
বেলাল রিজভী
মাদারীপুর, ২৪ অক্টোবর, ২০২৫ (বাসস): গ্রামের কারও বিয়ে বা কোনো অনুষ্ঠান হলে রাতে দীঘির পাড়ে গিয়ে থালা-বাসন, হাঁড়ি-পাতিলসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র চাইলে ভোরে সেগুলো ভাসতে দেখা যেত। অনুষ্ঠান শেষে দীঘির পাড়ে রেখে গেলে রাতের অন্ধকারে তা আবার মিলিয়ে যেত। এখনও মনের বাসনা পূরণে অনেকেই মানত করে এই দীঘিতে গোসল করেন। তাদের মনের বাসনা নাকি পূরণও হয়। এই দীঘি ঘিরে এমন অনেক চমৎকার রূপকথা রয়েছে। এটি মাদারীপুরের ডাসার উপজেলার খাতিয়াল গ্রামের সেনাপতির দীঘির গল্প।
স্থানীয়রা জানান, প্রতিনিয়ত মানতের জন্য দীঘিটির পাড়ে এখনও গোসলের জন্য ভিড় লেগে থাকে। এখানে কেউ মানত করেন রোগমুক্তির জন্য, কেউ মানত করেন সন্তান লাভের জন্য, কেউ আবার স্বামীর সংসারে শান্তি লাভের জন্য। প্রায় সাড়ে তিনশো বছর ধরে এভাবেই এখানে মানত করে আসছেন বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা মানুষেরা।
তাদের দাবী, কেউ মানত করে খালি হাতে ফিরে যায়নি এখান থেকে। যে নিয়তে মানত করে দীঘিতে গোসল করা হয়, সেই নিয়তই পূরণ হয়ে যায়। মনের আশা পূরণের জন্য গোসল শেষে পাশে থাকা মসজিদে দুই রাকাত নামাজ পড়েন অনেকেই।
স্থানীয় হামিদ মোল্লা (৫০) বলেন, আমরা ছোট বেলা থেকেই দেখে আসছি এই দীঘিতে অনেকেই মনের আশা পূরণে মানত করে। মানত করে দীঘিতে গোসল করে। কারো মনের আশা হয়ত পূরণও হয়। এটা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে।
আরেক বাসিন্দা সমির মিয়া (৬৫) বলেন, মুরব্বীদের কাছে শুনেছি আগে গ্রামের কারো বিয়ে বা কোনো অনুষ্ঠান হলে তাদের প্রয়োজন মতো রাতে দীঘির পাড়ে থালা-বাসন, হাঁড়ি-পাতিলসহ বিয়ের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র চাইলে ভোরে দীঘিতে সেসব ভেসে উঠতো। কাজ শেষে আবার ফেরত দিয়ে দিতে হত। কিন্তু একবার কিছু হাঁড়ি পাতিল চুরি হয়ে যায়, এরপর থেকে আর সেগুলো চাইলেও পাওয়া যায় না।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, সুবেদার শায়েস্তা খানের জ্যেষ্ঠপুত্র উমেদ খানের নেতৃত্বে ২৮৮জন সৈনিক নদী পথে যাত্রা করেন। চট্টগ্রাম বিজয়ের পর কিছু উৎসাহী সৈন্য বরিশাল ও পটুয়াখালী থেকে মগ সৈন্যদের বিতাড়িত করতে নৌ-অভিযান করেন। সেখান থেকে ফেরার সময় ডাসারের খাতিয়ালে বিশ্রাম নেন। এ সময় তাদের পানির সমস্যা দেখা দেয়। তখন এ দীঘিটি খনন করা হয়।
জানা গেছে, ১৬৬৫ সালের ২৪ ডিসেম্বর মুঘল আমলে শায়েস্তা খাঁর বড় ছেলে বুজুর্গ উমেদ খাঁর বিশ্বস্ত সেনাপতি ইসলাম খাঁ এই দীঘি খনন করেন। এ দীঘির আয়তন ৬০ হাজার ৭০৩ বর্গমিটার, দৈর্ঘ্য ২৮৮ মিটার ও প্রস্থ ১৫৭ মিটার। গভীরতা গড়ে প্রায় ১০ মিটার। পাড়ের উচ্চতা ১৩.৫ মিটার। প্রায় সাড়ে ৩শ’ বছর ধরে নিজ মহিমায় কালের সাক্ষী হয়ে আজও টিকে আছে দীঘিটি।
কালকিনি সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজের ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রাহাত হোসাইন বলেন, সেনাপতির দীঘি মুঘল আমলে খনন করা হয় যা এখনও টিকে আছে।
প্রশাসনের প্রতি অনুরোধ থাকবে যাতে কেউ এই দীঘি দখল করতে না পারে। এছাড়াও এই দীঘিকে কেন্দ্র করে সুন্দর একটি পর্যাটন কেন্দ্র গড়ে তোলা সম্ভব।
মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক (ভারপ্রাপ্ত) হাবিবুল আলম বলেন, ইতিহাস ঐতিহ্য সংরক্ষণে প্রশাসন সচেষ্ট রয়েছে। যেহেতু দীঘিটি অনেক পুরোনো ও ইতিহাসের সঙ্গে সম্পর্ক যুক্ত তাই এটির প্রতি আমাদের আলাদা নজর রয়েছে।