
বরুন কুমার দাশ ও আব্দুর রউফ
ঢাকা, ১৬ নভেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : কানের ময়লা পরিষ্কার করার জন্য কটন বাডসহ যথেচ্ছ বস্তুর ব্যবহার, সামান্য ঠাণ্ডা-সর্দিকে গুরুত্ব না দেওয়া এবং অসচেতনতা দেশে নাক-কান-গলার রোগ বাড়িয়ে তুলছে। সাধারণ সর্দি-কাশি থেকেও শিশুদের কানের পর্দা ছিদ্র হয়ে বধিরতা, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে ব্রেইন ইনফেকশন বা মস্তিষ্কে ফোঁড়া পর্যন্ত হতে পারে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের নাক, কান ও গলা (ইএনটি) বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ডা. মো. আসাদুর রহমান বাসসকে দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন ।
তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশের মানুষ অসচেতন ও দরিদ্র হওয়ার কারণে প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসা নিতে পারে না। ফলে নাক, কান ও গলার মতো রোগগুলো জটিল আকার ধারণ করছে।’
দেশে ইএনটি রোগীর সংখ্যা কেন বাড়ছে? এমন প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক ডা. আসাদুর রহমান বলেন, ‘আমাদের দেশের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ গরীব, অসচেতন। এই অসচেতনতা এবং দরিদ্রতার কারণে আমাদের শরীরে অনেক রোগ আমরা প্রাথমিক পর্যায়ে বুঝতে পারি না। প্রাথমিক পর্যায়ে বুঝতে না পারলে এটা যখন খারাপ অবস্থায় চলে আসে, তখন আমাদের কিছু করারও থাকে না।’
কানের যত্ন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘কান আমাদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের একটা অংশ। যে কানে শুনে না, সে-ই জানে কানে শোনার মূল্য কতটুুকু। আমরা অনেক সময় দেখি মানুষ হাতের কাছে যা কিছু পায়, তাই দিয়ে কান চুলকাতে থাকে, কানের ময়লা পরিষ্কার করতে থাকে। মূলত, আমাদের শরীরের এই অংশটা (কান) এমন গঠনে সৃষ্টি করা হয়েছে যাতে কানের ময়লা নিজে নিজেই বের হয়ে যায়। এটি বের করার জন্য কোন কিছুর প্রয়োজন পড়ে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘স্বাভাবিকতার বাইরে কিছু ব্যতিক্রম রয়েছে। সবার কান একরকম নয়। কিছু মানুষের কানের গঠন এমন হয় যে, তাদের কানের ময়লা সহজে বের হয় না। এই সংখ্যাটা খুব কম। ১০০ জনের মধ্যে প্রায় চার-পাঁচজনের ক্ষেত্রে এমনটা দেখা যায়। এমন হলে নিজে খোঁচাখুঁচি না করে ভালো একজন চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত। কারণ কানের ভেতরের চামড়া খুব পাতলা, সামান্য একটু খোঁচায় সেটি ছিঁড়ে যেতে পারে। চামড়া ক্ষতির ফলে সেখানে যদি ইনফেকশন হয়, তখন সমস্যাটা আরও অনেক বেড়ে যায়।’
শিশুদের কানের সমস্যা নিয়ে ডা. আসাদুর রহমান বলেন, ‘বাচ্চাদের খুব ঘন ঘন ঠাণ্ডা-সর্দি লাগে। একটা বাচ্চার বছরে কমপক্ষে চার থেকে পাঁচবার এ সমস্যা হয়। আর এ থেকে কানে জটিলতা দেখা দিতে পারে। সাধারণত এটি একটি ভাইরাসজনিত রোগ। এটি চিকিৎসা করলেও সাত দিনে ভালো হয়, না করলেও সাত দিনেই ভালো হয়ে যায়। তবে চিকিৎসা নিলে উপসর্গগুলো অনেক কমে আসে। কারণ, নাক আর কানের মধ্যে একটা সরু পথ আছে। যখন নাকে সর্দি জমে, তখন এই পথটা বন্ধ হয়ে যায়। ফলে কানে ব্যথা হয়, পুঁজ জমে। কখনো কখনো কানের পর্দা ছিদ্র হয়ে পুঁজ বা পানি বের হয়-যেটাকে আমরা ‘কান পচা রোগ’ বলি।’
নাক, কান ও গলার বিষয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘অনেকে ভাবে এটি নিজে নিজেই ভালো হয়ে যাবে। কিন্তু যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, বিশেষ করে ছোট বাচ্চা, বয়স্ক মানুষ কিংবা ডায়াবেটিস রোগীর ক্ষেত্রে এই সর্দি থেকেই কানের পর্দা ছিদ্র হতে পারে। এমনকি কানের ইনফেকশন থেকে ব্রেইনে ফোঁড়া পর্যন্ত হতে পারে, যা জীবনহানির ঝুঁকি তৈরি করে। তাই নাক বা কানে সামান্য সমস্যা হলেও অবহেলা না করে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।’
