রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি : মামলা ও ক্ষতিপূরণের বিষয়টি নিষ্পত্তি হওয়া জরুরি

বাসস
প্রকাশ: ২৪ এপ্রিল ২০২৫, ১৫:৫১ আপডেট: : ২৪ এপ্রিল ২০২৫, ১৬:০০
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ভবন ধসে বিপুল সংখ্যক মানুষ মারা যাওয়ার হৃদয় বিদারক দুর্ঘটনাটি ঘটে। ফাইল ছবি

।। দিদারুল আলম।।

ঢাকা, ২৪ এপ্রিল, ২০২৫(বাসস) :  ঢাকার সাভার পৌর এলাকার বাজার বাসস্ট্যান্ডের কাছে রানা প্লাজা ধসে ভবনটিতে থাকা বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানে কর্মরত এক হাজার ১৩৪ জন নিহত হন। আহত হন আরও প্রায় দুই হাজার মানুষ। অনেকেই ওই দুর্ঘটনায় পঙ্গুত্ববরণ করে ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছেন।

ভবনে ধসে এ ধরনের দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনা নজিরবিহীন। রানা প্লাজা ধসের এক যুগ পার হচ্ছে। আজ থেকে ১২ বছর আগে ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল ভয়াবহ হৃদয় বিদারক এ দুর্ঘটনা ঘটে। ভবন ধসে বিপুল সংখ্যক মানুষ মারা যাওয়ার ঘটনায় ওই সময় মোট চারটি মামলা দায়ের করা হয়। এর মধ্যে অবহেলার কারণে মৃত্যু উল্লেখ করে হত্যা মামলা দায়ের করে পুলিশ, ইমারত নির্মাণ আইন না মেনে ভবন নির্মাণ করায় একটি মামলা করে রাজউক এবং ভবন নির্মাণে দুর্নীতি ও সম্পদের তথ্য গোপন সংক্রান্ত দুটি মামলা করে দুদক। বিগত এক যুগে বছরে চারটি মামলার মধ্যে সম্পদের তথ্য গোপনের মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। বাকি তিনটি মামলা এখনো নিষ্পত্তি হয়নি।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ‘রানা প্লাজার ঘটনায় ফৌজদারি মামলা ও ক্ষতিপূরণের মামলাগুলো অনিষ্পন্ন অবস্থায় রয়েছে। মামলাগুলো এখন দ্রুত নিষ্পত্তি হওয়া দরকার। সরকার যেন এ ঘটনার ফৌজদারি মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেয়। আর হাইকোর্টের নির্দেশে গঠিত কমিটি ১৭ থেকে ২৫ লক্ষ টাকার যে  ক্ষতিপূরণ দেয়ার কথা বলেছিল তাও কিন্তু ভুক্তভোগীরা পায়নি। আর কিছু কিছু আন্তর্জাতিক  সংস্থার থেকে যে টাকা এসেছে তা হচ্ছে অনুদান সেগুলো ক্ষতিপূরণ নয়। তাই ক্ষতিপূরণের বিষয়টি নিষ্পত্তি হওয়া জরুরি।'

