ইঞ্জিনিয়ার পড়ে চাকরি না করে সফল উদ্যোক্তা হলেন কানিজ ফাতেমা

বাসস
প্রকাশ: ০৯ নভেম্বর ২০২৫, ১০:১২
সফল উদ্যোক্তা কানিজ ফাতেমা। ফাইল ছবি

ঢাকা, ৯ নভেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : কানিজ ফাতেমা সব সময়ই স্বপ্ন দেখতেন নিজের পায়ে দাঁড়ানোর। তাই পড়াশোনায় মনোযোগী হয়ে ওঠেন তিনি। কঠোর পরিশ্রম করে পড়াশোনার ফল পাওয়া গেলো যখন তিনি এসএসসি পরীক্ষায় তাক লাগানো রেজাল্ট করলেন। যা তার আত্মবিশ্বাস আরও বাড়িয়ে দেয়। একইভাবে এইচএসসিতে ভালো করে গ্রামের বাড়ি চাঁদপুর থেকে ঢাকায় একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সিএসই বিভাগে ভর্তি হলেন তিনি। 

কিন্তু সিএসই বিভাগ নিয়ে পড়াশোনা শেষ করলেও কানিজ ফাতেমা প্রকৌশল বিষয়ক কোনো কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেননি। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন উদ্যোক্তা হবেন। যেই কথা, সেই কাজ। তবে কম্পিউটার বিজ্ঞানে ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করে যখন উদ্যোক্তা হওয়ার মতো চ্যালেঞ্জিং কাজ বেছে নিলেন, আশপাশের মানুষ তখন রীতিমতো হইচই শুরু করে দিলো। 

তাদের বক্তব্য, ‘এমন কাজ কেউ করে? কোথায় বিশাল বেতনে চাকরি করবে, তা না করে একটা অনিশ্চয়তার দিকে নিজেকে টেলে দিচ্ছে! কিন্তু ফাতেমার ভাষ্য, চাকরি করবো অন্যের অধীনে। স্বাধীনতা তো পাবো না। আমি চাই সফলও হতে হবে, আবারও স্বাধীনতাও থাকবে- এমন কাজ। তাই স্বাধীনভাবে কিছু করার স্বপ্নে বিভোর থেকেছেন তিনি। সেদিনের সেই প্রত্যয়ই যেন আজকের উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে কানিজ ফাতেমাকে। এখন তিনি কেবল সফল উদ্যোক্তাই নন, উদ্যোক্তা ‘সৃষ্টির কারিগর’ও বটে। 

রেস্তোরাঁ থেকে শুরু করে যেদিকে হাত দিয়েছেন সেই খাতেই যেন সাফল্য পেয়েছেন তিনি। এখন তিনি কাপড় ও রেস্তোরাঁসহ একাধিক ব্যবসা সামলে চলেছেন। সম্প্রতি এক আলাপচারিতায় নিজের উদ্যোক্তা হওয়ার গল্প তুলে ধরেন ফাতেমা। 

জানালেন, ১৯৯৯ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য চাঁদপুর থেকে ঢাকায় পাড়ি জমান। এরপর পড়াশোনা শেষ করেছি। কিন্তু এর মাঝেই বিয়ে হয়ে যায়। কিন্তু ফাতেমা দমে যাওয়ার পাত্র নন। তিনি স্বপ্নে স্থির থেকে এগিয়ে চলেছেন পরিকল্পনা মতো। 

নারী উদ্যোক্তা কানিজ ফাতেমা বলেন, ‘২০০৭ সালে ‘ডিভাস স্টাইল’ নামে একটি উদ্যোগ শুরু করি। এর অফিশিয়াল যাত্রাও তখনই শুরু হয়। এরপর আর আমাকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ‘ডিভাস স্টাইলে’ মূলত তৈরি পোশাক; যেমন-শাড়ি, পাঞ্জাবি, বেডশিট, শিশুদের পোশাক, কাপল ড্রেসসহ নিজস্ব ডিজাইনের পোশাক বিক্রি হয় অনলাইন ও অফলাইন। এই প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে ২০ জন কাজ করছেন।’

উদ্যোক্তা হিসেবে সাফল্য এলেও শুরুর দিকে কানিজের গল্পটা ছিল ভিন্ন। প্রকৌশল হিসেবে ভালো চাকরির সুযোগ ছেড়ে দেওয়াটা পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনের অনেকে ভালোভাবে নেননি। মুখে না বললেও অনেকের আচরণে প্রকাশ পেয়েছে কটাক্ষ। কিন্তু এসব আচরণ কানিজ গায়ে মাখেননি। তিনি তার মতো করে এগিয়েছেন।

কানিজ ফাতেমা বলেন, ‘আমি জানতাম, আমার যে উদ্যোগ, এটি সফল হলে সবাই গ্রহণ করবে। তাই আমি আমার কাজে সর্বোচ্চ ফোকাস করতাম। জীবনটা আমার, তাই এর ভালো থাকাটা আমাকে নিশ্চিত করতে হবে। সফল হলে সবাই পাশে থাকে।’

কানিজ ফাতেমা জানালেন, মা-বাবা শুরুর দিকে মেয়ের উদ্যোক্তা হওয়ার সিদ্ধান্ত পছন্দ না করলেও এখন তারা খুশি। তার স্বামী মঞ্জুরুল ইসলাম সুমন একজন চিত্রশিল্পী।

