ঝালকাঠিতে প্রতিবন্ধী যুবকের উদ্যোগে গ্রন্থাগার, আশার আলো দেখছেন তরুণ পাঠকরা

বাসস
প্রকাশ: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৫:৫৩
কবি সুফিয়া কামাল গ্রন্থাগারে প্রতিদিন স্থানীয় শিক্ষার্থী ও দূর দুরান্ত থেকে সাধারণ মানুষ এসে বই ও দৈনিক পত্রিকা পড়েন। ছবি : বাসস

ঝালকাঠি, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : জেলা শহরের পুরনো আবাসিক এলাকা বাকলাই সড়কটি একসময় শান্তিপূর্ণ ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাকলাই সড়কটিকে বিভিন্ন বয়সের মাদকাসক্তদের সংখ্যা বেড়ে গেছে। স্কুল-কলেজ পড়ুয়া অনেক শিক্ষার্থীরাও নেশায় জড়িয়ে পড়ছে, নেশার অর্থ সংগ্েরহ চুরি-ছিনতাই পর্যন্ত করছে। এ নিয়ে অভিভাবক ও সচেতন মহলের মধ্যে উদ্বেগ বাড়ছে। আর ঠিক এই মুহূর্তে এক প্রতিবন্ধী যুবকের উদ্যোগে শুরু হয়েছে সমাজের অন্ধকার দূর করার ভিন্নধর্মী প্রয়াস- 'কবি সুফিয়া কামাল গ্রন্থাগার'।

গ্রন্থাগারের প্রতিষ্ঠাতা মো. মাহমুদুল হক, যিনি একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী, পেশায় একজন কম্পিউটার অপারেটর। শৈশব থেকেই তাঁর নেশা বই পড়া। উচ্চশিক্ষা অর্জন না করতে না পারলেও নিয়মিত পড়তেন বই। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও কাজী নজরুল ইসলামের লেখা তিনি বেশি পছন্দ করেন। তাছাড়া তিনি অন্যান্য সাহিত্যিকের লেখাও পড়েন। তার প্রিয় উপন্যাস “দেবদাস”। দেবদাস পড়ার নেশা-ই তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছে গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠায়। তিনি বিশ্বাস করেন, বইয়ের আলো ছড়িয়ে দিতে পারলে সমাজের অন্ধকার কাটানো সম্ভব হবে। সেই ভাবনা থেকেই ২০১০ সাল থেকে একটি লাইব্রেরি করার স্বপ্ন দেখতেন।

সেই থেকে নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও তিনি হাল ছাড়েননি। অবশেষে ২০১৫ সালে নিজের বাড়ির ছাদে নিজ উদ্যোগে একটি গ্রন্থাগারের যাত্রা শুরু করেন। ২০১৭ সালে সমাজসেবা অধিদপ্তরের নিবন্ধনও পান। বর্তমানে গ্রন্থাগারটি প্রতিদিন বিকেল ৩টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত খোলা থাকে। বর্তমানে এই কবি সুফিয়া কামাল গ্রন্থাগারে বিভিন্ন ধরনের ১২০০ বই রয়েছে। বইগুলো মাহমুদুল সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও দানশীল ব্যাক্তিদের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছেন তিনি। এখানে প্রতিদিন স্থানীয় শিক্ষার্থী ও দূর দুরান্ত থেকে সাধারণ মানুষ এসে বই ও দৈনিক পত্রিকা পড়েন। 

এ পাঠাগারের আশেপাশে ৩টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। শুক্র ও শনিবার পাঠকদের এক মিলনমেলা হয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এই দুই দিন বন্ধ থাকায় উপস্থিতি বেশি হয়। তবে পাঠাগারের কক্ষটি বেশ ছোট হওয়ায় মাঝেমধ্যে পাঠকদের জায়গা সংকুলান হয় না। অবকাঠামো দূর্বল হওয়ায় বৃষ্টিতে পানি পড়ে। পাঠকদের জন্য নেই ভালো বসার ব্যাবস্থা। প্রয়োজনীয় সহযোগিতা পেলে এই 'কবি সুফিয়া কামাল' পাঠাগারটি এই এলাকার জন্য হয়ে উঠতে পারে আদর্শিক একটি জায়গা, যেখান থেকে মানুষ আলোকিত হবে।

ঝালকাঠি সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী ইমাম হোসেন বলেন, প্রায় প্রতিদিন বিকেলে আমি এখানে আসি। মাঝে মধ্যে উপন্যাস পড়ি, আড্ডা দিয়ে সময় না কাটিয়ে এখানে এসে বই পড়ি। এখানে আমার পাঠ্য বিষয়ের কিছু বই আছে যা আমার পড়াশোনায় অনেক উপকার হয়।

