ঢাকা, ২৭ জানুয়ারি, ২০২৫ (বাসস) : তৈরি পোশাকের একক রপ্তানি নির্ভরতা কমিয়ে দেশের ইপিজেডসমূহ রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণ ও বৈচিত্রায়নের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতির ভিত্তিকে সুদৃঢ় করছে। দেশের মোট বিনিয়োগের ২৯ শতাংশ এসেছে বেপজাধীন আটটি ইপিজেড এবং সম্প্রতি উৎপাদন শুরু করা বেপজা অর্থনৈতিক অঞ্চল থেকে।
বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরন অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেপজা) নির্বাহী চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল আবুল কালাম মোহাম্মদ জিয়াউর রহমান আজ সোমবার ঢাকায় বেপজা কমপ্লেক্সে আয়োজিত মিট দ্য প্রেস অনুষ্ঠানে এ তথ্য জানান।
তিনি বলেন, দেশে উৎপাদিত প্রথাগত গামের্ন্টস ও গামের্ন্টস এক্সেসরিজের বাইরে ইপিজেডে উৎপাদিত পণ্যের ৪৮% বৈচিত্রময় পণ্য। বেপজা উচ্চ প্রযুক্তিসম্পন্ন শিল্প স্থাপনকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। ইতোমধ্যে এখানে বাংলাদেশের প্রথম আনম্যানড অ্যারিয়াল ভেহিক্যাল যা মূলত ‘ড্রোন’ নামে পরিচিত এ জাতীয় উচ্চ প্রযুক্তির কারখানা স্থাপনের লক্ষ্যে চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়েছে।
তিনি বলেন, দেশের ইপিজেডসমূহে উৎপাদিত উল্লেখযোগ্য পণ্য সমূহের মধ্যে রয়েছে- তাঁবু ও তাঁবুর সরঞ্জাম, বাই-সাইকেল, কসমেটিকস, হলিউড মাস্ক, ক্যাম্পিং ফার্নিচার, গল্ফ শ্যাফট, উইগ ও ফ্যাশন চুল, ম্যানিকুইন, পাট পণ্য, এনার্জি সেভিং বাল্ব, ধাতব পণ্য, খেলনা, চশমা ও চশমার ফ্রেম, ক্যামেরার লেন্স, মোবাইল যন্ত্রাংশ, কার সিট হিটার, বাঁশের তৈরি কফিন, পিপিই, ফেইস মাস্ক, ব্রাইডাল গাউন, গিফট বক্স, আইল্যাশ, কার্টন, পিভিসি এপ্রোন, সেইফটি স্যু, ব্যাগ, লাগেজ ইত্যাদি।
বেপজা চেয়ারম্যান বলেন, গত অর্থবছরের (২০২৩-২৪) প্রথম ৬ মাসে সারা দেশে বিনিয়োগ ৭১ শতাংশ কমলেও বেপজায় এই কমার হার ২২ দশমিক ৩৩ শতাংশ। পক্ষান্তরে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে বেপজার জোনসমূহ থেকে রপ্তানি বেড়েছে ২২ দশমিক ৪১ শতাংশ।
অনুষ্ঠানে বেপজার সার্বিক কার্যর্ক্রম, সাম্প্রতিক সময়ে অর্জিত সাফল্য, জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান, ইপিজেডের শ্রম ও পরিবেশবান্ধব পরিবেশ প্রভৃতি বিষয় পাওয়ারপয়েন্ট প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে উপস্থাপন করেন বেপজার নির্বাহী বোর্ডের সদস্য (বিনিয়োগ উন্নয়ন) মোঃ আশরাফুল কবীর।
‘মিট দ্য প্রেস’-এ উপস্থিত ছিলেন বেপজার সদস্য (প্রকৌশল) মোঃ ইমতিয়াজ হোসেন, সদস্য (অর্থ) আ ন ম ফয়জুল হক সহ বেপজার উর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন বেপজার ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক (জনসংযোগ) আবু সাঈদ মো. আনোয়ার পারভেজ।
চেয়ারম্যান জানান, বেপজাধীন দেশের ইপিজেড সমূহে বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষন, শিল্পায়ন, রপ্তানি বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টির উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে ১৯৮০ সালে দেশে বেপজার যাত্রা শুরু হয়। বেপজাকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ইপিজেড প্রতিষ্ঠা, উন্নয়ন ও পরিচালনার ক্ষমতা দেয়া হয়।
