বাসস
  ২০ নভেম্বর ২০২৩, ১৫:০১
আপডেট : ২১ নভেম্বর ২০২৩, ১০:২৯

কানাডিয় টিভিকে ফাঁকি দিয়ে পালালো বঙ্গবন্ধুর খুনী

ঢাকা, ২০ নভেম্বর, ২০২৩ (বাসস): বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সরাসরি গুলি করে হত্যার দায়ে সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামী কানাডার সিবিসি টিভি নেটওয়ার্কের প্রশ্নের মুখে পালিয়ে গেল। কানাডিয় জাতীয় টেলিভিশন হত্যাকান্ডে তার ভূমিকা এবং কানাডিয় কর্মকর্তাদের কাছে নিজের সুরক্ষার জন্য সে যে গল্পটি বলেছিল সেটি সম্পর্কে তার মন্তব্য জানতে চাইছিল।
‘স্যার, আমরা যদি পারতাম। . . . শুধু দ্রুত কিছু কথা বলতে . . . আমি শুধু জানতে চাই যে হত্যাকান্ডে আপনার ভূমিকা সম্পর্কে আপনি কানাডিয়দের সাথে সত্য কথা বলেছেন কিনা,’ একজন সিবিসি টিভি সাংবাদিককে একটি সাদা এসইউভি গাড়িতে থাকা কাউকে জিজ্ঞাসা করতে দেখা যায়, যে গাড়িটি তখন চলতে শুরু করেছে।
লোকটি পলাতক আসামিদের একজন, বরখাস্তকৃত মেজর নূর চৌধুরী। সিবিএস টিভির অনুসন্ধানী সাংবাদিক মার্ক কেলি তাকে এমন একজন হিসেবে বর্ণনা করেছেন যিনি কানাডাকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়েছেন। তিনি গত ২৭ বছর ধরে কানাডায় বসবাস করছেন। সিবিএস টিভি সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে, হত্যাকারীকে বলতে শোনা যায় ‘মাত্র এক সেকেন্ড, মাত্র এক সেকেন্ড, আমার একটি (অস্পষ্ট বিড়বিড়)’ এবং তারপরে সে তাড়াহুড়ো করে গাড়িটি চালিয়ে চলে যায়।
প্রতিবেদনে টরন্টোর একটি অ্যাপার্টমেন্টের বারান্দায় তাকে এক ঝলক দেখানোও হয়েছে।

সেই সময়ে কেলি এবং তার সহকর্মীকে নূরের গাড়ির পিছনে তাকে থামাতে এবং কথা বলতে রাজি করাতে কয়েক পা ছুটে যেতে দেখা যায়। তারপর উপস্থাপক মন্তব্য করেন ‘কানাডায় ২৭ বছর অবাধে বসবাস করার পরে মনে হয় তার আর নতুন কিছু বলার নেই।’
বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভ করে আবার ক্ষমতায় আসার পর ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের চক্রান্তকারীদের বেশিরভাগ দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়। তখন পর্যন্ত তারা একটি কুখ্যাত ইনডেমনিটি আইনের কারণে বিচার থেকে রেহাই পেয়ে আসছিল।
নূর কানাডায় আশ্রয় নিয়ে সেখানে নিরিবিলি জীবনযাপন করছে। বছরের পর বছর ধরে তার হদিস অজানাই ছিল।
সিবিএস টিভির জনপ্রিয় অনুসন্ধানী বিভাগ দ্য ফিফথ স্টেট দু'দিন আগে ‘অ্যাসাসিন নেক্সট ডোর বা খুনী পাশের ঘরে’ শিরোনামে ৪২ মিনিটের তথ্যচিত্রটি সম্প্রচার করে, যেখানে প্রশ্ন ছিল ‘কেন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতির হত্যাকারী কানাডায় মুক্ত?’
আওয়ামী লীগ ২১ বছর ধরে রাজনৈতিক ঝড় ঝাপটা পেরিয়ে ক্ষমতায় ফিরে হত্যাকারীদের বিচারের মুখোমুখি করার জন্য ইনডেমনিটি আইন বাতিল করে। দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়া শেষে নূর এবং অন্যান্য ১১ বরখাস্তকৃত সামরিক কর্মকর্তাকে মৃত্যুদ- দেওয়া হয়। এদের মধ্যে এ পর্যন্ত ছয়জনের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে।
বাকিরা বিদেশে পলাতক রয়েছে। সরকার পরে নিশ্চিত করেছে যে তাদের মধ্যে একজনের জিম্বাবুয়েতে আত্মগোপনে থাকার সময় স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে।
বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ বরখাস্ত হওয়া আরেক আসামি মেজর রাশেদ চৌধুরীর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমান আবাস নিশ্চিত করতে পেরেছে। ইন্টারপোল পলাতকদের খুঁজে বের করার প্রচেষ্টার অংশ হিসাবে রেড অ্যালার্ট জারি করেছে।
কয়েক বছর আগে কানাডিয় টিভি নেটওয়ার্ককে দেওয়া এক মন্তব্যে নূর অবশ্য বলেছিল, পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যসহ বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার সময় সে সেখানে ছিল না। ‘এটি সত্য নয়, আমি সেখানে ছিলাম না। আমি সেই জায়গার কাছাকাছি কোথাও ছিলাম না,’ টিভি পর্দায় তার ব্যক্তিগত উপস্থিতি এড়িয়ে এক অডিও মন্তব্যে সে এ কথা বলেছিল।
তথ্যচিত্রটির নির্মাতা কেলি বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার সংশ্লিষ্ট মূল ব্যক্তিদের সাথে কথা বলেছেন এবং বঙ্গবন্ধুকন্যাসহ তারা সবাই নূরের এই দাবিকে নাকচ করে দিয়েছেন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নূরের দাবিকে একটি ‘চরম মিথ্যাচার’ বলে বর্ণনা করেছেন।
বর্তমান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক যিনি তার আইনজীবী বাবা সিরাজুল হকের সাথে বিচার প্রক্রিয়ার একজন প্রধান আইনজীবী ছিলেন, মামলার প্রধান পুলিশ তদন্তকারী আব্দুল কাহহার আকন্দ এবং মামলার নথি সংরক্ষণকারী বর্তমান সিআইডি প্রধানও নূরের বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করেছেন।
তারা বলেছেন যে তার সাথে অভিযুক্ত বেশিরভাগ যারা ব্যক্তিগতভাবে বিচারের মুখোমুখি হয়েছিল তারা তদন্ত প্রক্রিয়া চলাকালে নূরের ভূমিকা বর্ণনা করেছে।
প্রত্যর্পণ সমস্যা:
তথ্যচিত্রটি মূলত নূরের প্রত্যর্পণের বিষয়টিকেই গুরুত্ব দিয়েছে এবং এতে  দেখা গেছে ২০০২ সালে কানাডিয়ান ইমিগ্রেশন অ্যান্ড রিফিউজি বোর্ড (আইআরবি) রায় দিয়েছিল যে সে ‘বিচার থেকে পলাতক’ ছিল এবং তার অজুহাত ‘একেবারেই অবিশ্বাস্য’।

