
মোহা. শরিফুল ইসলাম
চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ২৪ অক্টোবর, ২০২৫ (বাসস) : সোনামসজিদ ৫০০ বছরের ইতিহাসের সাক্ষী ও পর্যটকদের পছন্দের শীর্ষে থাকা ঐতিহাসিক স্থাপত্য নিদর্শন। এর অপূর্ব স্থাপত্যশৈলী দেশ-বিদেশের ভ্রমণপিপাসুদের আকর্ষণ করে। গৌড় নগরীর ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা সোনামসজিদ দেশের ইসলামি স্থাপত্যের অন্যতম গৌরব। মধ্যযুগীয় সুলতানি আমলের এ স্থাপনাটি আন্তর্জাতিক পর্যটকদের কাছেও গুরুত্বপূর্ণ দর্শনীয় স্থান।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার শাহাবাজপুর ইউনিয়নের পিরোজপুর গ্রামে অবস্থিত মসজিদটি রাজশাহী শহর থেকে প্রায় ৮৫ কিলোমিটার দূরে। সোনামসজিদ স্থলবন্দরের একটু আগেই মহাসড়কের ডান দিকে বড় দিঘির পাড়ে মসজিদটি অবস্থিত। মসজিদটি নির্মিত হয় বাংলার স্বাধীন সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ (১৪৯৩-১৫১৯ খ্রি:) এর শাসনামলে। প্রধান প্রবেশ পথের উপরিভাগে স্থাপিত একটি শিলালিপি অনুযায়ী জনৈক মজলিস-ই-মাজালিস মজলিস মনসুর ওয়ালী মুহম্মদ বিন আলী কর্তৃক মসজিদটি নির্মিত হয় বলে ধারণা করা হয়।
১৮৯৭ সালে প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্পে ধ্বংসলীলার পর ১৯০০ সালে ব্রিটিশ সরকার এগুলো সংস্কার করে। তবে কিছু অংশে পাথরের বদলে ইট ব্যবহৃত হয়।
মসজিদটি ইট দিয়ে তৈরি। তার ওপর পাথরের একটি স্তর বসানো আছে। মসজিদের বাইরের পরিমাপ ৮২ ফুট বাই সাড়ে ৫২ ফুট, ভেতরের পরিমাপ ৭০ ফুট ৪ ইঞ্চি বাই ৪০ ফুট ৯ ইঞ্চি। উচ্চতা প্রায় ২০ ফুট। মধ্যবর্তী তিনটি নামাজের স্থানে খিলান করা চার খণ্ড ছাদ তৈরি করে মাঝখানে এনে মিলিয়ে দেওয়া হয়েছে। তার দুপাশের প্রতি অংশে আছে ছয়টি করে গোলাকার গম্বুজ। এই বারোটির পাশাপাশি চৌচালা গম্বুজ আছে তিনটি। মাঝখানে অবস্থিত এই চৌচালা গম্বুজগুলোর ভেতরের দিকে গোলাপ ফুলের মতো কারুকার্য করা।
মসজিদের চারদিকে চারটি বুরুজ (স্তম্ভ) রয়েছে। এগুলোর ভূমি অষ্টকোনাকৃতির। বুরুজগুলোতে ধাপে ধাপে বলয়ের কাজ আছে। বুরুজগুলোর উচ্চতা ছাদের কার্নিশ পর্যন্ত।
মসজিদের সামনে পাঁচটি এবং ডানে ও বাঁয়ে দুই পাশে তিনটি করে দরজা রয়েছে। প্রতিটি দরজারই কিনারায় আছে বেশ চওড়া করে খোদাই করা কারুকাজ। দরজার পাশের দেয়ালগুলোতেও খোদাই করা কারুকাজ রয়েছে।
মসজিদের প্রবেশপথের পাথরের তোরণটিও সুদৃশ্য কারুকার্যময়। এই তোরণের সামনেই রয়েছে সেই আমলের সারি সারি কবর। সবই পাথর দিয়ে বাঁধানো।
মসজিদের অলংকরণের ক্ষেত্রে খোদাইকৃত পাথর, ইটের বিন্যাস, পোড়ামাটির ফলকের গিল্টি ও চকচকে টালি ব্যবহৃত হয়েছে। তবে এগুলোর ভেতর প্রাধান্য পেয়েছে খোদাইকৃত পাথর।
মসজিদটির দক্ষিণ-পূর্ব কোণে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের শহীদ বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর ও শহীদ মেজর নাজমুল হক টুলুর কবর যা পর্যটকদের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। এসব দেশে মোহিত হন পর্যটকরা।
