সরাইলের গ্রে হাউন্ড কুকুর বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন ও বাজারজাত করা হবে

বাসস
প্রকাশ: ২২ অক্টোবর ২০২৫, ১৭:০৯ আপডেট: : ২২ অক্টোবর ২০২৫, ১৭:৪৫
শক্ত গড়নের পাঁজর আর দীর্ঘদেহী গ্রে হাউন্ড কুকুর জেলার সরাইল উপজেলার ঐতিহ্যবাহী একটি প্রাণী। ছবি : বাসস

।। মো.শফিকুল ইসলাম।।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ২২ অক্টোবর ২০২৫ (বাসস): শক্ত গড়নের পাঁজর আর দীর্ঘদেহী গ্রে হাউন্ড কুকুর জেলার সরাইল উপজেলার ঐতিহ্যবাহী একটি প্রাণী। সাহস আর রণকৌশলে অন্যসব কুকুরের চেয়ে আলাদা। দৌড়ের গতিও অন্যসব কুকুরের চেয়ে বেশি। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আর শিকারে পারদর্শিতার কারণে গ্রে হাউন্ড কুকুর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ডগ স্কোয়াডেও ব্যবহৃত হয়েছে বলে জানা যায়। 

ঐতিহ্যবাহী এই গ্রে হাউন্ড কুকুর এখন অস্তিত্ব সংকটে। পুরো সরাইল জুড়ে হাতে গোনা কয়েকটি বাড়িতে দেখা মেলে এই কুকুরের। ঐতিহ্যবাহী ও দামি বিরল প্রজাতির এই কুকুরকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করতে গ্রে হাউন্ড প্রজনন কেন্দ্র গড়ে তোলার কথা ভাবছে প্রশাসন। সরাইল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মোশারফ হোসাইন বাসসের সাথে আলাপকালে আজ একথা জানান। 

তিনি বলেন, বাণিজ্যিকভাবে গ্রে হাউন্ড কুকুর উৎপাদন ও বাজারজাত করার বিষয়টি নিয়ে আমরা প্রাথমিক আলোচনা ও সম্ভাব্যতা যাচাই করেছি। গ্রে-হাউন্ড কুকুরের জাত টিকিয়ে রাখার জন্য একটি প্রজনন কেন্দ্র করার পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। এই বিষয়টি নিয়ে উপজেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর সম্মলিতভাবে কাজ করছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, ঐতিহ্য ধরে রাখতে একটি পরিবার এখনও বংশ পরম্পরায় গ্রে হাউন্ড কুকুর পালন করছে। সরাইল উপজেলার নোয়াগাঁও ইউনিয়নের চৌরাগুদা গ্রামের দুই ভাই তপন লাল রবিদাস ও যতন লাল রবিদাস বাপ-দাদার ঐতিহ্য ধরে রাখতে গ্রে হাউন্ড কুকুর পালন করছেন। তবে ব্যয়বহুল খাদ্যাভ্যাসের কারণে গ্রে হাউন্ড কুকুর পালন তাদের জন্য কষ্টসাধ্য। 

জনশ্রুতি আছে, প্রায় দুইশ বছর আগে সরাইলের জমিদার দেওয়ান মোস্তফা আলী হাতি নিয়ে কলকাতা যাচ্ছিলেন। পথে এক ইংরেজ সাহেবের কাছে একটি সুন্দর কুকুর দেখতে পান। তিনি কুকুরটি কেনার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। পরে তিনি একটি হাতির বিনিময়ে ইংরেজ সাহেবের কাছ থেকে ঐ স্ত্রী কুকুরটি নিয়ে আসেন। 

বলা হয়ে থাকে, জমিদার মোস্তফা এলাকায় ফিরে একদিন হাতির পিঠে চড়ে বনে শিকারে বের হন। একপর্যায়ে কুকুরটি বনে হারিয়ে যায়। বেশ কিছুদিন পর গর্ভবতী হয়ে কুকুরটি ফিরে আসে। কদিন পরই দেওয়ানের বাড়িতে কুকুরটি কয়েকটি বাচ্চা দেয়। দেখা যায়, এসব বাচ্চা সাধারণ কুকুরের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। বাচ্চাগুলোর সাথে বাঘের বেশ মিল আছে। ধারণা করা হয়, নেকড়ের সঙ্গে দেওয়ানের কুকুরের মিলন থেকে ওই বাচ্চাগুলোর জন্ম হয়েছে। তারপর থেকেই সরাইলের বিভিন্ন বাড়তি গ্রে হাউন্ড কুকুর পালন শুরু হয়।