তথ্যচিত্রে কানাডার তৎকালীন জননিরাপত্তা বিষয়ক মন্ত্রী স্টকওয়েল ডে বলেছেন, তিনি নূরের ফাইলটি পর্যালোচনা করেছেন এবং দৃঢ়ভাবে উপলদ্ধি করেছেন যে ‘তার এখানে (কানাডায়) থাকা উচিত নয়’ এবং তারপরে তার অফিস বাংলাদেশে তাকে ফেরত পাঠানোর জন্যে আইআরবি’র সিদ্ধান্তকে সমর্থন করে কানাডার আদালতে যায়। 
আইনি প্রক্রিয়া অনুযায়ী নূরকে দেশে ফিরতে হবে বলে সিদ্ধান্ত হয়।
তথ্যচিত্রটির উপস্থাপকের মন্তব্যে বলা হয়, ‘কিন্তু (নূর) চৌধুরীর একটি শেষ উপায় ছিল। পাঁচ বছর আগে সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছিল যে কানাডা থেকে মৃত্যু বা নির্যাতনের মুখোমুখি হওয়া কাউকে দেশে ফেরত পাঠানোটা অধিকার সনদের লঙ্ঘন।’
উপস্থাপক মন্তব্যে আরো বলেন, নূর এই রায়ের সুযোগ নিয়েছে। সে বলেছে প্রত্যাপণ হলে তার সাথে ঠিক তাই  ঘটবে। বাংলাদেশকে তার আইনগত অবস্থা জানতে কানাডার ফেডারেল আদালতে যেতে হয়েছে, যেখানে আদালত ‘কানাডাকে তার অবস্থান পুনর্বিবেচনার নির্দেশ দিয়েছে’।
কানাডিয় সরকার তখন বাংলাদেশকে জানিয়েছিল যে ‘নূর চৌধুরী সম্পর্কিত তথ্য প্রকাশে বাংলাদেশের কিছু সুবিধা থাকতে পারে, তবে এই সুবিধাগুলো মৃত্যুদন্ডের বিষয়ে কানাডার অবস্থানের ওপর অগ্রাধিকার পাবে না।’
উপস্থাপক রায়টি পর্যালোচনা করে মন্তব্য করে বলেন, ‘(কিন্তু) সেই অবস্থানের একটি গুরুত্বপূর্ণ ফাঁক রয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছে যে ব্যতিক্রমী পরিস্থিতিতে লোকেদের তাদের মৃত্যুর জন্যও পাঠানো যেতে পারে।’
কেলি আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আইনের বিশেষজ্ঞ ডালহৌসি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের একজন সিনিয়র অধ্যাপক রবন কুরির সাক্ষাৎকার নিয়েছেন, যিনি বলেন, ‘আইনের এই ক্ষেত্রে, এটি সম্ভবত সবচেয়ে রহস্যময় বাক্যাংশ।’
কুরি বলেন, যখন আদালত প্রথম এই বাক্যাংশটি প্রণয়ন করেছিল, ‘কিছু লোক একে বিন লাদেন ধারা বলেছিল, যার অর্থ যদি ওসামা বিন লাদেনের মতো কেউ কানাডায় উপস্থিত হয়, আমরা মৃত্যুদন্ডের প্রতি আমাদের ঘৃণা কাটিয়ে উঠব এবং বলব যে বৃহত্তর ন্যায়বিচারের স্বার্থে এই ব্যক্তিকে প্রত্যর্পণ বা নির্বাসিত করা উচিত।’
আইনের এই অধ্যাপক বলেন, নূর কানাডায় থাকায় কানাডা অস্বস্তিকর অবস্থায় রয়েছে বলে তিনি মনে করেন।
উপস্থাপক শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে একটি প্রশ্ন উত্থাপন করে বলেছেন, যদি কেউ ‘একজন বিশ্বনেতা এবং তার পরিবারের ১০ বছরের একটি শিশু (বঙ্গবন্ধুর পুত্র শেখ রাসেল) সহ ২১ জন সদস্যের হত্যাকান্ডে অংশ নেয় তাহলে সেটি কি ‘ব্যতিক্রমী পরিস্থিতি’ নয়? এবং তিনি আরো বলেন, “এটি এমন একটি ধারা যা আগে কখনও পরীক্ষা করা হয়নি।’
কানাডায় বাংলাদেশের হাইকমিশনার খলিলুর রহমান উপস্থাপককে বলেন, ঢাকা কানাডিয় কর্তৃপক্ষকে তাদের সুপ্রিম কোর্টে মামলাটি নিতে বলেছে এবং ‘আপনাদের সুপ্রিম কোর্ট যদি বলে যে না, তাকে প্রত্যার্পণ করা যাবে না, আমরা মেনে নেব। তখন আমরা অন্য বিকল্প নিয়ে কাজ করবো।’
বাংলাদেশ এখন কেন অন্য বিকল্প নিয়ে কাজ করছে না জানতে চাইলে দৃশ্যত হতাশ রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘তারা (কানাডিয়ান কর্তৃপক্ষ) কথা বলছে না।’
রহমান বলেন, ‘আমাদের কথা বলতে হবে, সংলাপ দরকার।’
আইনের অধ্যাপক কুরি কানাডিয়ান কর্তৃপক্ষের নীরবতাকে ‘অনুপস্থিত বিষয়’ বলে অভিহিত করেন।
কানাডার প্রাক্তন জননিরাপত্তা মন্ত্রীর কাছে ফিরে গিয়ে, উপস্থাপক জানতে চান কানাডা কি একজন হন্তারকের আশ্রয়স্থল হিসেবে ভূমিকা রাখছে না মানবাধিকার সমুন্নত রাখছে।
জবাবে স্টকওয়েল ডে বলেন, ‘তিনি (নূর) যা করেছেন তার জন্য তিনি দায়বদ্ধ এবং আমাদের বাংলাদেশের সাথে আলোচনা করা উচিত যে আমরা কীভাবে তাকে এখান থেকে বের করে এনে বাংলাদেশের মানুষের হাতে ফিরিয়ে দিতে পারি, কানাডা এই বলে এক ‘নৈতিক উচ্চতায়’ দাঁড়াতে পারে।’ 

