চট্টগ্রাম, ২২ অক্টোবর, ২০২৫ (বাসস): রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনে (বিএসসি) প্রথমবারের মতো নিজস্ব অর্থায়নে যুক্ত হচ্ছে নতুন জাহাজ ‘এমবি বাংলার প্রগতি’ ও ‘বাংলার নবযাত্রা’।
প্রথম জাহাজটি ইতোমধ্যে হস্তান্তর হয়েছে এবং দ্বিতীয় জাহাজ ডিসেম্বরে হস্তান্তর করার কথা রয়েছে। এ দু’টি জাহাজ থেকে বছরে ৩০০ কোটি টাকা আয়ের পরিকল্পনা রয়েছে বিএসসির।
চীনে নির্মিত জাহাজ দু’টি সরবরাহ করছে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি হেলনিক ড্রাই বাল্ক ভেঞ্চারস। সরকারি সব ক্রয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ায় গত রোববার হেলনিকের সঙ্গে সরবরাহ চুক্তি করেছে বিএসসি। ‘বাংলার প্রগতি’ আগামীকাল বৃহস্পতিবার আনুষ্ঠানিকভাবে ডেলিভারি গ্রহণ করবে এবং ‘বাংলার নবযাত্রা’ নামে জাহাজাটিও ডিসেম্বরে বিএসসির বহরে যুক্ত হবে বলে অনুষ্ঠানে জানানো হয়।
১৯৯ মিটার লম্বা, ৩৩ মিটার প্রস্থ, ১৮ মিটার গভীরতার ‘বাংলার প্রগতি’ জাহাজটি ৬৫ হাজার টন পণ্য পরিবহনে সক্ষম। জাহাজটির প্রধান ইঞ্জিন ম্যান-বিএন্ডডাব্লিউ (জার্মান লাইসেন্সের অধীনে নির্মিত, চীন সংযোজিত)। এটির পাম্প স্পেনের এবং কম্প্রেসার নরওয়ের।
ইতোমধ্যে জাহাজটির ট্রায়াল শুরু হয়েছে চীনে। শিগগিরই জাহাজটি পণ্য বোঝাই করবে এবং লাল-সবুজের পতাকা ফেরি করবে বিশ্বের বন্দর থেকে বন্দরে। বহরে যুক্ত হতেই প্রতিদিন ২০ হাজার ডলারের ভাড়াও নিশ্চিত হয়েছে জাহাজটির।
বিএসসির মহাব্যবস্থাপক (কার্গো সুপারভিশন এন্ড অপারেশন) ক্যাপ্টেন জামাল হোসেন তালুকদার জানান, লন্ডনে জাহাজটি কাগজপত্রে হেলেনিক ড্রাই বাল্ক ভেঞ্চারস এলএলসি থেকে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন (বিএসসি) বুঝে নিয়েছে। ডেলিভারি এবং গ্রহণের প্রটোকল উভয় পক্ষের দ্বারা যথাযথভাবে স্বাক্ষরিত হয়েছে। বৃহস্পতিবার চীনে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন (বিএসসি) ‘এমভি বাংলার প্রগতি’ জাহাজটির আনুষ্ঠানিক ডেলিভারি চীনা জিংজিয়াং নানিয়াং শিপবিল্ডিং কোম্পানি লিমিটেড থেকে গ্রহণ করবে।
বিএসসি সূত্র জানায়, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন (বিএসসি) নিজস্ব অর্থায়নে ৫৫ থেকে ৬৬ হাজার ডিডব্লিউটি ক্ষমতা সম্পন্ন বাল্ক ক্যারিয়ার জাহাজ সংগ্রহের লক্ষ্যে প্রধান উপদেষ্টা কর্তৃক সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির সুপারিশ সদয় অনুমোদনের প্রেক্ষিতে গত ২১ সেপ্টেম্বর বিএসসি ও সরবরাহকারী বা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান হেলেনিক ড্রাই বাল্ক ভেঞ্চারস এলএলসির মধ্যে সরবরাহ চুক্তি হয়।
নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় প্রকল্পটি জুন ২০২৫ থেকে জুন ২০২৭ পর্যন্ত মেয়াদকালে বাস্তবায়নের জন্য এর ডিপিপি গত ৩ জুন অনুমোদিত হয় এবং ৪ জুন আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হয়।
চুক্তি মোতাবেক প্রতিটি জাহাজের মূল্য ৩৮ দশমিক ৩৪৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং দু’টি জাহাজের মোট সমন্বয়কৃত ও সুপারিশকৃত মূল্য ৭৬ দশমিক ৬৯৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
এটি দাপ্তরিক প্রাক্কলিত মূল্যের চেয়ে ৪ দশমিক ৬০ শতাংশ কম। জাহাজগুলো কেনার ক্ষেত্রে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের দাখিল করা প্রস্তাবে গৃহীত বিভিন্ন কারিগরি দিক যাচাই-বাছাই করা হয় এবং মূল্যায়ন কমিটি সরেজমিনে জাহাজের নির্মাণ অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে।