এসব মামলায় কারাগারে আটক রয়েছেন ভবন মালিক সোহেল রানা। রানা প্লাজা ধসের পরদিন সাভার থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) ওয়ালী আশরাফ ভবন নির্মাণে ‘অবহেলা ও ত্রুটিজনিত হত্যা’র অভিযোগে মামলা দায়ের করেন। এছাড়া রানা প্লাজা ধসে নিহত হওয়ার ঘটনাকে হত্যাকারী আখ্যায়িত করে আদালতে আরেকটি মামলা করেন গার্মেন্ট শ্রমিক জাহাঙ্গীর আলমের স্ত্রী শিউলি আক্তার। আদালতের নির্দেশে একে অবহেলাজনিত মৃত্যু মামলার সঙ্গে একীভূত করে তদন্ত করে সিআইডি। মামলাটি তদন্ত করে ২০১৫ সালের ২৬ এপ্রিল সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার বিজয়কৃষ্ণ কর ভবন মালিক সোহেল রানাসহ ৪১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। এ মামলায় মোট ৫৯৪ জনকে সাক্ষী করা হয়। আদালতে দায়ের করা হত্যা মামলার বাদী শিউলি আক্তার এখন পুলিশের মামলার সাক্ষী। মামলার ৪১ আসামির মধ্যে ভবন মালিক সোহেল রানার বাবা আব্দুল খালেক, অন্য আসামি আবু বক্কর সিদ্দিক ও আবুল হোসেন মারা যান। তিনজনকে বাদ দিয়ে হত্যা মামলায় এখন আসামির সংখ্যা ৩৮ জন। আসামিদের মধ্যে বর্তমানে কারাগারে আছেন ভবনের মালিক সোহেল রানা। বাকিদের কেউ কেউ জামিনে ও পলাতক রয়েছেন। ২০১৬ সালের ১৮ জুলাই ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে মামলার আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হয়।

মামলাটিতে অভিযোগ গঠনের পর এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে যান আট আসামি। তাদের মধ্যে সাতজনের আবেদন নিষ্পত্তি হয়। তবে আসামি হাজি মোহাম্মদ আলীর পক্ষে করা আবেদনে মামলার বিচারিক কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে। অন্য আসামিদের বিরুদ্ধে ২০২২ সালের ৩১ জানুয়ারি মামলার বাদী সাভার থানার তৎকালীন উপ-পরিদর্শক ওয়ালী আশরাফের সাক্ষ্য দেওয়ার মাধ্যমে এ মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। বর্তমানে ঢাকার জেলা দায়রা জজ আদালতে মামলাটি বিচারাধীন রয়েছে। এ মামলায় মোট ৫৯৪ জন সাক্ষীর মধ্যে প্রায় ৯৪ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ করেছেন রাষ্ট্রপক্ষ। সর্বশেষ গত ১৫ এপ্রিল মামলাটিতে সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য দিন ধার্য ছিল। ওইদিন কোন সাক্ষী না আসায় আগামী ১৯ মে পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের তারিখ ধার্য করা হয়েছে।

ঢাকা জেলার পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মো. ইকবাল হোসেন আজ বাসস’কে জানান, মামলাগুলো সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হওয়ার পর ৯৪ সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ হয়েছে। সাক্ষীদের বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে।গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীদের আদালতে আনার জন্য চেষ্টা করা হচ্ছে। এছাড়া ঘটনার সময় যারা আহত হয়েছেন তাদের সাক্ষ্য দিতে আনার চেষ্টা করছি। মামলার বিচার কাজ ত্বরান্বিত করতে আমরা উদ্যোগ নেই। 
দ্রুতই মামলার বিচার শেষ হবে বলে আশা পিপির।

এদিকে মামলায় কারাগারে থাকা রানা প্লাজার মালিক আসামি সোহেল রানাকে হাইকোর্ট জামিন দেয়। পরবর্তিতে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনে আপিল বিভাগে জামিন স্থগিতের আদেশ দেয়া হয়।