তথ্যচিত্রে তখন দেখানো হয় যে নুর তার অ্যাপার্টমেন্টের বারান্দায় বাগানে কাজ করছে যখন উপস্থাপক মন্তব্য করছেন “কূটনৈতিক বিতর্ক থেকে দূরে, নূর চৌধুরী তার নিরিবিলি জীবন চালিয়ে যাচ্ছে”।
কেলি এবং তার টিভি ক্রু তখন দৃশ্যত নূরকে নিচে নামতে এবং তার সাদা এসইউভি গাড়িতে উঠার সময় তাকে প্রশ্ন করার জন্য অপেক্ষা করছিলের, যা সে এড়িয়ে গিয়ে দ্রুত চলে গেল।
উপস্থাপককে তারপর আইনমন্ত্রী হকের ঢাকার বাসভবনে দেখা গেল, যিনি পূর্বে বাংলাদেশের জাতির পিতাকে হত্যার জন্য নূরের অনুপস্থিতিতে তার বিচারের জন্য একজন আইনজীবী হিসেবে দাঁড়িয়েছিলেন এবং এখন আইনমন্ত্রী হিসেবে তার প্রত্যর্পণের জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।
কেলি তাকে জিজ্ঞাসা করেন, তিনি কি বিশ্বাস করেন যে নূর খুন করে পালিয়ে গেছে এবং মুহূর্তের বিরতির পরে, হকের উত্তর, ‘এখনো পর্যন্ত হ্যাঁ . . . তবে আমরা এর শেষ দেখে ছাড়বো।’