শিরোনাম
কামাল উদ্দিন চৌধুরী
ঢাকা, ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ (বাসস) : আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর ক্ষমতা পরিবর্তনের ছয় মাস পার করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এই সময়ের মধ্যে প্রবাসী আয় বৃদ্ধির সুস্থ প্রবাহ, বৈদেশিক সহায়তার উল্লেখযোগ্য পরিমাণ প্রাপ্তি এবং মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে দৃশ্যমান পদক্ষেপের কারণে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার বাজার বর্তমানে স্থিতিশীল রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বাসসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘বাংলাদেশি টাকার বিনিময় হার স্থিতিশীল রয়েছে। যখন আমরা দায়িত্ব নিয়েছিলাম, তখন এটি এক মার্কিন ডলারের বিপরীতে প্রায় ১২০ টাকার কাছাকাছি ছিল এবং এখনও সেই অবস্থানের আশেপাশেই রয়েছে। তবে, এখন আমরা একটি স্থিতিশীল বিনিময় হার বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছি।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে এক মার্কিন ডলারের বিনিময় হার প্রায় ১২২ টাকার কাছাকাছি রয়েছে। এমনকি বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার বাজার প্রতিবেশী দেশ ভারতের তুলনায় আরও স্থিতিশীল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে বাংলাদেশি টাকা মার্কিন ডলারের বিপরীতে ১.৬৭ শতাংশ অবমূল্যায়িত হয়েছে, যেখানে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে এই হার ছিল ১.৪৯ শতাংশ। অন্যদিকে, একই সময়ে ভারতীয় রুপি মার্কিন ডলারের বিপরীতে ২.১৯ শতাংশ অবমূল্যায়িত হয়েছে।
ড. মনসুর উল্লেখ করেন, ‘বর্তমানে বিনিময় হার বজায় রাখতে আর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বিক্রি করা হচ্ছে না। আগের সরকার রিজার্ভ বিক্রির মাধ্যমে বিনিময় হারে প্রভাব ফেলেছিল, যার ফলে রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার থেকে কমে ২০ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। এখন আমরা এটিকে ২০ বিলিয়নের কাছাকাছি স্থিতিশীল রাখছি।’
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বিপিএম-৬ পদ্ধতি অনুসারে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বর্তমানে ১৯.৯৭ বিলিয়ন ডলার।
প্রবাসী আয় বৃদ্ধির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘জানুয়ারিতে বাংলাদেশ ২.১৮ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পেয়েছে, যা টানা ছয় মাস ধরে ২ বিলিয়নের বেশি থাকছে। শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠানোর প্রবাহ কমে যাওয়ায় এই প্রবৃদ্ধি হয়েছে।’
গত ডিসেম্বর মাসে প্রবাসীরা ২.৬৩ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩৩ শতাংশ বেশি।
প্রিমিয়ার ব্যাংক পিএলসির ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর আবদুল কাইয়ুম চৌধুরী বলেন, ‘আগের সরকারের সময়ে অনেক প্রবাসী আবেগতাড়িত হয়ে আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে টাকা পাঠানো বন্ধ করেছিলেন। এখন রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর তারা আবার নিয়মিত রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘আগে দেশে অর্থ পাচারের কারণে হুন্ডির চাহিদা বেড়ে গিয়েছিল। এখন এই প্রবণতা বন্ধ হয়েছে। যারা টাকা পাচার করতেন, তাদের কেউ এখন কারাগারে, কেউ পলাতক, কেউ আত্মগোপনে রয়েছেন।’
কাইয়ুম বলেন, ‘আগের সরকারের আমলে প্রবাসী আয় ব্যবহার করে ব্যাপক পরিমাণে কম দামে আমদানি নিষ্পত্তি করা হতো। এখন এটি বন্ধ হয়েছে। তদুপরি, ভুয়া ঋণ ও কাগজে-কলমে ঋণ অনুমোদনের প্রবণতাও বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোর নজরদারির কারণে বন্ধ হয়েছে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে রেমিট্যান্স প্রবাহ ২৬.৭০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, আর রপ্তানি বেড়েছে ১১ শতাংশ।
অন্যদিকে, একই সময়ে আমদানি আদেশ বৃদ্ধি পেয়েছে মাত্র ৩.৫ শতাংশ। এতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংরক্ষণে ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে দেশ ১৩.৭৮ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পেয়েছে, যা আগের বছরের একই সময়ের ১০.৮০ বিলিয়ন ডলার থেকে প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার বেশি।
এই সময়ের মধ্যে ২২.৩২ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানি হয়েছে, যা আগের বছরের একই সময়ের ২০.১৯ বিলিয়ন ডলার থেকে ১১ শতাংশ বেশি।
একই সময়ে আমদানি ৩২.০৯ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে, যা আগের বছরের ৩০.৯৯ বিলিয়ন ডলার থেকে কিছুটা বেশি।
এছাড়া, চলতি হিসাবের উদ্বৃত্ত ৩৩ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যা এক বছর আগে একই সময়ে ৩.৪৭ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি ছিল।
অর্থনীতির সামগ্রিক পরিস্থিতি সম্পর্কে গভর্নর ড. মনসুর বলেন, ‘ছয় মাস আগে আমরা যখন সরকার গঠন করি, তখন অর্থনৈতিক ভারসাম্য বিঘ্নিত ছিল। আমাদের রিজার্ভ দ্রুত হ্রাস পাচ্ছিল এবং মুদ্রার মান কমছিল। এখন ছয় মাস পর আমি বলতে পারি যে, আমরা আমাদের চলতি হিসাব ভারসাম্য বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছি। আগের বড় ধরনের ঘাটতি থেকে এখন একটি টেকসই পরিস্থিতিতে আছি।’
বৈদেশিক মুদ্রার বাজারের স্থিতিশীলতা দেশের অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক দিক নির্দেশ করে এবং বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই ধারা বজায় থাকলে সামগ্রিক অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।