শিরোনাম
প্রতিবেদন : বরুন কুমার দাশ
ঢাকা, ৭ জানুয়ারি, ২০২৫ (বাসস) : আস্তে দৌড়া। সামনে আগানো রিস্ক। জাহিদ উত্তর দেয়, তোরা যাইলে যা গা, যাহ্,আমি প্রয়োজনে শহিদ হমু। তবু সামনেযামু। এই বলে সে সামনের দিকে এগিয়ে যায়।
গত ১৯ জুলাই আন্দোলনে অংশ নিয়ে জাহিদ হোসেন তার বন্ধুদের দৃঢ়তা ও সাহসের সঙ্গে এসব কথা বলেছিলেন।
রাজধানীর নাখালপাড়ার বাসায় রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাসস’র প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে শহিদ জাহিদ হোসেনের মা রাহেলা বেগম সেই দিনের আন্দোলনে অংশগ্রহণ করা বন্ধুদের বরাত দিয়ে এসব কথা জানান ।
তিনি বলেন, সেদিন ছিল ১৯ জুলাই। চারদিকে মুহুর্মুহু গুলির শব্দ। শব্দে কেঁপে উঠছিল মহাখালী রেলগেট ও আশেপাশের এলাকা। কিছুক্ষণ পরপরই পুলিশের পক্ষ থেকে ছোঁড়া হচ্ছিল একের পর এক সাউন্ড গ্রেনেড।
বিকেল ৪টায় আমার সঙ্গে বাইরে বের হয়েছিল জাহিদ। একটু পরেই দৌড়ে চলে যায় বন্ধুদের কাছে।’
এরপর জাহিদ বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে পৌঁছালেন আন্দোলনের অগ্রসারিতে। অবস্থা বেগতিক দেখে বন্ধুরা পেছনে ফিরতে চাইলেন, কিন্তু ১৮ বছর বয়সী উদ্যমী বীর বন্ধুদের জানালেন, ‘তোরা যা গা, আমি প্রয়োজনে শহিদ হমু’।
রাহেলা বেগম বলেন, এই কথাটি বলেই আরও সামনে চলে যায় জাহিদ। চলে যায় রেলগেট-সংলগ্ন মহাখালী ফ্লাইওভারের নিচে। এ সময়ে ফ্লাইওভারের উপর থেকে ছোঁড়া গুলি লাগে জাহিদের মাথায়। কিছুটা শক্তি নিয়ে কতোক্ষণ ঠাঁয় দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। কিন্তু সেই অবস্থা আর বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। মাথায় গুলিবিদ্ধ জাহিদকে বেদম মারধর করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। মৃত্যু নিশ্চিত হওয়া পর্যন্ত সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকেন পুলিশ সদস্যরা।
রাজধানীর নাখালপাড়া রেললাইনের পাশেই টিনশেডের এক রুমের ছোট্ট একটা বাসায় ভাড়া থাকে জাহিদের পরিবার। তিন ভাই-বোনের মধ্যে জাহিদ হোসেন দ্বিতীয়। জাহিদের বাবা জাহাঙ্গীর আলম (৪৫) এবং মা রাহেলা বেগম (৪১)। জাহিদের বড় ভাই রাহাত হোসেন (১৯)। সে এই বছর এইচএসসি পাশ করেছে। ছোট বোন নুসরাত (৮) পড়ে স্থানীয় একটি স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণীতে। আর্থিক অনটনে ক্লাস সেভেন পর্যন্ত পড়ালেখা করে জাহিদ। ফুলের ব্যবসা করে বাবার সাথে পরিবারে অর্থের জোগান দিতো।
সেদিনের ঘটনার বর্ণনা করতে গিয়ে জাহিদের মা রাহেলা বেগম আরও বলেন, পশ্চিম নাখালপাড়ার রেললাইনের পাশে চারতলার চিলেকোঠায় টিনশেডের একটি ঘরে আমরা ভাড়া থাকি। বাসাটির পূর্বদিকের জানালায় তাকালে দেখা যায় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের টোল প্লাজা। উত্তরের জানালায় দেখা মেলে মহাখালী রেলগেট। জুলাই আন্দোলনে এই দুইটি স্পট প্রতিদিনই ছিল উত্তপ্ত। এই এলাকায় ছাত্র-জনতার ওপর গুলি ছোঁড়া হয়, ১৮ জুলাই থেকে। সেদিনও নিজেকে সামলাতে পারেনি জাহিদ।
তিনি বলেন, বড় ভাইকে নিষেধ করে নিজেই প্রতিদিন আন্দোলনে চলে যেত সে। ১৮ জুলাই পুলিশের ছররা গুলিতে আহত হয় জাহিদ। কিন্তু বাসায় এসে কাউকে কিচ্ছু জানায়নি।
বাসার কেউ টেরও পায়নি যে ওর গায়ে ছররা গুলি লেগেছে। পরদিন ১৯ জুলাই সকাল সাড়ে ১০টার দিকে আবার চলে যায় মহাখালী রেলগেট আন্দোলেনের স্পটে। এদিন ওর বাবা গিয়ে ধমকিয়ে আন্দোলন থেকে নিয়ে আসে বাসায়। আমি ওকে ঘরে আটকিয়ে রেখে তালা মেরে দেই।
