শিরোনাম
প্রতিবেদন : মাসুদ রানা
জয়পুরহাট, ২ জানুয়ারি, ২০২৫ (বাসস) : বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে মিনহাজ ছোটবেলা থেকেই ছিলেন একটু চঞ্চল প্রকৃতির। স্থানীয় রামশালা মাদ্রাসায় পড়াশুনা করতেন তিনি। মাঝে মাঝে মিনহাজ মাদ্রাসা থেকে বাড়িতে আসার কথা বলে বিভিন্ন স্থানে ঘুরাঘুরি করতেন।
বাবা বক্কর সরদার (৪৮) সংসারের সচ্ছলতার জন্য পাড়ি জমান বিদেশে। মা মেরিনা বেগম (২৮) মানসিকভাবে বির্পযস্ত। বেশীরভাগ সময়ে মা থাকেন নানার বাড়িতে। বাসায় মিনহাজকে দেখাশুনা করতো তার জেঠা সিরাজুল ইসলাম (৬৭)। মিনহাজ মাত্র ১০ বছর বয়সে ঢাকাতে যান চাচা আব্দুল কুদ্দুসের বাসায়। মোহাম্মদপুরের চাচার বাসায় থাকার সময় তাকে সেখানেও একটি মাদ্রসায় ভর্তি করানো হয়। কিন্তু সেখানে মিনহাজ পড়াশুনা না করে গার্মেন্টস্ এর কাজ শেখে মাত্র ১৩ বছর বয়সে। সে থেকে গার্মেন্টস্ এ চাকরি করতো মিনহাজ। কিছুদিন পর মিনহাজ চাচাকে কাজের জন্য গাজিপুর যাওয়ার কথা বলে। কারণ গাজিপুরে বেতন বেশি পাবে। পরে গাজিপুর এলাকায় খালার বাসায় থেকে মিনহাজ প্রায় তিন বছর ধরে গার্মেন্টস-এ চাকরি করতো।
গত ২০ জুলাই আন্দোলনের সময় গাজীপুরে শহিদ হন মিনহাজ হোসেন (১৬)।
জয়পুরহাট জেলার আক্কেলপুর উপজেলার দক্ষিণে নওগাঁ জেলার কাছাকাছি সোনামুখী ইউনিয়নের জাফরপুর এলাকার রামশালা গ্রামে জন্ম শহিদ মিনহাজ হোসেনের।
এ ব্যাপারে খোঁজ নেয়ার জন্য মিনহাজের রামশালার বাসায় গেলে তার জেঠা সিরাজুল ইসলাম (৬৭) বাসস’কে বলেন, ‘আমার ভাই বক্কর বিদেশে থাকে।
ভাবিও তার মায়ের বাড়িতে থাকে। মিনহাজ যতদিন এলাকায় ছিল আমার বাসাতেই থাকতো। তাকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছি। সে যে এত অল্প বয়সে আমাদের ছেড়ে চলে যাবে তা বিশ্বাস করতে পারছি না। আল্লাহতায়ালা যেন তাকে জান্নাতের মেহমান করে রাখেন সেই কামনা করছি। তার প্রাণের বিনিময়ে দেশ নতুন করে স্বাধীনতা পেল। এই স্বাধীনতা যেন আমরা ধরে রাখতে পারি।’
এ ব্যাপারে এলাকাবাসী কয়েক জনের সাথে কথা বললে তারা বাসস’কে জানান, মিনহাজ ছিল একটু চঞ্চল ধরনের। সে কোনদিন কারও সাথে খারাপ ব্যবহার করেনি। তার বাবার নিজস্ব কোন জমাজমি, বসতভিটা নাই। যেটুকু বসতবাড়ি ছিল তা বিক্রি করে বিদেশে গেছে। ছেলেটা জেঠা ও জেঠির কাছেই মানুষ হয়েছে। বছর ছয় আগে সে তার চাচা আব্দুল কুদ্দুসের কাছে ঢাকাতে যায়। সেখানে থাকতো মিনহাজ। মাঝে মাঝে এলাকায় আসলে আমাদের সাথে দেখা করে কুশল বিনিময় করতো। তার মা কিছুটা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হওয়ায় তিনি মিনহাজের নানা বাড়িতেই থাকেন। সরকার যদি তার অসহায় মায়ের দিকে একটু নজর দেয়, চিকিৎসার ব্যবস্থা করে, তার বসবাসের জন্য যদি জায়গার ব্যবস্থা করে দেয় তাহলে সন্তানহারা মা কিছুটা হলেও শান্তি পাবে।
এ ব্যাপারে ঢাকায় বসবাসরত শহিদ মিনহাজের চাচা আব্দুল কুদ্দুসের সাথে মোবাইলে কথা বললে তিনি বাসস’কে জানান, গত ২০ জুলাই বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলার সময় মিনহাজ তার বন্ধুদের সাথে গাজিপুরে মিছিলে যায়। সেখানে বেলা সাড়ে ১২ টার দিকে বড়বাড়ি এলাকায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে আহত হয় সে। মিনহাজ আহত হয়ে রাস্তায় পড়ে গড়াগড়ি খেলেও ভয়ে তাকে কেউ সাহায্য করতে পারেনি কিংবা হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থাও করা যায়নি। তার ডান পাঁজরে গুলি লেগে সেখানেই কাতরাতে কাতরাতে মারা যায় মিনহাজ।
তিনি বলেন, বেলা একটার দিকে মিনহাজের মোবাইলে কল দিলে অপরপ্রান্ত থেকে জানানো হয় গুলিবিদ্ধ হয়ে মিনহাজ মারা গেছে। খবর পেয়ে আমি ঢাকা থেকে মোটরসাইকেল ভাড়া করে গাজিপুরের ঘটনাস্থলে যাই। পরে গ্রামের বাড়িতে খবর দেই এবং গাড়ি ভাড়া করে মিনহাজের লাশ নিয়ে ঢাকায়
মোহাম্মদপুর নিজ বাসাই যাই। সেখান থেকে গাড়িতে করে জয়পুরহাটের দিকে রওনা হই। রাতে আক্কেলপুরের রামশালা গ্রামে পৌছাই। পরদিন ২১ জুলাই বেলা ১০ টার দিকে মিনহাজের কাফন শেষে বাড়ির পার্শ্বে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করি।
এ ব্যাপারে পরিবারের সাথে কথা বললে তারা বাসস’কে জানান, ২০ তারিখের পর থেকে কেউ খোঁজ না নিলেও ৫ তারিখে সরকার পরিবর্তনের পর হতে তাদের কাছে অনেকেই এসেছেন। ঢাকা গাজিপুরে যে গামেন্টস্ এ কাজ করতো তাদের পক্ষে তার মাকে ১ লাখ টাকা এবং জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে ১ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। আক্কেলপুর উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৫০ হাজার টাকা, বিএনপি নেতার পক্ষে ১০ হাজার টাকা, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২০ হাজার টাকা এবং বিভিন্ন উপহার সামগ্রীও প্রদান করা হয়েছে তার মাকে।
এ ব্যাপারে জয়পুরহাট জেলা প্রশাসক আফরোজা আক্তার বাসস’কে বলেন, আমি শহিদ মিনহাজ হোসেনের বাড়িতে গিয়ে তার মার সাথে দেখা করে পরিবারের খোঁজ নিয়েছি। তাকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সামান্য কিছু উপহার প্রদান করেছি। মিনহাজের নাম সরকারিভাবে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। আগামীতে সরকারি যে কোন সাহায্য সহযোগিতা পেলে তা দেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।