এলাকার প্রবীণদের সাথে কথা বলে জানা যায়, এক সময় সরাইল উপজেলার প্রতিটি বাড়িতে দেখা মিলত গ্রে হাউন্ড কুকুরের। মূলত বাড়ির নিরাপত্তা এবং শেয়াল তাড়ানোর জন্য গ্রে হাউন্ড কুকুর পালনে উৎসাহী হন সরাইলের বাসিন্দারা। ধীরে ধীরে এই কুকুর বাণিজ্যিকভাবেও লালন-পালন শুরু করেন অনেকে। তবে অন্য সব কুকুরের তুলনায় গ্রে হাউন্ড পালন কিছুটা ব্যয় সাপেক্ষ। এর ফলে অনেকেই গ্রে হাউন্ড কুকুর পালন বন্ধ করে দেন। এতেই কমতে থাকে গ্রে হাউন্ড কুকুরের সংখ্যা। এখন হাতে গোনা কয়েকটি পরিবার শখের বশে গ্রে হাউন্ড কুকুর পালন করছে। তবে ঐতিহ্য ধরে রাখার পাশাপাশি বাণিজ্যিকভাবে মাত্র তপন রবিদাস ও যতন রবিদাস গ্রে হাউন্ড কুকুর পালন করছেন।

স্থানীয় বাসিন্দা মোহাম্মদ মাসুদ মিয়া বাসসকে বলেন, গ্রে হাউন্ড কুকুর বাড়ির নিরাপত্তায় কাজ করে। রাত জেগে বাড়ি পাহারা দেয়। প্রভুভক্ত কুকুর বাড়ির মালিককে দূর থেকে দেখলেই দৌড়ে কাছে এসে জড়িয়ে ধরে। তিনি সরাইলের ঐতিহ্যবাহী এই কুকুরের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার দাবি জানান।

তপন লাল রবিদাস ও যতন লাল রবিদাসের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের দাদার বাবা কালীচরণ রবিদাস সর্বপ্রথম গ্রে হাউন্ড পালন শুরু করেন। এরপর দাদা গঙ্গাচরণ রবিদাস এবং পরবর্তীতে বাবা  মোহন লাল রবিদাস গ্রে হাউন্ড কুকুর পালন করেছেন। বংশ পরম্পরায় এখন তপন রবিদাস ও যতন রবিদাস কুকুর পালন করছেন।

বর্তমানে তাদের কাছে দুই বছর বয়সী চারটি বড় আকারের গ্রে হাউন্ড কুকুর আছে। এর মধ্যে দুটি পুরুষ ও দুটি স্ত্রী কুকুর। কুকুরগুলোর খাবারের তালিকায় রয়েছে ভাত, মাছ, মাংস, দুধ ও সিদ্ধ ডিম।

বড় কুকুরগুলো বিক্রি না করলেও ছানাগুলো প্রত্যেকটি ৩০ হাজার থেকে ৪০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। প্রতি বছর ৭-৮টি গ্রে হাউন্ড কুকুর ছানা বিক্রি করেন দুই ভাই।

কুকুর ছানাগুলো বিক্রি করা হয় স্ট্যাম্প করে। তবে পেশায় মুচি তপন ও যতনের জন্য গ্রে হাউন্ড পালন করা এখন কষ্টকর হয়ে উঠেছে। স্বল্প আয়ে সংসার চালাতেই হিমশিম খেতে হয় তাদের। এর ফলে অর্থের অভাবে ঠিকভাবে গ্রে হাউন্ড কুকুরের পরিচর্যা করতে পারছেন না দুই ভাই।

