/ওমর ফারুক/
রাজশাহী, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ (বাসস): রাজশাহী মহানগরীর হোসনিগঞ্জের বেতপট্টি একসময় ছিল শিল্প-সৃজন আর বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র। সময়ের ব্যবধানে এখন সেটি ধুঁকছে অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে। বিকল্প সস্তা পণ্য, কাঁচামালের সংকট, কারিগরদের অনাগ্রহ এবং জায়গা হারানোর শঙ্কা সব মিলিয়ে ঐতিহ্যের এই শিল্প ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। পৃষ্ঠপোষকতা না থাকায় শিল্পটি এখন বিলুপ্তির পথে। দ্রুত সরকারি ও সামাজিক উদ্যোগ না নেওয়া হলে বেতশিল্প কালের গর্ভে হারিয়ে যাবে।
সরজমিনে জানা গেছে, হোসনিগঞ্জ বেত শিল্পের জন্য ব্যাপক মানুষের কাছে সুপরিচিত। প্রথম দিকে ১৫ থেকে ২০টি দোকানে তৈরি হতো দৃষ্টিনন্দন সব বেতের সামগ্রী। ঘর সাজানোর সৌখিন জিনিস থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় আসবাব সবকিছুই পাওয়া যেত এই বাজারে। তখনকার দিনে সিলেট থেকে আসা দক্ষ কারিগররা রাজশাহীতে পাড়ি জমিয়েছিলেন বলে জানা গেছে।
তাদের হাতের কাজ ছিল অসাধারণ। রাজশাহীর মানুষ সেই প্রতিভা দেখে মুগ্ধ হন এবং ধীরে ধীরে নিজেরাও বেতশিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ধীরে ধীরে এই শিল্পই হয়ে ওঠে এ শহরের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অংশ। রাজশাহীর নববধূরা বিয়ের সময় উপহার হিসেবে বেতের তৈরি ট্রে, ঝুড়ি বা চেয়ার পেতেন। এটি তখন এক ধরনের সামাজিক মর্যাদা হিসেবেও বিবেচিত হতো। কিন্তু আজ আর সেই দিন নেই। এক সময়ের জমজমাট বেতপট্টি এখন কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আছে কেবল তিনটি মাত্র দোকান।
হারিয়ে গেছে সেই কর্মচাঞ্চল্য, সেই উৎসবমুখর পরিবেশ।
নগরের হোসনিগঞ্জের বেত শিল্পের কারিগর লিটন শেখের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, প্রথম দিকে এখানে ১৫ থেকে ২০টা দোকান ছিল। আর এখন আছে মাত্র ৩টি। অনেক পণ্য তৈরি হলেও বাজারে আরও কম দামে পণ্য পাওয়া যায়। এ কারণে ক্রেতারা এসব কিনতে এখন আর সেভাবে আগ্রহ দেখায় না। দামের পার্থক্যের কারণে মানুষ বেতের জিনিস কিনতে আগ্রহ হারাচ্ছে। সৌখিনতার কারণে কেউ কিনলেও সেটা এখন ব্যয়বহুল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তিনি আরও বলেন, রাসায়নিকের তৈরি পণ্য আমাদের শিল্পকে মার খাইয়ে দিচ্ছে। মজুরি কম হওয়ায় দক্ষ কারিগররা অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন। একসময় যেখানে ৫০-৬০ জন কারিগর কাজ করতেন এখন এ সংখ্যা অনেক কম।
বেতের পণ্যের দোকানি রহমত বলেন, আগে যখন ব্যবসা করেছি তখন আমার দোকানো ৪/৫ জন কাজ করতো। কিন্ত এখন মাত্র ১ জন রয়েছে। ব্যবসায় টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। সামনের দিনে কি হবে তা বলতে পারছি না।
তিনি আরও বলেন, এখন সহজে বাঁশ পাওয়া যায় না। চট্টগ্রাম-সিলেটের পাহাড়ি অঞ্চল থেকে আনতে হয়। সময়মতো সরবরাহ হয় না। বর্ষাকালে কাদায় আসবাব নষ্ট হয়। সরকারের সহযোগিতা ছাড়া আমাদের সামনে কোনো পথ নেই।
কারিগর আলী আহমেদ বলেন, দৈনিক ৩০০ টাকা মজুরিতে এই শিল্পে টিকে থাকা সম্ভব নয়। একই সময়ে নিরাপত্তাকর্মী বা অটোরিকশা চালিয়েও এর চেয়ে বেশি আয় করা যায়। ফলে অনেকে পেশা পরিবর্তন করছেন। একসময় যেখানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে কারিগররা পারিবারিকভাবে এ শিল্পে যুক্ত থাকতেন, এখন সেই ধারাও ভেঙে যাচ্ছে।
বেতপট্টির ব্যবসায়ী আজহার আলম বলেন, বেত শিল্প টেকাতে হলে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন। এছাড়া সহজ শর্তে ঋণ, কারিগরদের প্রশিক্ষণ এবং বাজার সম্প্রসারণে উদ্যোগ নেওয়া দরকার। হিস্তশিল্প মেলা ও প্রদর্শনীতে হোসনিগঞ্জের বেত পণ্য স্থান পেলে ক্রেতাদের আগ্রহ আবার বাড়তে পারে।
এ বিষয়ে রাজশাহীর জেলা প্রশাসক আফিয়া আক্তার বলেন, বিষয়টি আমাদের জানা ছিল না। আগামীতে সুযোগ হলে পণ্যগুলো প্রদর্শনীর মাধ্যমে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করা হবে।