
ঢাকা, ১৭ নভেম্বর, ২০২৫ (বাসস): চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান দমনে পরিচালিত মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় ট্রাইব্যুনালের প্রথম রায় আজ ঘোষণা করা হবে।
এটি হলো জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের সময়ে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে করা মামলার রায়।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ ুএর এজলাস থেকে রায় ঘোষণার কার্যক্রম সরাসরি সম্প্রচার করার কথা রয়েছে। গণ-অভ্যুত্থানের সময় হত্যাকাণ্ডসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় করা এটিই প্রথম মামলা, যার রায় কিছু সময় পরেই ঘোষিত হতে যাচ্ছে।
বিচারপতি গোলাম মর্তুূজা মজুমদারের নেতৃত্বে ট্রাইব্যুনাল-১ এ তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেল আজ এই মামলার রায় ঘোষণা করবেন। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
এই মামলার শুনানিতে প্রসিকিউশন বলেছেন যে শেখ হাসিনা ছিলেন জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী সব ধরনের অপরাধের মাস্টারমাইন্ড (মূল পরিকল্পনাকারী), হুকুমদাতা ও সুপিরিয়র কমান্ডার (সর্বোচ্চ নির্দেশদাতা)।
চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশাপাশি এই মামলার অন্য দুই আসামি হলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। তিন আসামির মধ্যে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান পলাতক। দুজনই এখন ভারতে অবস্থান করছেন।
এই মামলায় গ্রেফতার থাকা একমাত্র আসামি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন নিজের দোষ স্বীকার করে ‘অ্যাপ্রুভার’ বা রাজসাক্ষী হিসেবে ট্রাইব্যুনালে জবানবন্দি দিয়েছেন। তিনি জবানবন্দিতে বলেছেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমনে সরাসরি ‘লেথাল উইপন’ (মারণাস্ত্র) ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত বছরের ১৮ জুলাই শেখ হাসিনার ওই নির্দেশনা তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের মাধ্যমে পেয়েছিলেন তিনি।
এ মামলার তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয় যে শেখ হাসিনার নির্দেশে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে মারণাস্ত্র ব্যবহার করে নিরীহ, নিরস্ত্র দেড় হাজার ছাত্র-জনতাকে হত্যা এবং ৩০ হাজার মানুষকে আহত করা হয়েছিল।
শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামানের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড চেয়েছে প্রসিকিউশন। একই সঙ্গে তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে জুলাইয়ে শহীদ হওয়া পরিবারগুলোর পাশাপাশি আহত জুলাই যোদ্ধাদের মধ্যে হস্তান্তর করতে প্রসিকিউশন আবেদন পেশ করেন। এ ছাড়া প্রসিকিউশন মনে করে, সাবেক আইজিপি মামুন ‘অ্যাপ্রুভার’ হিসেবে ঘটনার পূর্ণ সত্য প্রকাশ করেছেন এবং তার বিষয়ে ট্রাইব্যুনাল যথাযথ আদেশ দেবেন। অন্যদিকে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামানের খালাস চেয়েছেন তাদের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী।
গণ-অভ্যুত্থানে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়। পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালে প্রথম মামলার কার্যক্রম শুরু হয় গত বছরের ১৭ অক্টোবর। সেদিন শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে প্রথম মামলা (মিসকেস বা বিবিধ মামলা) হয়। একই দিনে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে ট্রাইব্যুনাল।
এ মামলায় প্রথমে শেখ হাসিনাই ছিলেন একমাত্র আসামি। এরপর চলতি বছরের ১৬ মার্চ শেখ হাসিনার পাশাপাশি সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকেও এ মামলায় আসামি করা হয়। একাধিকবার সময় বাড়ানোর পর চলতি বছরের ১২ মে এই মামলায় চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। এ মামলায় আসামি হিসেবে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের নাম আসে তদন্ত প্রতিবেদনে। এরপর এ মামলায় আসামি হন তিনজন- শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান ও চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন।
শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে গত ১ জুন ট্রাইব্যুনালে ফরমাল চার্জ বা আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে প্রসিকিউশন।
ফরমাল চার্জ দাখিলের মাধ্যমে ‘মিসকেস’ আনুষ্ঠানিকভাবে মামলায় রূপ নেয়। এ মামলায় গত ১০ জুলাই আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল। সেদিনই সাবেক আইজিপি মামুন ‘অ্যাপ্রুভার’ (রাজসাক্ষী) হওয়ার আবেদন করেন।
‘মিসকেস’ থেকে এ মামলার রায় ঘোষণা পর্যন্ত সময় লেগেছে ৩৯৭ দিন। গত ৩ আগস্ট এ মামলায় সূচনা বক্তব্য উপস্থাপন করেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। এর মধ্য দিয়ে এ মামলার আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হয়। সূচনা বক্তব্য টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। সূচনা বক্তব্যের পর এই মামলায় প্রথম সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দেন জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে গুরুতর আহত হওয়া খোকন চন্দ্র বর্মণ। তার সাক্ষ্য গ্রহণের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হয়।
এ মামলায় জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামসহ মোট ৫৪ জন সাক্ষী সাক্ষ্য দেন। সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয় গত ৮ অক্টোবর। এরপর যুক্তিতর্ক শুরু হয় গত ১২ অক্টোবর, যা শেষ হয় ২৩ অক্টোবর। সর্বশেষ ১৩ নভেম্বর ট্রাইব্যুনাল মামলার রায় ঘোষণার দিন ধার্য করে। আজ ১৭ নভেম্বর এ মামলার রায় ঘোষণা করা হবে।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০১০ সালের ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল যাত্রা শুরু করে। এই ট্রাইব্যুনালে মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার হয়। বিচার কার্যক্রমকে আরও গতিশীল করতে ২০১২ সালের ২২ মার্চ আরও একটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছিল বিগত সরকার।
ট্রাইব্যুনাল-১ থেকে ৪৪টি ও ট্রাইব্যুনাল-২ থেকে এখন পর্যন্ত ১১টি মামলার রায় এসেছে। ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর সব আইনি প্রক্রিয়া শেষে মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ছয় জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। তখন ওই বিচারিক প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে বিভিন্ন মহলের প্রশ্ন ছিল। ওইসময় সাক্ষী গুম হওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে।
চব্বিশের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত হত্যাকাণ্ডসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার হচ্ছে। পাশাপাশি আওয়ামী লীগের শাসনামলে গুম ও হত্যার ঘটনায় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারও চলছে।