তপন লাল রবিদাস বলেন, বড় প্রত্যেকটি কুকুরের জন্য প্রতিদিন অন্তত ৩০০ টাকার খাবারের প্রয়োজন হয়। ভাত, মাছ, মাংস, ডিম ও দুধ ছাড়া অন্য কোনো খাবার খায় না গ্রে হাউন্ড কুকুর। কিন্তু সবসময় আমরা এই খাবার খাওয়াতে পারি না। আর্থিক টানাপোড়নের সংসারে আমাদের নিজেদের চলতেই কষ্ট হয়। এর মধ্যে কুকুরের খাবারের জন্য বাড়তি টাকা খরচ করা আমাদের জন্য কষ্টকর। শুধুমাত্র পূর্ব পুরুষরা কুকুর পালন করতেন বলেই আমরা এখনও পালন করছি। 

যতন লাল রবিদাস বলেন, বাবা বলেছিলেন জমিদার এবং আমার দাদার স্মৃতি ধরে রাখার জন্য দুটি কুকুর বাড়িতে রাখতে। আমরা দুই ভাই যতদিন বেঁচে থাকব স্মৃতি ধরে রাখার জন্য এই কুকুর পালন করব। আমাদের সন্তানদেরও বলেছি আমাদের মৃত্যুর পরও যেন তারা এই কুকুর পালন করে।

প্রাণীসম্পদ বিশেষজ্ঞদের মতে, ঐতিহ্যবাহী এই কুকুরের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন। এই কুকুর কেবল সরাইলের ঐতিহ্যই নয়, এটি নিরাপত্তার কাজেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এর সঠিক প্রজনন, রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাজেও এদের ব্যবহার করা সম্ভব।  

তাদের মতে, সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ ও পৃষ্ঠপোষকতায় ঐতিহ্যবাহী সরাইলের বিরল প্রজাতির মূল্যবান গ্রে-হাউন্ড কুকুরকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করা প্রয়োজন।

উপজেলা প্রাণী সম্পদ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ১৯৮৩ সালে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় সরাইল উপজেলা সদরে একটি গ্রে-হাউন্ড কুকুর সংরক্ষণ কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছিল।

তবে উপযুক্ত চিকিৎসা, সুষ্ঠু পরিচালনা ও আর্থিক সংকটের কারণে কয়েক বছর পরই কেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে যায়। উপজেলা সদরের বড়দেওয়াপাড়া গ্রামের বাসিন্দা শাহজাহান ঠাকুর ২০০১ সালে সরাইলে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কুকুর প্রজননের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত তার উদ্যোগটিও টেকেনি।

সরাইল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মোশারফ হোসাইন বলেন, সরাইলের ঐতিহ্যের কথা বলতে গেলে বিখ্যাত গ্রে-হাউন্ড কুকুরকে বাদ দেওয়া যাবে না। দেশ বিদেশে এই কুকুর সরাইলের পরিচিতি বহন করে। এছাড়া গ্রে-হাউন্ড কুকুর প্রভু ভক্ত। পাশাপাশি গ্রে-হাউন্ড কুকুর বাড়িঘর পাহারা দেয়। গোয়েন্দা তৎপরতার মত গুণও রয়েছে তাদের। 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
রাকসু নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক ফলাফল প্রকাশ
আফ্রিকান বর্ষসেরার তালিকায় এগিয়ে সালাহ, হাকিমি
মিয়ানমারের স্ক্যাম সেন্টারগুলোতে ২৫০০ স্টারলিংক ডিভাইসের সেবা বন্ধ 
আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিষয়ক সেমিনার অনুষ্ঠিত
ঢাকা কাস্টমস হাউস ২৪ ও ২৫ অক্টোবর খোলা থাকবে
জাপানে ভালুকের আক্রমণে রেকর্ড মৃত্যু
বগুড়ায় প্লাস্টিকের বিকল্প পণ্যের প্রদর্শনী
শুক্রবার চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত হবে জিয়া ফুটবল টুর্নামেন্ট
সেন্টমার্টিনে ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে পর্যটকদের রাত্রিযাপনের অনুমতি
চট্টগ্রাম ওয়াসার পয়ঃনিষ্কাশন প্রকল্পের ৭০ শতাংশ কাজ সম্পন্ন
১০