এছাড়াও আইন না মেনে ভবন নির্মাণের অভিযোগে ওই সময় সোহেল রানাসহ ১৩ জনকে আসামি করে সাভার মডেল থানায় আরেকটি মামলা করেন রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। ২০১৫ সালের ২৬ এপ্রিল সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার বিজয়কৃষ্ণ কর সোহেল রানাসহ ১৮ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। মামলার সাক্ষী করা হয় ১৩০ জনকে। ২০১৬ সালের ১৪ জুন ঢাকার তৎকালীন চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। এদের মধ্যে আসামি ফ্যান্টম অ্যাপারেলস লিমিটেডের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আমিনুল ইসলামকে মামলাটি থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন আদালত। এছাড়া মামলার আরেক আসামি সাভার পৌরসভার সাবেক মেয়র মো. রেফাতউল্লাহর পক্ষে ২০২১ সালের ৭ নভেম্বর এক বছরের জন্য মামলার বিচারিক কার্যক্রম স্থগিতের আদেশ দেন উচ্চ আদালত। বর্তমানে মামলাটি ঢাকার অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কে এম মহিউদ্দিনের আদালতে বিচারাধীন। সবশেষ গত ৯ এপ্রিল এ মামলায় উচ্চ আদালতের আদেশ দাখিলের জন্য ধার্য ছিল। আসামি পক্ষ তা দাখিল না করায় আগামী ৩১ আগস্ট পুনরায় আদেশ দাখিলের জন্য দিন ধার্য করা হয়েছে। এই মামলায় আসামির সংখ্যা ১৬ জন। সকলেই জামিনে রয়েছেন।

রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পরপরই ভবন নির্মাণে দুর্নীতির অনুসন্ধানে নামে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অনুসন্ধানে দেখা যায়, রানা প্লাজা নির্মাণে ছয় তলার অনুমোদন থাকলেও আট তলা ভবন নির্মাণ করা হয়েছিল। এ কারণে ভবন নির্মাণ সংক্রান্ত দুর্নীতির অভিযোগে আরেকটি মামলা দায়ের করে দুদক। ২০১৪ সালের ১৬ জুলাই রানাসহ ১৮ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও দুদকের উপপরিচালক মফিদুল ইসলাম। বর্তমানে মামলাটি ঢাকার বিভাগীয় স্পেশাল আদালতে বিচারাধীন।

রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানার বিরুদ্ধে সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগে দুদকের দায়ের করা একটি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। ২০১৫ সালের ১২ এপ্রিল দুদকের সহকারী পরিচালক মাহবুবুল আলম বাদী হয়ে রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানা ও তার মা মর্জিনা বেগমের বিরুদ্ধে রমনা থানায় মামলাটি দায়ের করেন। মামলায় রানা প্লাজার নির্মাণের তথ্য গোপন করে দুদকে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন তথ্য দিয়ে ছয় কোটি ৬৭ লাখ ৬৬ হাজার ৯০০ টাকা জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করার অভিযোগ করা হয়। ২০১৭ সালের ২৯ আগস্ট এ মামলার রায় ঘোষণা করেন ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৬। রায়ে সোহেল রানাকে তিন বছরের কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা ও অনাদায়ে আরও তিন মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। একই মামলায় তার মা মর্জিনা বেগমকেও তিন বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। একইসঙ্গে অবৈধভাবে অর্জিত সাভার বাজার রোডের ৬৯/১ বাড়িটির এক-তৃতীয়াংশ রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করার আদেশ দেন আদালত।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
নেত্রকোনায় ট্রেনের ছাদ থেকে পড়ে যুবকের মৃত্যু
বাংলাদেশ পুনর্গঠনে ড. ইউনূসকে সব ধরনের সহায়তার আশ্বাস কাতারের প্রধানমন্ত্রীর
চট্টগ্রামে বিচারকের স্বাক্ষর জাল করে ভুয়া হলফনামা, আইনজীবী ও দোকানি রিমান্ডে
চট্টগ্রামে মাদক মামলায় ট্রাক চালক ও সহকারীর যাবজ্জীবন
শরীয়তপুরে নদীতে ডুবে দুই শিশুর মৃত্যু  
অর্গানাইজড ক্রাইম হাতি মারা রোধে গোয়েন্দা সংস্থাকে কাজে লাগানো হবে : পরিবেশ উপদেষ্টা
ডেঙ্গু আক্রান্ত আরও ৩৩ জন হাসপাতালে 
শক্তিশালী ভূমিকম্পের পর ১৮৫ বার আফটারশক তুরস্কে!
পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছে বাংলাদেশ
বালু উত্তোলন ও বন দখলের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স : পরিবেশ উপদেষ্টা
১০