রাহেলা বেগম বলেন, ১৯ জুলাই জুমার দিন হওয়ায় নামাজের সময় বের হতে দেই। নামাজে যাওয়ার আগে সবচেয়ে পছন্দের সাদা রংয়ের পাঞ্জাবিটা পরে। নামাজ শেষে ঘরে ফিরলে আমি ওকে ভাত খেতে দেই। ভাত খায়। তারপর আমার পায়ের ওপর মাথা দিয়ে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকে। এরপর নিজেই উঠে গিয়ে একটা চিরুনি এনে আমাকে বলে মাথাটা আঁচড়িয়ে দিতে। আমি চুল আঁচড়ে দেই।
তিনি বলেন, এর ঘন্টাখানেক পর বাসা থেকে পুলিশের গুলিবর্ষণের আওয়াজ শুনতে পাই। মা-ছেলে বাসার সামনে এসে দূর থেকে দেখতে চেষ্টা করি কি হচ্ছে রাস্তায়। জাহিদ তখন আমার পাশে। কিছুক্ষণ পর দেখি জাহিদ আমার পাশে নাই। মুহূর্তের মধ্যে কোথায় গায়েব হয়ে গেল ছেলে, দুশ্চিন্তায় পড়ে যাই আমি। আবার আন্দোলনে চলে গেল কিনা, আল্লাহ জানে! চারিদিকে গোলাগুলির আওয়াজ।
রাহেলা বেগম বলেন, জাহিদ দৌড়ে চলে যায় ফ্লাইওভারের নিচে। পুলিশ তখন উপর থেকে ছাত্র-জনতাকে লক্ষ্য করে বৃষ্টির মতো গুলি ছুঁড়ছিল। ছাত্র-জনতা গুলির বিপরীতে ইটপাটকেল ছুঁড়ে প্রতিরোধ চালাচ্ছিল। পুলিশের পাশে অবস্থান নেয় ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতাকর্মীরা। জাহিদ ফ্লাইওভারের নিচে থেকে পাশে ফুটওভারের দিকে যায়, ঠিক তখনি গুলি এসে লাগে তার মাথায়। তখন পুলিশের পাশে থাকা লাঠিসোঁটা, দেশীয় অস্ত্র হাতে হেলমেট পরা ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা দৌড়ে এসে গুলিবিদ্ধ জাহিদকেবেদম পেটাতে থাকে। মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার আগ পর্যন্ত ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা পেটায় জাহিদকে। পিটিয়ে তার সারা শরীর থেঁতলে ফেলে। জাহিদকে মেরে আবার ব্যাকফুটে চলে যায় ছাত্রলীগ। একজন পুলিশ সামনে এসে লাথি মেরে উল্টিয়ে দেখে এখনও বেঁচে আছে কি না। মৃত্যু নিশ্চিত হলে সরে যায় তারা।
জাহিদের নিথর দেহ পড়ে থাকে রাস্তায়। পুলিশ সরে গেলে আশপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাওয়া, ফুটওভারের ওপারে থাকা মানুষজন এসে জাহিদকে ধরাধরি করে নিয়ে যায় ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। মেডিকেলে নিয়েও তার ব্লিডিং বন্ধ করা যায়নি।
এদিকে আনুমানিক ৬টার দিকে খবর পেয়ে হাসপাতালে ছুটে যান বাবা জাহাঙ্গীর। কিন্তু ছেলের লাশ বুঝে পেতে শুরু হয় বিপত্তি। পুলিশের একটা দল চেষ্টা করে হাসপাতাল থেকে লাশ গুম করে ফেলতে। এটা টের পেয়ে উপস্থিত জনতা ও জাহিদের বন্ধুরা মিলে হাসপাতালের ট্রলিসহ জাহিদের লাশ বের করে পাশের একটা গলিতে লুকিয়ে ফেলে।
সন্ধ্যার পর জাহিদের লাশ নিয়ে আসা হয় নাখালপাড়া এলাকার শাহীনবাগ জামে মসজিদে। কিন্তু মসজিদ কর্তৃপক্ষ ভয়ে লাশ গোসল করাতে অস্বীকৃতি জানায়। পরে লাশ নিয়ে যাওয়া হয় পাশের হাজী মরণ আলি মাদ্রাসা কমপ্লেক্সে। সেখানে রাতের বেলা গোসল ও জানাজা শেষে রহিম মেটাল কবরস্থানে দাফন করা জাহিদকে।
ছোট ছেলের লাশ দাফন করতে না করতে শুরু হয় নতুন বিপদ। বড় ছেলেকে ধরে নিতে বাসায় আসে পুলিশ। ঐ সময় তখন এলাকাভিত্তিক ব¬ক রেইড দিয়ে ডিবি গণহারে গ্রেফতার চালায়।
আতঙ্কে ঢাকা ছেড়ে পালিয়ে গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরের ইসলামপুরে চলে যায় পুরো পরিবার। গ্রামের বাড়ি গিয়েও স্বস্তি নাই। সেখানেও দৌড়ঝাঁপ শুরু করে পুলিশ।