জন্মগত বধির শিশুদের চিকিৎসায় কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট সম্পর্কে ডা. আসাদুর রহমান বলেন, ‘যেসব শিশু জন্ম থেকেই বধির এবং হেয়ারিং এইড দিয়েও শুনতে পারে না, তাদের ক্ষেত্রে আমরা ‘কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট’ করে থাকি। বাংলাদেশে এই অস্ত্রোপচার বেশ কয়েক বছর ধরে চলছে। মাঝখানে কিছুদিন বন্ধ থাকলেও, গত ১০ নভেম্বর থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে পুনরায় আমরা এই অপারেশন চালু করেছি। অপারেশনে প্রয়োজনীয় যন্ত্রটি বিনামূল্যে সরবরাহ করে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়। শর্ত হলো, পাঁচ বছরের নিচে যেসব শিশু হেয়ারিং এইড দিয়ে শুনবে না এবং যারা দরিদ্র পরিবারের, তাদের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে এই অপারেশন করা হবে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক), বাংলাদেশ মেডিকেল ইউনিভার্সিটি (বিএমইউ), জাতীয় নাক, কান ও গলা ইন্সটিটিউট (ইএনটি)-এর যে কোন একটিতে বিনামূল্যে এই সেবা পাওয়া যাবে।’
সারাদেশে নাক-কান-গলার চিকিৎসা পর্যাপ্ত কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এটা অনেকটা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মতো। আগে ২ লেনের রাস্তা থাকাকালীন তীব্র যানজট হতো। পরে যখন রাস্তা চার লেনের হলো, তখন দেখা গেলো আরও চার লেন বাড়িয়ে আট লেন করা দরকার। ঠিক তেমনি আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা যতটা উন্নত হয়েছে, জনগণের চাহিদা তার চেয়ে অনেক বেশি বেড়েছে। এখন দেশের প্রায় প্রতিটি উপজেলাতেই নাক-কান-গলার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছেন, এতে রোগ শনাক্তের সুযোগ বেড়েছে। তাই মনে হচ্ছে রোগীর সংখ্যা বেড়ে গেছে। তবে সত্যি কথা হলো, রোগীর তুলনায় এখনো আমাদের দেশে ইএনটি’র পর্যাপ্ত চিকিৎসক নেই।’
এ সময় দেশে বিশেষায়িত হাসপাতালের ঘাটতি নিয়ে ঢামেকের এই অধ্যাপক বলেন, ‘ঢাকায় শুধু একটিমাত্র সরকারি এবং কিছু বেসরকারি নাক-কান-গলার বিশেষায়িত হাসপাতাল আছে। চট্টগ্রাম বা বরিশাল বিভাগের শহরগুলোতে এখনো এমন কোনো হাসপাতাল নেই। এখন যদি কোনো রোগীর কানের সমস্যা এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যেখানে তার ব্রেইনে ফোঁড়া হওয়ার সম্ভাবনা আছে। এ অবস্থায় তাকে দিনাজপুর থেকে ঢাকায় আসতে হবে, এটা সবসময় সম্ভব না-ও হতে পারে। তাই আমি মনে করি, প্রতিটি বিভাগীয় শহরে অতিসত্ত্বর নাক-কান-গলার বিশেষায়িত হাসপাতাল তৈরি করা উচিত।’
চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ ঘাটতির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের চিকিৎসকদের সরকারিভাবে বাইরে প্রশিক্ষণের সুযোগ দেওয়া হয় না। কেউ যদি নিজ খরচে বাইরে ট্রেনিং করতে যায়, তখন অনেক সময় ছুটির অনুমতি মেলে না। নিজের খরচে ট্রেনিং করতে গিয়ে ছুটির দরখাস্তের জন্য ঘুরতে ঘুরতে জুতা ক্ষয় হয়ে যায়। এসব সমন্বয়হীনতা ছাড়াও যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তির দিক থেকে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি।’
সবশেষে জনসাধারণের উদ্দেশ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতার পরামর্শ দিয়ে ডা. মো. আসাদুর রহমান বলেন, ‘কটন বাড কিংবা অন্য কিছু দিয়ে কান খোঁচাবেন না। ঠাণ্ডা-সর্দি হলে অবহেলা না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। যদি কানের পর্দায় ছিদ্র থাকে, ডুব দিয়ে গোসল করা যাবে না এবং দ্রুত চিকিৎসা করে ছিদ্রটা বন্ধ করে নিতে হবে। শিশুদের টনসিল বা এডনয়েড সমস্যা থাকলে, রাতে নাক ডাকলে কিংবা হা করে ঘুমালে ডাক্তার দেখাতে হবে। কারণ, হা করে ঘুমালে ব্রেইনে পর্যাপ্ত অক্সিজেন সাপ্লাই হয় না, অক্সিজেনের ঘাটতি ব্রেইনের স্বাভাবিক বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে।’
এ সময় ধূমপান বা তামাক জাতীয় পদার্থ বর্জন করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘তামাক চুল থেকে পায়ের তালু পর্যন্ত সবকিছুর ক্ষতি করে। যদি গলার স্বর ভেঙে যায় এবং দুই-তিন সপ্তাহেও তা ভালো না হয়, তাহলে দ্রুত ডাক্তার দেখাতে হবে। কারণ এটি ল্যারিঞ্জিয়াল ক্যান্সারের লক্ষণ হতে পারে। প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসা করালে বেশিরভাগ ক্যান্সার রোগী ভালো হয়ে যায়। তাই নিয়মিত যত্ন, সচেতনতা এবং সময়মতো চিকিৎসা নিলে ইএনটি’র সব সমস্যা ও জটিল রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।’