বগুড়ার নন্দীগ্রাম থেকে সোনামসজিদ দেখতে আসা কায়েস আলী বলেন, ছোটবেলা থেকে সোনামসজিদের গল্প শুনেছি, বইয়ে পড়েছি। আজকে সামনাসামনি দেখলাম। খুবই ভালো লাগলো। সত্যিই খুব সুন্দর জায়গা।
রাজশাহীর বাঘা থেকে আসা মাইনুল ইসলাম দিপু বলেন, ছোটবেলা থেকেই ইচ্ছে ছিল সোনামসজিদ দেখবো। তাই এসেছি। এখানে নামাজ আদায় করলাম। আশেপাশে সবকিছু ঘুরে দেখলাম। সবকিছু মিলিয়ে খুব ভাল লাগলো।
ইতিহাসের সাক্ষী এই অপূর্ব স্থাপত্যশৈলী শুধু দেশের পর্যটকদের আকৃষ্ট করে না, বিদেশের ভ্রমণপিপাসুদেরও আকর্ষণ করে। বিভিন্ন সময়ে এখানে বিদেশি পর্যটকদের উপস্থিতিও চোখে পড়ে।
এখানে সোনামসজিদ ছাড়াও দারাসবাড়ি মসজিদ ও মাদ্রাসা, খঞ্জন দিঘির মসজিদ, তহখানা কমপ্লেক্স, তিন গম্বুজ মসজিদ, শাহ নিয়ামতউল্লাহর মাজার ও ধনিয়াচক মসজিদের মত ইতিহাসের সাক্ষী স্থাপত্যশৈলী রয়েছে।
কথা হয় স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে। তারা সুলতানি আমলের স্থাপত্য সোনামসজিদটির অস্তিত্ব ও ঐতিহ্য রক্ষার দাবি জানান।
স্থানীয় বাসিন্দা ইউসুফ আলি বলেন, সোনামসজিদের পাশ দিয়েই সরকারি রাস্তা, একটু দূরেই স্থলবন্দর। সারাক্ষণ ভারী ট্রাক যাতায়াত করে। ট্রাকগুলো খুব দ্রুত গতিতে চলার কারণে মাঝে মধ্যে মনে হয় যেন ভূমিকম্প হচ্ছে।
উপজেলার শাহবাজপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা কবির আলি বলেন, আমাদের শাহবাজপুর ইউনিয়নে সোনামসজিদ ছাড়াও আরও কয়েকটি ঐতিহাসিক স্থাপত্য আছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এইসব স্থাপনায় যাতায়াতের উন্নত সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা নেই। পর্যাপ্ত টয়লেট ও বিশ্রামাগারের ব্যবস্থা নেই। ইতিহাসের সাক্ষী এইসব স্থাপনা দেখতে এসে অনেক দর্শনার্থী নানা সমস্যার অভিযোগ করেন।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের সড়ক ও জনপথ বিভাগের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. আসিফ বলেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-সোনা মসজিদ পর্যন্ত সড়কটি প্রশস্তকরণে ৪৮১ কোটি টাকার প্রকল্পের কাজ চলমান আছে। এতে মসজিদের সামনের অংশে ঢালাই করে রাস্তার কাজ করা হবে। এতে যানবাহন চলাচলে কোনো কম্পনের সৃষ্টি হবে না। এছাড়া গাড়ির হর্ন এবং উচ্চ শব্দ যাতে মসজিদে ধাক্কা না লাগে এই জন্য মসজিদের সামনে উন্নত প্রযুক্তির কাঁচের দেওয়াল তৈরি করা হবে।
শিবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আজাহার আলী বাসসকে বলেন, এই মহাসড়কে যানবাহন চলাচলের কারণে যেন প্রাচীন এই মসজিদটির কোনো ক্ষতি না হয়, এজন্য চাঁপাইনবাবগঞ্জ-সোনা মসজিদ পর্যন্ত সড়কটি প্রশস্তকরণের আওতায় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সোনামসজিদসহ এই অঞ্চলের ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো টিকিয়ে রাখতে আগামীতেও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।