বাসস
  ০২ জানুয়ারি ২০২৫, ১৪:৩৭
আপডেট : ০৫ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:৫৫

গুলিতে চূর্ণবিচূর্ণ পা, সে সাথে অভাব, বাপ্পির পরিবারের সামনে এখন কেবলই অন্ধকার

প্রতিবেদন:  মোহাম্মদ জিগারুল ইসলাম  

চট্টগ্রাম, ২ জানুয়ারি, ২০২৫ (বাসস) : পিকআপ চালক বাপ্পি মিয়া পঙ্গু হওয়ার পথে। বিছানায় শুয়ে বসেই দিন কাটাচ্ছেন তিনি। তার ডান পায়ের নিচের অংশে এক্সটার্নাল ফিক্সেটর (রড) লাগানো।

গত ৫ আগস্ট বিকেলে গুলিবিদ্ধ হয়ে পায়ের নিচের অংশের হাড় ভেঙ্গে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেছে বাপ্পির। গত পাঁচ মাস ধরে বিছানাই তার ঠিকানা। আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশিদের সহযোগিতা পেলেই কেবল তাদের মুখে ভাত ওঠে। স্ত্রী রোজি আক্তার (২২) ও তিন মেয়েকে নিয়ে ঘোর অমানিশায় কাটছে তার দিন। বাপ্পির পরিবারের সামনে এখন শুধুই অন্ধকার। ঘটনার পাঁচ মাস পেরিয়ে গেছে। সরকারিভাবে এখনো কোন সহযোগিতা পায়নি পরিবারটি।

বাসস’কে বাপ্পি মিয়া (৩২) বলেন, গত ৫ আগস্ট বিকেল পাঁচটার দিকে ঢাকা থেকে গাড়ি চালিয়ে আসি। চট্টগ্রাম নগরীর মনসুরাবাদ পুলিশ লাইন সংলগ্ন ট্রাক স্ট্যান্ডে গাড়িটি নিরাপদে রাখি। এরপর টুকটাক মেরামত কাজ সেরে বাসায় ফেরার জন্য প্রস্তুতি নেই। ইতোমধ্যে ঢাকা থেকে ফেরার পথে রাস্তায় দেখেছি অনেকগুলো বিজয় মিছিল। স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে গেছেন সেই আনন্দে নিজেও উদ্বেলিত ছিলাম। এ সময় ঢাকা ট্রাঙ্ক রোড হয়ে চট্টগ্রাম নগরীর দেওয়ানহাটের দিকে যাচ্ছিল হাজার হাজার মানুষের একটি বিজিয় মিছিল। মিছিলের উত্তাল শ্লোগানের সাথে ট্রাক স্ট্যান্ডের পাশে দাঁড়িয়ে আমিও গলা মেলাচ্ছিলাম। হঠাৎ পাশের একটি সুউচ্চ ভবনের উপর থেকে এলোপাতাড়ি গুলি ছোঁড়া শুরু হয় মিছিল লক্ষ্য করে। ছাত্রলীগ ও যুবলীগের ছেলেরাই এই গুলি ছোঁড়ে। আমি পালানোর চেষ্টা করি, কিন্তু বেশিদূর এগুতে পারিনি। একটি গুলি এসে লাগে আমার ডান পায়ের হাঁটুর নিচে। গুলি একপাশ দিয়ে ঢুকে অপর পাশ দিয়ে বের হয়ে যায়। গুলির আঘাতে রক্তাক্ত ও বিধ্বস্ত পা টেনে আর এগুতে পারছিলাম না। রক্তাক্ত অবস্থায় অনেকক্ষণ পড়ে থাকার পর একজন ছাত্র এগিয়ে এসে আমাকে উদ্ধার করে এবং স্ত্রী রোজি আক্তারকে খবর পাঠায়।