জাহাজের স্পেসিফিকেশন প্রস্তুত এবং কারিগরি মূল্যায়নে ক্লাসিফিকেশন সোসাইটির প্রতিনিধির বিশেষজ্ঞ সেবা নেওয়া হয়। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমোদন প্রাপ্তির পর জাহাজগুলোর নাম পরিবর্তন করে ‘এমভি বাংলার প্রগতি’ (আগের নাম : XCL GEMINI) ও ‘এমভি বাংলার নবযাত্রা’ ( আগের নাম : XCL LION) নির্ধারণ করা হয়েছে।
গ্রিন শিপ কনসেপ্টে নির্মিত জাহাজগুলো নকশা ও প্রযুক্তিগত সমাধান জ্বালানি সাশ্রয়ী, পরিবেশবান্ধব এবং আন্তর্জাতিক পরিবেশগত মানদণ্ডসম্মত। আন্তর্জাতিক মেরিটাইম সংস্থা (আইএমও) নির্ধারিত সর্বশেষ পরিবেশগত মানদণ্ড পূরণ করে, যা বৈশ্বিক কার্বন নির্গমন নিয়ন্ত্রণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
জাহাজগুলোর প্রধান ইঞ্জিন থেকে নাইট্রোজেন অক্সাইড নির্গমন কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে পরিবেশ দূষণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমায়। জ্বালানি খরচ কম ও অপারেশনাল দক্ষতা বাড়ায়, যা সরাসরি অর্থনৈতিক সাশ্রয়ে প্রভাব ফেলে। হাইড্রোডাইনামিক ড্র্যাগ কমিয়ে জাহাজের গতি বৃদ্ধি ও জ্বালানি সাশ্রয় নিশ্চিত করে। বাতাসের বাধা কমিয়ে গতি ও জ্বালানি সাশ্রয় নিশ্চিত করে, বিশেষত উচ্চগতিতে অপারেশনের সময় কার্যকর।
২০১৮ ও ২০১৯ সালে চীন সরকারের ১ হাজার ৮৪৩ কোটি টাকায় আর্থিক সহায়তায় তিনটি করে ছয়টি জাহাজ কিনেছিল বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন।
প্রথমবারের মতো এবারই সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে ৯৩৫ কোটি টাকায় দু’টি জাহাজ কিনছে। এর মধ্যে ‘এমবি বাংলার প্রগতি’ বহরে যুক্ত হলো। ‘এমবি বাংলার নবযাত্রা’ ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে বহরে যুক্ত হওয়ার কথা রয়েছে। এ দু’টি জাহাজ থেকে বছরে ৩০০ কোটি টাকা আয়ের পরিকল্পনা রয়েছে বিএসসির।
সূত্র জানায়, নব্বইয়ের দশকে রাষ্ট্রীয় জাহাজ কোম্পানি বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের বহরে সর্বোচ্চ ৩৮টি জাহাজ ছিল। পুরাতন জাহাজ ক্রয়ে ক্রমাগত লোকসান ও দুর্নীতির কারণে ধীরে ধীরে বহর ছোট হয়। ২০১৮ সাল থেকে পর্যায়ক্রমে ছয়টি নতুন জাহাজ পেয়ে আবারও ফেরে লাভের ধারায়। যদিও অগ্নি দুর্ঘটনায় গত বছর দু’টি জাহাজ পরিত্যক্ত হলে জাহাজ কমে দাঁড়ায় মাত্র পাঁচটিতে। এই অবস্থায় ব্যবসায় টিকে থাকতে নতুন জাহাজ কেনা জরুরি হয়ে পড়ে।
মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, বাংলাদেশে সমুদ্র পথে পণ্য পরিবহনের বাজার বছরে ৩২ বিলিয়ন ডলার। বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় ও বিশাল এই বাজারে নিজেদের শেয়ার বাড়াতে অন্তত আরও ৪৫০ জাহাজ দরকার।
বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ আনাম চৌধুরী বলেন, ‘নতুন নতুন জাহাজ কেনা বেটার। আমাদের টার্গেট ৪৫০-৫০০ জাহাজের দিকে যেতে হবে।’
২০২৪-২৫ অর্থ বছরে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা নিট মুনাফা করেছে রাষ্ট্রীয় এই জাহাজ কোম্পানি। ২০২৮ সালের মধ্যে জাহাজের সংখ্যা বাড়িয়ে দ্বিগুণ করতে চায় বিএসসি।
কর্তৃপক্ষ বলছে, এ দু’টি হবে শিপিং কোম্পানিটির বহরের সবচেয়ে বড়, আধুনিক, পরিবেশ বান্ধব ও ব্যয় সাশ্রয়ী জাহাজ। এরই মধ্যে ছয় মাসের জন্য বাংলার প্রগতিকে ভাড়া দিয়েছে বিএসসি। দু’টি জাহাজ দিয়ে বছরে আয় হবে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা।
বিএসসি ব্যবস্থাপনা পরিচালক কমোডর মাহমুদুল মালেক বলেন, সব খরচ বাদ দিয়ে প্রতি জাহাজ থেকে নিট মুনাফা আমরা ১ বছরে আশা করছি ১৫০ কোটি টাকা হবে। ‘বাংলার প্রগতি’ প্রথম ৬ মাসের জন্য ভাড়া দিচ্ছি প্রতিদিন ২০ হাজার ডলার করে।