, সেই হিসেবে আমরা বিশ হাজার ছয়শ চারা ধ্বংস করার জন্যে বিরাশি হাজার চারশ টাকা বরাদ্দ পেয়েছিলাম, এ টাকা দিয়ে কলমাকান্দা উপজেলার তিনটি নার্সারিতে ইউক্যালিপটাস ও মেহগনির চারাগুলো ধ্বংস করা হয়েছে।
আমাদের জেলায় ইউক্যালিপটাস ও আকাশমনির মোট চারার সংখ্যা ছিল আটচল্লিশ হাজার ছয়শ আশিটি। আমরা বাকি চারাগুলো ধ্বংস করার জন্যে বরাদ্দ পাইনি, একটি নির্দেশনা আছে যে পরবর্তী সময়ে বরাদ্দ দেওয়া হবে, আমরা যদি বরাদ্দ পাই তাহলে সেই হিসবে নার্সারির মালিক যারা আছেন, তাঁদের ক্ষতিপূরণ বাবদ সহায়তা দিয়ে এ দুই জাতের গাছের চারাগুলো ধ্বংস করবো। তবে বর্তমানে সরকারের নির্দেশনা মোতাবেক নার্সারিতে এ দুটি গাছের চারা তৈরি এবং বিক্রয় নিষিদ্ধ, আমরা সেগুলো নিয়মিত মনিটরিং করছি যাতে তারা এগুলো উৎপাদন ও বিক্রয় না করেন।"