গ্রন্থাগারের একজন নিয়মিত পাঠক ও সংগঠক মো. মজিবুল হক বলেন, আগে আমাদের এলাকায় বই পড়ার জায়গা ছিল না। এখন এখানে এসে পরীক্ষার পড়ার পাশাপাশি গল্প-উপন্যাস পড়ে জ্ঞান বাড়াতে পারছি। এখানে আমরা অনেক ধরনের বই, দৈনিক পত্রিকা পড়তে পারি। চাকুরী থেকে অবসরের পর মোবাইলে আসক্ত হয়ে গেছিলাম, এখন এখানে এসে এর থেকে মুক্তি মিলছে। গ্রন্থাগার উন্নয়নের জন্য আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। ভবিষ্যতে আরও নতুন বই ও আসবাব যোগ করা হবে।
‎পাঠাগারের স্বপ্নদ্রষ্টা মো. মাহমুদুল হক বলেন, আমি একজন প্রতিবন্ধী মানুষ। সবার মত স্বাভাবিক কাজ করতে পারি না। লেখাপড়াও খুব বেশি দূর পর্যন্ত করতে পারেনি। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই বই পড়তাম, বইয়ের প্রতি আলাদা একটা প্রেম আছে। বইয়ের প্রতি প্রেম ও এলাকার তরুণ যুব সমাজের অবক্ষয়ের করুণ চিত্র দেখে পাঠাগারের চিন্তা মাথায় আসে। আমি পাঠাগারের যাত্রা শুরু করার সময় তেমন কারো সহযোগিতা না পেলেও ধীরে ধীরে সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় এতোটুকু আসতে পেরেছি। আমার গ্রন্থাগারে এখন আরো কিছু বই দরকার। গ্রন্থাগারের কক্ষটি আরো বড় করা দরকার। পাঠকরা এখানে এসে ভালো একটি পরিবেশে যাতে বই ও দৈনিক পত্রিকা পড়তে পারে সে জন্য চেয়ার টেবিল প্রযয়োজন।

ঝালকাঠি সরকারি মহিলা কলেজের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক ইমরান হোসেন রবিন বলেন, লাইব্রেরি শিক্ষার্থীদের চরিত্র গঠনে অপরিহার্য ভূমিকা রাখে। বইয়ের প্রতি আগ্রহ বাড়লে তারা খারাপ আসক্তি থেকে দূরে থাকবে। এ উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসনীয়। শুধু শিক্ষার্থী নয়, সাধারণ মানুষও এই গ্রন্থাগার থেকে উপকৃত হবে। যারা স্কুল কলেজে পড়াশোনার সুযোগ পাননি, তারাও এখানে এসে বই পড়ে জ্ঞান অর্জন করতে পারবে।

ছোট পরিসরে শুরু হলেও 'কবি সুফিয়া কামাল গ্রন্থাগার' আজ ঝালকাঠি শহরের বাকলাই ফাঁড়ির মানুষের মধ্যে নতুন আলো ছড়াচ্ছে। একজন প্রতিবন্ধী তরুণের অদম্য উদ্যমের কারণে এই গ্রন্থাগার শুধু বই পড়ার জায়গা নয়, বরং মাদকমুক্ত সমাজ গড়ার সম্ভাবনাময় পথ হয়ে উঠেছে। অভিভাবক, শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও সচেতন মানুষ একবাক্যে বলছেন-এটি সমাজের জন্য সত্যিই অনুপ্রেরণার উৎস। 

ঝালকাঠির জেলা প্রশাসক আশরাফুর রহমান বলেন, আবেদন করলে মাহামুদুল হকের লাইব্রেরির উন্নয়নে সহায়তা করা হবে। 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
বরিশালে তারেক রহমান ঘোষিত রাষ্ট্র পুনর্গঠনের ৩১ দফার লিফলেট বিতরণ
শহীদ জেহাদ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় স্বৈরাচারের বুলেট বুকে নিয়েছিলেন : বিএনপি মহাসচিব
সিডনিতে অস্ট্রেলিয়ার সাবেক ইউএফসি যোদ্ধাকে গুলি করে হত্যা
বাংলাদেশ বিনিয়োগের সম্ভাবনাময় একটি দেশ: আমীর খসরু 
গাজা যুদ্ধবিরতি চুক্তির ‘প্রথম পর্যায়ে’ ইসরাইল এবং হামাস একমত
নড়াইলে টাইফয়েড টিকাদান ক্যাম্পেইন: সাংবাদিকদের নিয়ে কর্মশালা
টাঙ্গাইলে নকল কসমেটিকস রাখায় একটি শপিংমলকে জরিমানা 
হবিগঞ্জে টাইফয়েড ক্যাম্পেইন উপলক্ষে সংবাদ সম্মেলন
সুনামগঞ্জে বিএনপি’র লিফলেট বিতরণ ও গণসংযোগ
চাঁদপুরের ৮ লাখ শিশু টাইফয়েড টিকা পাবে 
১০