
ঢাকা, ১৭ নভেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : বিনিয়োগ পরিবেশের উন্নয়ন ও শক্তিশালী অর্থনৈতিক ভিত্তি গড়ে ওঠায় বাংলাদেশের দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতি, বিশেষ করে উৎপাদন, অবকাঠামো ও জ্বালানি খাতে চীনা বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বেড়েছে।
বাংলাদেশে চায়নিজ এন্টারপ্রাইজেস অ্যাসোসিয়েশন (সিইএবি)-এর সভাপতি হান কুন বাসসকে দেওয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে জানান, দুদশকেরও বেশি সময় ধরে চীন ও বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের মধ্যে সেতুবন্ধনের কাজ করছে সিইএবি। একই সঙ্গে পারস্পরিক বোঝাপড়া, বাণিজ্য সহযোগিতা ও নতুন বিনিয়োগকে উৎসাহিত করছে।
হান কুন আরও বলেন, বহু বছর ধরে আমরা এখানে আছি এবং বিশ্বাস করি বাংলাদেশ বিনিয়োগের জন্য একটি ভালো দেশ। সিইএবি-এর মূল কাজ হল দুদেশের ব্যবসায়ীদের মধ্যে সংযোগ তৈরি করা এবং আরও বেশি চীনা বিনিয়োগকারীকে বিনিয়োগে উৎসাহিত করা।
২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত সিইএবি বর্তমানে বাংলাদেশে ২৫০টি চীনা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিত্ব করছে। এসব প্রতিষ্ঠান বিদ্যুৎ উৎপাদন, অবকাঠামো নির্মাণ, টেলিযোগাযোগ, উৎপাদন এবং সেবাখাতের সঙ্গে যুক্ত।
হান কুন জানান, বাংলাদেশ সুশাসন ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে অগ্রগতি করেছে। তবে কিছু প্রাতিষ্ঠানিক ও প্রশাসনিক চ্যালেঞ্জ এখনও রয়েছে। ফলে নতুন বিনিয়োগকারীরা নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় নতুনরা সাধারণত অন্য ব্যবসায়ীদের অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভর করেন।
তিনি বলেন, এখানে আসার আগে নতুন বিনিয়োগকারীরা তাদের বন্ধু বা সিইএবির সঙ্গে পরামর্শ করেন। মাঝেমধ্যে তারা প্রশাসনিক দক্ষতা ও বিভিন্ন দফতরের সমন্বয় নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া শুনতে পান।
তিনি আরও উল্লেখ করেন, এখনও কিছু ক্ষেত্রে কাজের ধীরগতি ও অনিয়ম দেখা যাচ্ছে। এগুলো বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমাতে পারে।
তার দাবি, বর্তমানে বাংলাদেশে কাজ করা অধিকাংশ চীনা কোম্পানি লাভজনক অবস্থানে রয়েছে এবং তাদের ব্যবসা বাড়িয়েছে। তবে তাদের কিছু খারাপ অভিজ্ঞতা শুনে নতুন বিনিয়োগকারীরা নিরুৎসাহিত হতে পারেন।
হান কুন উল্লেখ করেন, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে কাজ করা সংস্থাগুলোর মধ্যে স্বচ্ছতা ও সমন্বয় বাড়ানো খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি সরকারি খাতে শৃঙ্খলা ও পেশাদারিত্বের উন্নয়নের ধারার প্রশংসা করে বলেন, সরকারি কর্মকর্তারা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সাড়া দিচ্ছেন।
হান কুন বলেন, ২০১৫ সালে যখন প্রথম বাংলাদেশে আসি, তখন রমজানে প্রায় সব অফিসই বন্ধ থাকত। কিন্তু এখন রমজান ও ছুটির মধ্যেও অনেক কর্মকর্তা নিয়মিত কাজ করেন। এই পরিবর্তনগুলোই উন্নয়নের ধারা এগিয়ে যাওয়ার ইতিবাচক লক্ষণ।
বাংলাদেশের প্রচলিত খাতের বাইরে সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিয়ে হান কুন বলেন, উৎপাদন খাত আগামীতে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগের প্রধান চালিকা শক্তি হতে পারে।