দুই ছেলে-মেয়ে নিয়ে তাদের সংসার। নিজের কাজের ক্ষেত্রে সবসময়ই স্বামীর সহযোগিতা পেয়েছেন বলে জানান তিনি। 

কানিজ ফাতেমা আরও বলেন, ‘মূলত তার স্বামীর সহযোগিতা আমাকে ভীষণভাবে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে।’ 

ফাতেমা বলেন, আমি শুধু নিজে লাভবান হওয়ার স্বপ্ন দেখিনি। গ্রামের নিম্নআয়ের নারীদের স্বাবলম্বী করার লক্ষ্যে ‘আর্ট অব ডিভা ফাউন্ডেশন’ প্রতিষ্ঠা করি। এর মাধ্যমে উদ্যোক্তাদের সহজশর্তে পণ্য দেওয়া হয়। 

এই ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে নারী উদ্যোক্তা তৈরির পাশাপাশি শীতকালে শীতবস্ত্র বিতরণ, ঈদ উপহার সামগ্রী বিতরণ, এতিমদের খাওয়ানোসহ বিভিন্ন সমাজ কল্যাণমূলক কাজ করা হয় বলে জানালেন তিনি।

অনেক নারী উদ্যোক্তা শুরুটা বেশ ভালোভাবেই করেন। কিছুদিন যেতে না যেতেই ঝরে পড়েন। এমন হওয়ার কারণ কী? এ ব্যাপারে কানিজ ফাতেমা বলেন, ‘আমাদের সমাজে সহযোগিতার অভাব, সেটা যেমন সামাজিক ও পারিবারিক—দুই জায়গাতেই। আবার অর্থ বিনিয়োগ করতে হয়। ব্যাংক লোন পেতে গেলে জামানত চায়। এসবের ব্যবস্থা করতে না পারাই ঝরে পড়ার অন্যতম কারণ। 

তিনি বলেন, ‘তবে আমাদের দেশের নারী প্রথম বাধার সম্মুখীন হয় পরিবার থেকে। পরিবারের সহযোগিতা নারী উদ্যোক্তার জন্য অত্যন্ত জরুরি। তাই আমি মনে করি মেয়েদের পরিবার থেকেই সহায়তা দেওয়া উচিত।’

দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার আলোকে কানিজ ফাতেমা নারী উদ্যোক্তাদের জন্য কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। তার মতে, যারা উদ্যোক্তা হওয়ার মতো কাজে যুক্ত হতে চান তাদের প্রথমে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এরপর যে বিষয়ে উদ্যোগ নিয়ে কাজ করতে চান, সে সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে হবে। মার্কেট বিষয়ে গবেষণা (রিসার্চ) করতে হবে। এছাড়া যে বিষয়টা নিয়ে কাজ করবেন, তার চাহিদা সম্পর্কে জানতে হবে এবং সঠিক কাঁচামাল নির্বাচন করা জরুরি।

কাজই হচ্ছে কানিজ ফাতেমার ধ্যানজ্ঞান। পরিশ্রম, সততা আর একাগ্রতার জন্যই আজ তিনি সমাজের সফল নারী। অন্য নারীদের জন্য অনুকরণীয়। উদ্যোক্তা হিসেবে তিনি বেশ কয়েকবার স্বীকৃতিও পেয়েছেন। পেয়েছেন উদ্যোক্তা পুরস্কার। এর মধ্যে রয়েছে- ২০১৯ সালে জয়িতা, ২০২১ সালে পাওয়ার উইমেন পদ্মাব্যাংক পুরস্কার, এবং ২০২২ সালে দক্ষিণ এশিয়ার ১০০ সেরা নারী উদ্যোক্তা অ্যাওয়ার্ড-এ ভূষিত হয়েছেন।

ভবিষ্যত পরিকল্পনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সামনে ব্যবসা আরও বড় করার ইচ্ছা রয়েছে। আমি স্বপ্ন দেখি আমার উদ্যোগে হাজারো মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে। গ্রামের নিম্ন-আয়ের নারীরা নিজেরাই উদ্যোক্তা হয়ে উঠবেন। 

এমন পরিকল্পনা নিয়েই ভবিষ্যতের পানে এগিয়ে চলেছেন তিনি। 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
তুরস্কে পারফিউম গুদামে আগুন, নিহত ৬
বিপ্লব ও সংহতি দিবসে মোল্লাহাটে মহিলা দলের কর্মী সমাবেশ
জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস উপলক্ষে নড়াইলে সভা
জাতীয় জুডো প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন বিজিবি
নিহত সেনাদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি অনুষ্ঠানে যোগ দিলেন যুক্তরাজ্যের প্রিন্স জর্জ
লেবাননে ইসরাইলি হামলায় নিহত ৩
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ১৭ বছর পর পূর্ণাঙ্গ কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করবে বলিভিয়া 
ঐতিহাসিক সফরে যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছেছেন সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট শারা
বলিভিয়ার নতুন প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো পাজের দায়িত্ব গ্রহণ
ইঞ্জিনিয়ার পড়ে চাকরি না করে সফল উদ্যোক্তা হলেন কানিজ ফাতেমা
১০