ঢাকা, ২৬ জুন, ২০২৫(বাসস): স্বৈরাচারের উৎপত্তি বন্ধ করতে হলে দেশে ‘স্বাধীন নির্বাচন কমিশন প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই’ বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ।
জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশনে সংস্কার প্রশ্নে বিএনপির অবস্থান কি তা তুলে ধরতে গিয়ে বৃহস্পতিবার দুপুরে জাতীয় প্রেসক্লাব মিলনায়তনে নাগরিক ঐক্যের এক আলোচনা সভায় তিনি এ কথা বলেন।
বিএনপির এই সিনিয়র নেতা বলেন, ‘কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে যদি সত্যিকার স্বাধীন নির্বাচন কমিশন নির্বাচন পরিচালনা করতে পারে এখানেই কিন্তু স্বৈরাচারের উৎপত্তিটা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। শুধুমাত্র নির্বাহী বিভাগকে দুর্বল করার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রে একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক কাঠামো দাঁড় করানো যাবে না।’
তিনি বলেন, নির্বাহী বিভাগকে নির্বাহী বিভাগের কাজ করতে দিতে হবে, বিচার বিভাগকে বিচার বিভাগের কাজ করতে দিতে হবে এবং আইনসভাকে আইনের কাজ করতে দিতে হবে এবং সেখানেই থাকবে একটা কমপ্লিট ব্যালেন্স অব পাওয়ার। এটাকে আমরা আইনের ভাষায় বলি একটা সেপারেশন অব পাওয়ার থিউরি, যার মূল কথা হলো, হারমোনিয়াস কোঅপারেশন ইন বিটুইন অল দ্যা অর্গানস অব দ্যা স্টেট গুড বি স্টাবলিসড।
তাহলে পরে কোনো অর্গান কোনো অর্গানের ওপরে ওভার অধিকার প্রয়োগ করতে পারবে না, হস্তক্ষেপ করতে পারবে না, একটা আরেকটা ব্যালেন্সিং পাওয়ার হিসেবে পাহারাদার হিসেবে কাজ করবে।
সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আপনারা এখানে সংস্কার নিয়ে অনেকে অনেক কথা বলেছেন। কিন্তু কেউ হতাশা ব্যক্ত করেননি। আমরা সবাই আশাবাদী মানুষ, আলোচনা চলছে।’
তিনি বলেন, সময় অনেক লাগছে। তবে আমি বিশ্বাস করি আমরা একটা জায়গায় ঐক্যমতে আসতে পারব।
ঐক্যমতে আসার জন্য আমাদের দলের পক্ষ থেকে কি কি বিষয় বিবেচনায় নিয়েছে তা আপনারা লক্ষ্য করেছেন। আমরা বলেছি, ১০ বছরের বেশি কোনো ব্যক্তি বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রীত্বের আসনে বসতে পারবেন না। এখানেই স্বৈরাচারকে রুখে দেয়া হলো, এখানে ফ্যাসিবাদের উপত্তি বন্ধ করে দেয়া হলো।
বিএনপির এই সিনিয়র নেতা বলেন, ‘তারপর কি করা হবে? রাষ্ট্রের সমস্ত গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে এই গণতন্ত্রের রক্ষাকবজ হিসেবে শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো হবে। তার জন্য কি করতে হবে? এক নম্বর বিচার বিভাগের পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। এটা (বিচার বিভাগের স্বাধীনতা) যদি আমরা সাংবিধানিকভাবে নিশ্চিত করতে পারি তাহলে এটা গণতন্ত্রের রক্ষাকবজ হবে। দুই নম্বর, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে এবং তিন নম্বর নির্বাচনকালীন সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে।’
জাতীয় প্রেসক্লাব মিলনায়তনে নাগরিক ঐক্যের ১৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে এই আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।
২০১২ সালের ১ জুন বাংলাদেশকে কল্যাণ রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে মাহমুদুর রহমানের নেতৃত্বে নাগরিক ঐক্য যাত্রা শুরু করে।
সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমরা ৭০ অনুচ্ছেদের মধ্যে সংস্কার এনেছি, সবাই ঐক্যমত্য হয়েছে। এখন আমরা আরও একটি প্রস্তাব দিয়েছি যে, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ক্ষেত্রে উভয় পক্ষের সদস্যদের মধ্যে গোপন ব্যালটে স্বাধীনভাবে এমপিরা ভোট দেবেন, সেটা আরেকটা বিপ্লব হবে। আর প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ আমরা ১০ বছরে সীমাবদ্ধ করলাম। সেটা কী আমাদের বড় ধরণের অর্জন নয়।’
তিনি বলেন, ‘আমরা যদি প্রতিটি ক্ষেত্রে নির্বাহী বিভাগকে সীমাবদ্ধ করি আইনিভাবে-সাংবিধানিকভাবে তাহলে কিন্তু নির্বাহী বিভাগ দুর্বল হবে। রাষ্ট্র পরিচালনা করা যাবে না, সরকার পরিচালনা করা যাবে না। আর যদি নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ, আইনসভা নিজ নিজ সীমার মধ্যে কাজ করতে বাধ্য থাকে, সেই ব্যবস্থাটা আমরা গ্রহন করি- তাহলে প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রের সংস্কার হবে। আমরা সেই সংস্কার চাই- যে সংস্কারের মধ্যে কোনো বিভাগের ক্ষমতা খর্ব হবে না।’
সালাহউদ্দিন বলেন, ‘আমরা সেই সংস্কার চাই, যেই সংস্কারের মধ্য দিয়ে দেশে একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামো নির্মিত হবে, সেই সংস্কার আমরা চাই যার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র কাঠামো সংস্কার হবে, সংবিধানের গণতান্ত্রিক সংস্কার হবে এবং এরফলে আমরা জাতির অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন করতে পারব। সেই রাষ্ট্র ব্যবস্থা, সেই সমাজ ব্যবস্থা আমরা কামনা করি।’
সালাহউদ্দিন বলেন, ঐক্যমত্য কমিশনের প্রচেষ্টা নির্বাহী বিভাগকে যত বেশি নিয়ন্ত্রিত করা যায়। নির্বাহী বিভাগ অতীতে একজন স্বৈরাচার তৈরি করেছিল, সেজন্য নির্বাহী বিভাগকে আমরা বিলুপ্ত করতে পারব না, দুর্বল করতে পারব না। সংসদীয় পদ্ধতিতে একজন স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠা হয়েছিলো, সেজন্য আমরা আইনসভাকে বিলুপ্ত করতে পারব না, দুর্বল করতে পারব না।
তিনি বলেন, ‘আমাদেরকে চেষ্টা করতে হবে চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স এবং একটা হারমোনিয়াস কোঅপারেশন, একটা মধুর সম্পর্ক, একটা পাহারাদার সৃষ্টি করা, সেইফ গার্ড সৃষ্টি করার জন্য সকল অর্গানগুলোকে সেইভাবে শক্তিশালী করা। সকল গণতান্ত্রিক এবং সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী ভিত্তির উপরে দাঁড় করানো- যাতে করে তারা নিজস্ব এখতিয়ারের মধ্যে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে, তাহলে আর কোনোদিন এদেশে স্বৈরাচারের উপত্তি হবে না। আমরা ক্রমান্বয়ে সেদিকে যাচ্ছি।’
সভাপতির বক্তব্যে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘আমি শুধু আপনাদের সবাইকে বলব, চোখ-কান খোলা রাখবেন, খরগোসের মতো কানগুলো যাতে সব সময় সর্তক থাকে। চোখ খোলা থাকবে কেনো? দেখেন সত্যি সত্যি কি হচ্ছে।’
আলোচনা সভায় জাতীয় পাটির্ (কাজী জাফর) মোস্তফা জামাল হায়দার, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাইফুল হক, ভাসানী জনশক্তি পার্টির শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু, সিপিবির রুহিন হোসেন প্রিন্স, গণসংহতি আন্দোলনের আবুল হাসান রুবেল, গণফোরামের মোহাম্মদ উল্লাহ মধু, নাগরিক ঐক্যের শহীদুল্লাহ কায়সার প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।