তিনি বলেন, উৎপাদন খাত বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, এটিকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। দেশটির জনসংখ্যার বড় অংশ তরুণ, যাদের গড় বয়স ২৭ বছরের কাছাকাছি। তরুণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে ৮ম। এই বিপুল জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি শিক্ষার মানোন্নয়ন বাংলাদেশকে বিশেষ সুবিধা দিচ্ছে।
সিইএবি সভাপতি বলেন, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়ালে শিক্ষাগত যোগ্যতার সঙ্গে শিল্পখাতে চাকরির সুযোগের ব্যবধান কমানো সম্ভব হবে।
তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা শিক্ষার্থীদের অনেকেই শিল্পকারখানার কাজের জন্য প্রস্তুত থাকেন না। আরও বৃত্তিমূলক কলেজ ও কারিগরি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা সম্ভব হলে তরুণরা শিল্পমুখী ও উৎপাদন সংক্রান্ত কাজে দক্ষ হয়ে উঠবে।
ভিয়েতনামের উদাহরণ টেনে হান কুন বলেন, দেশটি স্যামসাং-এর ইলেকট্রনিকস কারখানাসহ অনেক বড় বড় বহুজাতিক কোম্পানিকে বিনিয়োগে আকৃষ্ট করতে সফল হয়েছে। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার কারণে এখনও মোট রপ্তানির প্রায় ৮০ শতাংশ বিদেশি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আসে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের উচিত ভিয়েতনামের অভিজ্ঞতা থেকে শেখা এবং বিদেশি বিনিয়োগ যেন স্থানীয় শিল্পকে শক্তিশালী করে তা নিশ্চিত করা। যৌথ উদ্যোগ ও অংশীদারত্ব গড়ে তুলতে পারলে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে সমানতালে এগিয়ে যেতে পারবে।
হান বলেন, এভাবে এগিয়ে গেলে বৈশ্বিক বাণিজ্যের ধারা বদলালেও বাংলাদেশের উৎপাদনশীল খাত স্থিতিশীল থাকবে।
বিনিয়োগকারীদের আস্থা ধরে রাখতে নীতিগত স্থিতিশীলতা ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার গুরুত্বের ওপরও জোর দেন তিনি।
হান কুন জানান, নীতিতে ধারাবাহিকতা থাকতে হবে, যাতে বিনিয়োগকারীরা আগেভাগেই বুঝতে পারেন সামনে কী হতে পারে।
নিজের দেশের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, চীনে প্রতিটি বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জকেই অভ্যন্তরীণ সংস্কারের সুযোগে পরিণত করেছে। ২০০১ সালে চীন বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় (ডব্লিউটিও) যোগ দেয়। তখন অনেকেই আশঙ্কা করেছিলেন যে আমরা হয়ত প্রতিযোগিতার জন্য প্রস্তুত নই। কিন্তু সরকার সেই চাপকে কাজে লাগিয়ে প্রয়োজনীয় সংস্কার করেছে এবং প্রতিযোগিতায় আরও শক্ত অবস্থান তৈরি করেছে।
গত দুদশকে চীন বাংলাদেশের অন্যতম বড় উন্নয়ন সহযোগী ও বাণিজ্যিক অংশীদারে পরিণত হয়েছে। সেতু, বিদ্যুৎকেন্দ্র, শিল্পপার্ক ও সড়ক নির্মাণসহ বিভিন্ন অবকাঠামো প্রকল্পে দেশটি বড় ধরনের অবদান রেখেছে।
বাংলাদেশ ও চীনের বার্ষিক দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বর্তমানে ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি। বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই)-এর মত প্রকল্পের মাধ্যমে চীনা বিনিয়োগ প্রতিনিয়ত বাড়ছে।
হান কুনের মতে, চলমান সংস্কারের ধারাকে অব্যাহত রাখলে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় অন্যতম প্রধান উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে আবির্ভূত হবে। এতে স্থানীয় ও বিদেশী বিনিয়োগকারীদের জন্য লাভজনক সুযোগ তৈরি হবে।
সবশেষে তিনি বলেন, 'বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়েছে। দেশটি দক্ষতা, স্বচ্ছতা ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখলে বৈশ্বিক বিনিয়োগের আকর্ষণীয় গন্তব্য হয়ে উঠবে।'