১৯৮৩ সালে চট্টগ্রাম ইপিজেড স্থাপনের মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রথম ইপিজেডের যাত্রা শুরু হয়। চট্টগ্রাম ইপিজেডের সাফল্যকে ভিত্তি করে ১০ বছর পর ঢাকার অদূরে সাভারে ১৯৯৩ সালে দেশের দ্বিতীয় ইপিজেড- ঢাকা ইপিজেড যাত্রা শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৮ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আরও ৬টি ইপিজেড প্রতিষ্ঠিত হয়।
বর্তমানে দেশে বেপজার অধীনে চট্টগ্রাম, ঢাকা, মোংলা, কুমিল্লা, উত্তরা, ঈশ্বরদী, কর্ণফুলী ও আদমজী ইপিজেড চালু রয়েছে। এছাড়া বেপজার অধীনে চট্টগ্রামের মীরসরাইয়ে বেপজা অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের কাজ চলছে। যেখানে ইতোমধ্যে কয়েকটি শিল্প প্রতিষ্ঠান উৎপাদন কার্যক্রম শুরু করেছে। পটুয়াখালী এবং যশোর জেলায় দুটি ইপিজেড স্থাপনের কাজ শুরু হয়েছে। এছাড়া, গাইবান্ধা জেলায় একটি ইপিজেড স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
বেপজা চেয়ারম্যান বলেন, আটটি ইপিজেড এবং বেপজা অর্থনৈতিক অঞ্চলের মোট আয়তন মাত্র ৩ হাজার ৪৪৫ একর অর্থাৎ মাত্র ১৩ দশমিক ৯৫ বর্গ কিলোমিটার। বাংলাদেশের মোট আয়তনের এই অতি ক্ষুদ্র এলাকার মাধ্যমে বেপজাধীন জোনসমূহ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশের মোট ২৯ শতাংশ প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগে অবদান রেখেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুসারে গত অর্থবছরে দেশে মোট বৈদেশিক বিনিয়োগ এসেছে ১৪৬৮ দশমিক ১৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার । যার মধ্যে শুধু বেপজাধীন জোনসমূহে বিনিয়োগ হয়েছে ৪২৪ দশমিক ২৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
বেপজা সুত্র জানান, বৈশ্বিক নানা প্রতিবন্ধকতা সত্বেও ২০২৪ সালে বেপজার সাথে ২৮টি দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠান ইপিজেডসমূহ এবং বেপজা অর্থনৈতিক অঞ্চলে শিল্প স্থাপনের লক্ষ্যে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। যার মোট প্রস্তাবিত বিনিয়োগ ৫৬ দশমিক ৪৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। বাংলাদেশের সাথে চীন, নেদারল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য বিনিয়োগের লক্ষ্যে বেপজার সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে।
বেপজা প্রতিষ্ঠার পর থেকে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বেপজা সরকারি কোষাগারে প্রায় ১ হাজার ২১৬ কোটি টাকা আয়কর প্রদান করেছে। থোক সহযোগিতা প্রদান করেছে ১২২৬ দশমিক ৪৫ কোটি টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ইপিজেডসহ শিল্প কারখানার মাধ্যমে জাতীয় অর্থনীতিতে বেপজা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অবদান রেখেছে ৩১ হাজার ৭৫৮ দশমিক ৪৮ কোটি টাকা। বর্তমানে বেপজাধীন আটটি ইপিজেড ও বেপজা অর্থনৈতিক অঞ্চলে মোট ৪৪৯ শিল্প প্রতিষ্ঠান চালু রয়েছে। এর মধ্যে শতভাগ বিদেশি মালিকানাধীন বা এ-টাইপ প্রতিষ্ঠান ২৫৮টি, যৌথ মালিকানাধীন বা বি-টাইপ প্রতিষ্ঠান ৪৯টি এবং শতভাগ দেশীয় প্রতিষ্ঠান বা সি-টাইপ ১৪২টি। এছাড়াও ১০৮টি শিল্প প্রতিষ্ঠান বাস্তবায়নাধীন রয়েছে।