বাপ্পি মিয়ার বাবা ইদ্রিছ মিয়া (৮২) দিনমজুরের কাজ করেন। তারা থাকেন মনসুরাবাদ মিয়া বাড়ি রোডের বাবুল কন্ট্রাক্টরের ভাড়া বাসায়। তার আরেক ছেলে সাইফুলও (২৫) এদিন মনসুরাবাদ এলাকায় বাম হাতে গুলিবিদ্ধ হয়। সেও পিকআপ চালক। দুই সন্তানের একসাথে গুলিবিদ্ধের ঘটনায় হতবিহ্বল হয়ে পড়ে ইদ্রিছের পরিবার। তবে সাইফুল এখন সুস্থ হয়েছেন। ১৫দিন ধরে পিকআপ চালাচ্ছেন বলে জানান বৃদ্ধ ইদ্রিছ মিয়া।

সম্প্রতি বাবুল কন্ট্রাক্টরের ভাড়া বাসায় বাপ্পির স্ত্রী রোজি আক্তার বাসস’কে বলেন, ঘটনার দিন সন্ধ্যা ছয়টার দিকে একটি ব্যাটারিচালিত রিকশায় করে বাপ্পিকে নিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পৌঁছাই। জরুরি বিভাগের সামনে একটি স্ট্রেচারে সাড়ে সাতটা পর্যন্ত শুইয়ে রাখা হয়। অনেক আকুতি করার পরও কোন চিকিৎসক ও নার্স তাকে দেখতে আসেনি। শুধুই অপেক্ষা করতে বলেছে। রাত আটটার দিকে জরুরি বিভাগের এক চিকিৎসক এসে পায়ে ব্যাণ্ডেজ দিয়ে কোন রকমে রক্তটা বন্ধ করেন। ইতোমধ্যে রক্তের বন্যা বয়ে গেছে স্ট্রেচারে। এরপর হাসপাতালে কোন সিট না দিয়ে জরুরি বিভাগের সামনেই ফেলে রাখা হয়।

রোজি আক্তার আরো বলেন, সে প্রচণ্ড ব্যথায় কাতরাচ্ছিল। আশপাশের লোকজন থেকে ধার দেনা করে নেয়া ২ হাজার ৫’শ টাকার মধ্যে ঔষধ কিনতেই চলে গেছে ১৬’শ টাকা।

আমার কাছে এমন কোন টাকা ছিল না যে প্রাইভেট হাসপাতালে নিয়ে যাব। রাত ১টা পর্যন্ত অপেক্ষা করে হাসপাতালে সিট না পেয়ে স্বামীকে নিয়ে বাসায় চলে আসি। পায়ের ব্যথায় সে ঘুমাতে পারেনি। দু’দিন পর দেখি মাংসে পচন ধরে সেখান থেকে পুঁজ পড়ছে। স্থানীয়দের পরামর্শে দেওয়ানহাট এলাকার ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধি ইফতেখার হোসাইনের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি ৯ আগস্ট বাপ্পিকে নিয়ে পুনরায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দেন। ৩১ আগস্ট আগস্ট পায়ের অপারেশন সম্পন্ন হয়। পরে ৩ সেপ্টেম্বর হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র নিয়ে বাসায় চলে আসি।

বর্তমানে আহত বাপ্পি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের স্পোর্টস মেডিসিন এন্ড আর্থ্রোস্কপি বিভাগের সহকারি অধ্যাপক ডা. মো. বুলবুল আহমেদের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসাধীন আছেন বলে জানান রোজি।

মুঠোফোনে বাপ্পির বিষয়ে জানতে চাইলে ডা. মো. বুলবুল আহমেদ বাসস’কে বলেন, বাপ্পির ডান পায়ের নিচের অংশে গুলি একপাশ দিয়ে ঢুকে অপর পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেছে। তার পায়ের হাড় ভেতরে ভেঙ্গে চূণর্-বিচূর্ণ হয়ে গেছে। অপারেশন করে রিং এক্সটার্নাল ফিক্সেটর (রড) খাঁচা লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। এভাবে আট মাস রাখতে হবে। এ সময়ে সে হাঁটাচলা করতে পারবে না। তারপর আবারও অপারেশন লাগতে পারে।

বাপ্পি মিয়া বলেন, ভাড়া বাসার একটি রুমে আবদ্ধ আমার জীবন। বড় মেয়ে নিশা আক্তার (১৪) মিয়া বাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৫ম শ্রেণির ছাত্রী, মেজ মেয়ে টিশা আক্তার (৮) ২য় শ্রেণিতে আর ছোট মেয়ে ইয়ামিন আক্তার চার বছর বয়সী। স্ত্রী রোজী আক্তার এখন সন্তান সম্ভবা। স্ত্রী আগে একটি গার্মেন্টসে চাকরি করতেন। অসুস্থতার কারণে চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। এরপর আমার এই বিপদ।

