উলবাকিয়া মশা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশে নতুন সম্ভাবনার সৃষ্টি করেছে

বাসস
প্রকাশ: ০৭ মে ২০২৫, ১৯:৪৭
প্রতীকী ছবি

ঢাকা, ৪ মে, ২০২৫ (বাসস): ডেঙ্গু মোকাবেলায় একটি বড় বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি বাংলাদেশের জন্য নতুন আশার আলো জাগাচ্ছে। আন্তর্জাতিক গবেষকদের একটি দল এক ধরনের উলবাকিয়া- সংক্রমিত এডিস ইজিপ্টি মশা সফলভাবে তৈরি করেছেন, যেটি ঢাকা শহরের স্থানীয় পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম এটিকে ভালো মশা হিসেবেও অভিহিত করা হয়ে থাকে। 

এই আশাব্যঞ্জক অগ্রগতি বাংলাদেশকে ডেঙ্গু এবং অন্যান্য মশাবাহিত বা আর্বোভাইরাল ভাইরাস সংক্রমণ রোগের বিস্তার নিয়ন্ত্রণে একটি নিরাপদ ও জৈবিক পদ্ধতি ব্যবহারের নতুন দ্বার উন্মোচন করছে। 

সম্প্রতি মর্যাদাপূর্ণ জার্নাল দ্য নেচারের সায়েন্টিফিক রিপোর্টস-এ প্রকাশিত গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। 

এই গবেষণা দলে রয়েছে অস্ট্রেলিয়ার কিউআইএমআর বার্গহোফার মেডিকেল রিসার্চ ইনস্টিটিউট (কিউআইএমআরবি), কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়, আইসিডিডিআর,বি ও যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার্স ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি)’র বিজ্ঞানীরা। 

বর্তমানে বাংলাদেশে ডেঙ্গু একটি গুরুতর জনস্বাস্থ্য হুমকি, ২০২৩ সালে রেকর্ড সংখ্যক ৩ লাখ ২১ হাজারের বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছে ও ১ হাজার ৭০০ এর বেশি মৃত্যু হয়েছে, যা এখন পর্যন্ত ইতিহাসে সবচেয়ে প্রাণঘাতী বছর। 

নগরায়ণ, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত ও উষ্ণ তাপমাত্রা ডেঙ্গুর প্রাথমিক বাহক এডিস মশার বিস্তারকে বাড়িয়ে তুলছে। অন্যদিকে, প্রচলিত কীটনাশক-নির্ভর মশা নিয়ন্ত্রণে মশাদের মধ্যে কীটনাশকের প্রতিরোধ ক্ষমতা বেড়ে যাওয়ায় এর কার্যকারিতা কমে যাচ্ছে। 

এ জন্য পৃথিবীব্যাপী বিজ্ঞানীরা আরও টেকসই সমাধান খুঁজতে শুরু করেছেন যার মধ্যে অন্যতম ‘ভালো মশা’ ব্যবহারের কৌশল।

উলবাকিয়া ব্যবহারের কারণ হলো, এটি এডিস মশায় ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও জিকা ভাইরাসের সংক্রমণ রোধ করে। কিন্তু এটি মানুষ বা পরিবেশের কোনো ক্ষতি করে না। 

উলবাকিয়া একটি প্রাকৃতিক ব্যাকটেরিয়া- যা প্রজাপতি, ফলের মাছি ও কিছু মশার দেহে স্বাভাবিকভাবেই থাকে। কিন্তু এডিস মশায় এটা থাকে না। এই ব্যাকটেরিয়া মানুষ বা প্রাণীকে সংক্রমিত করতে পারে না এবং কামড় বা সংস্পর্শের মাধ্যমেও এটি ছড়ায় না।

এডিস মশায় উলবাকিয়া প্রবেশ করিয়ে দুটি কৌশলে মশাবাহিত ভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। 
প্রথমটি হলো- দমন কৌশল, যেখানে শুধু পুরুষ উলবাকিয়া মশা বা ‘ভালো মশা’ পরিবেশে ছাড়া হয়। এই পুরুষরা স্ত্রী মশার সঙ্গে মিলিত হয়, স্ত্রী মশার ডিম ফোটে না-ফলে মশার সংখ্যা কমে যায়। 

দ্বিতীয়টি হলো- প্রতিস্থাপন কৌশল, যেখানে পুরুষ ও স্ত্রী উভয় ‘ভালো মশা’ ছাড়া হয় এবং উলবাকিয়া-আক্রান্ত স্ত্রী মশারা প্রজন্মের পর প্রজন্মে এই ব্যাকটেরিয়া বয়ে বেড়ায় ও ছড়িয়ে দেয়। তারা উলবাকিয়া আক্রান্ত বা আক্রান্ত নয় এমন পুরুষদের সঙ্গে মিলিত হলেও তাদের বংশধর উলবাকিয়া বহন করে এবং এভাবে শেষ পর্যন্ত বন্য মশাদের প্রতিস্থাপন করে। 

