কক্সবাজার, ২১ অক্টোবর, ২০২৫ (বাসস): শীতকালে ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটো, গাজরসহ নানা সবজিতে ভরে ওঠে গ্রামবাংলা। কিন্তু বাজারে দাম পড়ে গেলে কৃষকের সেই স্বপ্নের সবজিই রূপ নেয় কান্নায়।
সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় নষ্ট হয় বিপুল পরিমাণ সবজি, কৃষক পড়ে যান লোকসানে।
গত মৌসুমে যেমন ফুলকপির দাম নেমেছিল প্রতিটি ২ টাকায়। এই বাস্তবতা বদলাতে কৃষি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে দেশের ৪২টি জেলায় ১০০টি মিনি কোল্ড স্টোরেজ নির্মাণের কাজ চলছে। এর মধ্যে কক্সবাজারেও চারটি হিমাগার চালু হচ্ছে—যা স্থানীয় কৃষকদের মধ্যে আশার সঞ্চার করেছে।
কক্সবাজার সদরে দুটি এবং টেকনাফে দুটি হিমাগার নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে, যা চলতি মাসেই পুরোদমে চালু হবে বলে জানা গেছে।
আজ মঙ্গলবার কক্সবাজার হর্টিকালচার সেন্টারে ফার্মার্স মিনি কোল্ড স্টোরেজ চালু উপলক্ষে এক প্রশিক্ষণ কর্মশালার আয়োজন করা হয়। এতে ক্ষুদ্র কৃষক, উদ্যোক্তা, সাংবাদিক ও কৃষি কর্মকর্তাসহ অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। এতে ফার্মার্স মিনি কোল্ড স্টোরেজের নানা দিক তুলে ধরা হয়।
অনুষ্ঠানে বক্তরা বলেন, দুই দশক আগেও কক্সবাজার ছিল খাদ্য আমদানিনির্ভর এলাকা। কিন্তু এখন চিত্র পাল্টে গেছে। পাহাড় ও সমুদ্রে ঘেরা এ জেলায় এক ফসলি জমি পরিণত হয়েছে চার ফসলি জমিতে। লবণাক্ত জমি জয় করে কৃষকরা ফলাচ্ছেন নানা ফসল—ধান, সবজি, ফল, ফুল। জেলা কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, এখন কক্সবাজার শুধু খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়, বরং প্রতিবছর উদ্বৃত্ত উৎপাদন হচ্ছে।
তবে উৎপাদন বাড়লেও কৃষকের আয় বাড়েনি তেমন। কারণ ফসল উৎপাদন বাড়লেই দাম কমে যায়। এমন পরিস্থিতিতে নতুন প্রযুক্তিনির্ভর ‘ফার্মার্স মিনি কোল্ড স্টোরেজ’ কৃষকদের সামনে নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড অর্থায়নে ‘জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় সাশ্রয়ী কোল্ড স্টোরেজ প্রযুক্তি সম্প্রসারণের মাধ্যমে কৃষকের আয় বৃদ্ধি’ শীর্ষক এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে কৃষি মন্ত্রণালয়। এই মিনি হিমাগারের দুটি মডেল আছে। একটি টিএসসিআর (ঘরভিত্তিক), অন্যটি টিএসসিসি (কনটেইনারভিত্তিক)।
দুটিই সোলার সিস্টেমে চালিত, অর্থাৎ বিদ্যুৎসাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব। তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণে থাকছে সেন্সর, যা মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে সহজেই নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
এতে ৮-১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় কয়েক এক মাসেরও বেশি সময় পর্যন্ত ফল ও সবজি সংরক্ষণ সম্ভব। একটি ঘরভিত্তিক কোল্ড স্টোরেজে রাখা যায় প্রায় ১০ টন পণ্য, নির্মাণ খরচ প্রায় ৫ লাখ টাকা। কনটেইনার মডেলের হিমাগারের খরচ প্রায় ১৫ লাখ টাকা—যা প্রচলিত কোল্ড স্টোরেজের তুলনায় ৭০ শতাংশ কম।
প্রকল্পের পরিচালক তালহা জুবায়ের মাসরুর বলেন, প্রতি শীতেই আমরা দেখি বাজারে সবজির দাম পড়ে যায়, কারণ সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেই। এই মিনি কোল্ড স্টোরেজ সেই ক্ষতি কমাবে। কৃষক ফসল সংরক্ষণ করে ভালো দামে বিক্রি করতে পারবেন, আর ভোক্তারাও পাবেন সাশ্রয়ী দামে তাজা সবজি।
তিনি আরও জানান, প্রয়োজনে কৃষকেরা নিজের বাড়িতেও অল্প খরচে এই হিমাগার তৈরি করতে পারবেন।
আমরা তাদের প্রযুক্তিগত সহায়তা দেব। সোলারভিত্তিক ও অ্যাপ নিয়ন্ত্রিত এই মডেল কৃষিতে নতুন সম্ভাবনা তৈরি করবে।
কক্সবাজার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. বিমল কুমার প্রামানিক বলেন, নানা চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করে কক্সবাজারের কৃষি এগিয়ে গেছে। লবণাক্ত সহনশীল জাতের ধান, সবজি ও ফল উৎপাদনে অনেক অগ্রগতি হয়েছে। এখন মিনি কোল্ড স্টোরেজ যুক্ত হওয়ায় কৃষকের আয় বাড়বে, ফসলের অপচয় কমবে এবং গ্রামীণ অর্থনীতি আরও শক্তিশালী হবে।
প্রশিক্ষণ কর্মশালায় আরও বক্তব্য দেন বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের কক্সবাজার আঞ্চলিক কার্যালয়ের প্রধান ড. মো. ফজলুল ইসলাম, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট কক্সবাজারের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোস্তাক আহমেদ, কক্সবাজার হর্টিকালচার সেন্টারের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ কুতুবউদ্দিন ও কক্সবাজার কৃষক দলের সভাপতি মো. গিয়াস উদ্দিন।