জাহিদের বড় ভাই রাহাতকে ধরতে গ্রামে গিয়েও হানা দেয় তারা।
এদিকে ঢাকায় জাহিদদের বাসার আশপাশের ১৪-১৫ বছর বয়সী তার বন্ধুদের ধরে নিয়ে নির্যাতন করে পুলিশ। প্রায় ৫-৬ জনকে ধরে নিয়ে যায়। তাদের কাছ থেকে জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি নিতে চেষ্টা করে যে তারা বিএনপির ইন্ধনে আন্দোলনে যাচ্ছে এবং জাহিদের বড় ভাই কোথায় আছে তার ঠিকানা দিতে।
জাহিদের বড় ভাইয়ের বয়স ১৯ হলো সবেমাত্র। এইচএসসি পাশ করেছে। ১৪-১৫ বছর বয়সী যে ছেলেগুলোকে ধরে নিয়ে পুলিশ নির্যাতন চালিয়েছিল ওদের নামের পাশে লিখেছিল, ইমন (কিশোর বিএনপি), রাকিব (কিশোর বিএনপি) এভাবে।
ব্লক রেইড চলাকালে পুরো নাখালপাড়া (আরজতপাড়া) এলাকা পুরুষ শূন্য হয়ে যায়। যে যেভাবে পারে বাসাবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে অন্যত্র আশ্রয় নেয়।
জাহিদের বাবা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘এখন ছেলের কথা স্মরণ করে ওর মা সারাদিন কাঁদে। ছেলের পরা শেষ ড্রেস সাদা পাঞ্জাবিটা হাতে নিয়ে নাকের কাছে ঘ্রাণ নেয়। ছেলের ছবিতে বারবার চুমু খায়। ছেলের স্মৃতিগুলো মনে করে করে বিলাপ করতে থাকে সারাদিন। শহিদ হওয়ার দিনও দুপুরে মাকে বাসনকোসন মেজে দিয়েছিল। ছেলেটার আয়েই চলতো পরিবার।
জাহিদের বড় ভাই রাহাত হোসেন জানান, গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর জাহিদ উঠে দাঁড়ায়, চেষ্টা করছিল আন্দোলনে টিকে থাকার। কিন্তু তখন কয়েকজন এসে তাকে মারধর করতে থাকে। পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল পুলিশ সদস্যরা। মাথায় গুলিবিদ্ধ জাহিদ মরধরের পর মারা গেলে পুলিশের এক সদস্য পা দিয়ে জাহিদের শরীর উল্টেপাল্টে দেখে। মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর তারা সেখান থেকে চলে যায়।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে রাহাত বলেন, জাহিদ নিজে আন্দোলনে অংশ নিলেও বড় ভাইকে আন্দোলনে যেতে নিষেধ করে বলেছিল, ‘তুমি থাক আব্বু আম্মুকে দেখতে।’
এ ঘটনায় কোনো মামলা করেছেন কি না এমন প্রশ্নের জবাবে জাহিদের বাবা জাহাঙ্গীর বলেন, ‘পুলিশ বিভিন্নভাবে হয়রানি শুরু করলে আমরা গ্রামে চলে যাই। সরকার পতনের পর ঢাকায় ফিরেছি। পরে ৩০ সেপ্টেম্বর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, শ্রমিকলীগের অজ্ঞতনামা প্রায় ২০০ থেকে ৩০০ জন এবং প্রায় ১০০ থেকে ১৫০ জন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে তেজগাঁও থানায় মামলা করি।’
তিনি বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। এই এলাকায় থাকতে হবে। কারও সঙ্গে শত্রুতা করতে চাই না। আমার ছেলেকে পুলিশ এবং সেদিন রাস্তায় থাকা ছাত্রলীগ মেরেছে। আমি তাদের বিচার চাই। যারা নির্দোষ, তাদের আসামি করে জাহিদের আত্মাকে কষ্ট দিতে চাই না। আমার ছেলে দেশের জন্য শহিদ হয়েছে, জান্নাতে আছে। সেখানে শান্তিতে থাকুক।
জাহিদ নিহতের পর ছাত্র বা সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সহায়তা পেয়েছেন কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সহায়তা পাইনি।
কিছুদিন আগে জামায়াতে ইসলামীর নেতারা এসেছিলেন। আমাদের খোঁজখবর নিয়েছেন। এরপর এক লাখ টাকা সহায়তা দিয়েছেন। অন্যকেউ আসেনি, খোঁজখবরও নেয়নি।’