এই দুটি কৌশলই বিভিন্ন দেশে উল্লেখযোগ্য সফলতা অর্জন করেছে।

অস্ট্রেলিয়ার উত্তর কুইন্সল্যান্ডে প্রতিস্থাপন কৌশল ব্যবহার করে গত এক দশকে ডেঙ্গু রোগ ৯৬ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। ইন্দোনেশিয়া, ব্রাজিল, কলম্বিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও যুক্তরাষ্ট্রেও মশা কমানোর পরীক্ষায় ৯৫ শতাংশ পর্যন্ত সফলতা দেখা গেছে।

এই নতুন গবেষণায় উলবাকিয়া স্ট্রেইন ব্যবহার করা হয়েছে, যা ঢাকার উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়ার উপযোগী। গবেষকরা প্রথমে অস্ট্রেলিয়ার কিউআইএমআরবি-এ সংরক্ষিত উলবাকিয়া-যুক্ত কুইন্সল্যান্ডের এডিস ইজিপ্টি স্ট্রেইনকে ঢাকা থেকে সংগ্রহ করা বন্য মশার সাথে সংকরায়ণ করেন। একাধিক প্রজন্মের প্রজননের মাধ্যমে তারা একটি ‘ভালো মশা’ স্ট্রেইন তৈরি করেছেন, যা নির্ভরযোগ্যভাবে তাদের ডিমের মাধ্যমে পরবর্তী প্রজন্মে উলবাকিয়া স্থানান্তর করতে সক্ষম।

গবেষণা দলটি ‘ভালো মশা’ স্ট্রেইনের ডেঙ্গু প্রতিরোধ ক্ষমতা মূল্যায়ন করেছে। ফলাফলে দেখা গেছে, উলবাকিয়া-যুক্ত এই মশাগুলো উলবাকিয়া-বিহীন সাধারণ মশার তুলনায় ডেঙ্গু ভাইরাস সংক্রমণের ক্ষমতা ৯২ দশমিক ৭ শতাংশ কমিয়ে দিতে সক্ষম। গবেষকরা পরীক্ষাগারের খাঁচায় আবদ্ধ অবস্থায় এই মশাগুলোর বিভিন্ন দিকও পরিমাপ করেছেন, যেমন প্রজননক্ষমতা (ডিমের সংখ্যা), উর্বরতা (ডিম ফুটে বাচ্চা হওয়ার হার) ও টিকে থাকার ক্ষমতা (২৮ দিন পর মৃত মশার অনুপাত)। 

দেখা গেছে, ঢাকার জন্য অভিযোজিত এই ‘ভালো মশা’গুলো টিকে থাকা ও প্রজননের ক্ষেত্রে স্থানীয় মশাগুলোর সমান সক্ষম, যা পরিবেশে এদেরকে ছেড়ে দেয়ার জন্য উপযুক্ত করে তোলে।

আইসিডিডিআর,বি’র বিজ্ঞানী ড. মোহাম্মদ শফিউল আলম বলেন, ‘পরিবেশে মশা ছেড়ে দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই উদ্বেগ থাকতে পারে, কিন্তু এগুলো জেনেটিক্যালি পরিবর্তিত নয়। এগুলো হলো ‘ভালো মশা’, যাদের দেহে থাকে প্রাকৃতিক ব্যাকটেরিয়া। 

গবেষণায় দেখা গেছে এটি ক্ষতিকর নয়, বরং উপকারী। উলবাকিয়া অনেক দেশেই নিরাপদে ব্যবহার হয়েছে এবং এটি ডেঙ্গু ও অনুরূপ ভাইরাসের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জন্য নতুন একটি প্রতিরক্ষার পথ খুলে দিতে পারে।’

ডেঙ্গু ছাড়াও, এই ‘ভালো মশা’ অন্যান্য উদ্ভবশীল ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হতে পারে। উলবাকিয়া জিকা ও চিকুনগুনিয়া ভাইরাসের সংক্রমণও প্রতিরোধ করতে সক্ষম বলে প্রমাণ রয়েছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
ছাত্রদলের উদ্যোগে সারাদেশে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি অব্যাহত
প্রবাসী বাংলাদেশিদের উন্নয়নে ৫ দেশে স্থাপিত হবে নতুন মিশন : উপদেষ্টা আসিফ
বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত
করোনা সংক্রমণ রোধে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সতর্কতামূলক ব্যবস্থা
শ্রীলংকার বিপক্ষে টস জিতে ব্যাটিংয়ে বাংলাদেশ
ভয়াবহ বায়ু দূষণের শিকার নারী ও শিশুরা
মাতৃভাষায় সাংবাদিকতা বিস্তারে ভূমিকা রাখতে সার্ক দেশগুলোর প্রতি আহ্বান
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীদের এআই জেনারেটেড ডিপফেক ভিডিও এড়িয়ে চলার অনুরোধ
মোস্তফা মোহসীন মন্টু’র দাফন সম্পন্ন : কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন
সারা দেশে পুলিশের বিশেষ অভিযানে গ্রেফতার ১৬৩৬ জন
১০