গুলিবিদ্ধ হবার পর জামায়াত ইসলামী থেকে ৩০হাজার টাকা ও আকিজ গ্রুপ থেকে ৩০হাজার টাকা সহযোগিতা পাওয়ার কথা জানান তিনি।

বাপ্পি বলেন, এছাড়া শিল্পকলা একাডেমিতে ডেকে নিয়ে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে ১০হাজার টাকা দেয়া হয়েছে। চট্টগ্রাম মেট্টোপলিটন হাসপাতালের ডা. মো. ইরফান চৌধুরী আমাকে একটি হুইল চেয়ার দিয়েছেন। সরকারিভাবে এখনো কোন সহযোগিতা পাইনি। যেটুকু সহযোগিতা পেয়েছি সব টাকা ইতোমধ্যে চিকিৎসায় শেষ হয়ে গেছে।

ছল ছল চোখে হতাশা ব্যক্ত করে বাপ্পি মিয়া এই প্রতিবেদককে আরও বলেন, আমি এখন একরকম পঙ্গুর মতো। আমার পরিবার কিভাবে চলবে, মেয়েদের লেখাপড়া, খাওয়া দাওয়া কেমনে চলবে। খাবার খরচ এবং ঘরভাড়া দিতে না পারায় বাবার অভাব অনটনের সংসারে বোঝা হয়ে না থেকে ইতোমধ্যে একমাস ফেনী গিয়ে শ্বশুরের বাসায়ও আশ্রয় নিয়েছিলাম। আত্মীয়ের বাসায় আর ক’দিনই বা থাকা যায় বউ বাচ্চা নিয়ে। বিবেক তো বাধা দেয়। এখন আবার বাবা-ভাইয়ের আশ্রয়ে আসছি। চলার মতো কোন টাকা-পয়সা হাতে নেই। নিজের চিকিৎসার জন্য জমানো টাকাগুলোও বাবা আমাকে দিয়ে দিয়েছেন। এখন সেগুলোও শেষ। প্রথম প্রথম প্রতিবেশি ও স্বজনরা সহযোগিতা করলেও এখন আর কেউ তেমন খবর রাখে না।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে অনুরোধ জানিয়ে বাপ্পি মিয়া বাসস’কে বলেন, শেখ হাসিনার পতনের কারণে আজ দেশ স্বৈরাচারমুক্ত হয়েছে। কিন্তু আমরা যারা স্বৈরাচার সরকারের পুলিশ ও সন্ত্রাসী দ্বারা আক্রান্ত হয়েছি তাদের পরিবারের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা যাতে সরকার করেন। যেন আমার অনাগত সন্তানসহ পরিবারকে কষ্ট সহ্য করতে না হয়।

বাপ্পি মিয়ার বাবা ইদ্রিস মিয়া দুই ছেলের গুলিবিদ্ধ হবার কারণে তাদের দরিদ্র পরিবারের দুর্দশার কথা বলতে গিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠে বলেন, আমার পাইলসের সমস্যা অনেকদিন ধরে। ডাক্তার আমকে অপারেশন করতে বলেছিল। দু’বছর ধরে সঞ্চয় করে ৪০ হাজার টাকা জমিয়েছিলাম। কিন্তু ছেলের দিকে তাকাতে পারছি না, তাই আমার জমানো ৪০ হাজার টাকাও ছেলের চিকিৎসার জন্য দিয়ে দিছি। ছোট ছেলে সাইফুল এখন সুস্থ হয়ে গাড়ি চালাচ্ছে। তবে গুলিবিদ্ধ হবার কারণে তার বাম হাতে জোর কম। ছেলেকে যেন পঙ্গুত্ববরণ করতে না হয় সেজন্য উন্নত চিকিৎসা নিশ্চিত এবং ক্ষমতার লোভে সাধারণ মানুষকে হত্যাকারী ও সন্ত্রাসীদের বিচার নিশ্চিত করতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে দাবি জানান তিনি।