শিশুর বামনত্ব : চ্যালেঞ্জ ও মোকাবিলার উপায়

বাসস
প্রকাশ: ২০ এপ্রিল ২০২৫, ০৯:৩৮
প্রতীকী ছবি

শিশুর বামনত্ব : চ্যালেঞ্জ ও মোকাবিলার উপায়

ঢাকা, ২০ এপ্রিল, ২০২৫ (বাসস) : শৈশব হলো জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়। এ সময় শিশুর শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি তার ভবিষ্যতের ভিত্তি গড়ে তোলে। কিন্তু অনেক শিশুর ক্ষেত্রে শারীরিক বৃদ্ধি স্বাভাবিকভাবে না হওয়ায় তারা বিভিন্ন শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য একটি অবস্থা হলো বামনত্ব (উধিৎভরংস)।

বামনত্ব শুধু একটি শারীরিক সমস্যা নয়, এটি জীবনের প্রতিটি ধাপে বাধা সৃষ্টি করে। কিন্তু সঠিক চিকিৎসা, সচেতনতা, এবং পরিবার ও সমাজের সহযোগিতার মাধ্যমে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সম্ভব।

বামনত্ব কী?

বামনত্ব একটি শারীরিক অবস্থা, যেখানে শিশুর উচ্চতা ও শরীরের গঠন বয়স অনুযায়ী স্বাভাবিকভাবে বাড়ে না। সাধারণত প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় উচ্চতা ৪ ফুট ১০ ইঞ্চির (১৪৭ সেন্টিমিটার) কম হলে তাকে বামনত্ব হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এটি জিনগত ত্রুটি, হরমোনের ঘাটতি বা পুষ্টিহীনতার কারণে হতে পারে।

বামনত্বের কারণ

বামনত্বের মূল কারণ হলো:

জিনগত ত্রুটি: বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আকানড্রোপ্লাজিয়া (অপযড়হফৎড়ঢ়ষধংরধ) নামে পরিচিত একটি বংশগত অবস্থার কারণে বামনত্ব হয়। এতে হাড়ের বৃদ্ধি সীমিত হয়ে যায়।

হরমোনজনিত সমস্যা: শরীরে গ্রোথ হরমোন (এৎড়ঃিয ঐড়ৎসড়হব) কম তৈরি হলে শিশুর শারীরিক বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়।

পুষ্টিহীনতা: সঠিক পুষ্টির অভাব শিশুর শারীরিক বৃদ্ধি ব্যাহত করে।

জন্মগত ত্রুটি: কিছু শিশু জন্মগতভাবে হাড় বা মস্তিষ্কের গঠনে ত্রুটি নিয়ে জন্মায়, যা তাদের বৃদ্ধিতে প্রভাব ফেলে।

অন্য শারীরিক সমস্যা: থাইরয়েড সমস্যা বা দীর্ঘস্থায়ী রোগও শিশুর বৃদ্ধির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

বামনত্বের লক্ষণ

বামনত্বের লক্ষণগুলো শিশুর শারীরিক গঠন ও বৃদ্ধিতে স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে।

১. উচ্চতা স্বাভাবিকের চেয়ে কম। ২. শরীরের অঙ্গগুলোর অসম গঠন। ৩. মাথা তুলনামূলক বড়।
৪. হাঁটাচলায় সমস্যা। ৫. দাঁতের গঠনে ত্রুটি। ৬. মেরুদণ্ড বাঁকা হওয়া।

বামনত্বের প্রভাব

শারীরিক প্রভাব: বামনত্ব শিশুদের দৈনন্দিন কাজের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। তারা সহজেই ক্লান্ত হয়ে পড়ে এবং শরীরের গঠনগত সমস্যার কারণে চলাফেরায় সমস্যায় পড়ে।

মানসিক প্রভাব: বামনত্ব শিশুর আত্মবিশ্বাসে বড় প্রভাব ফেলে। সমাজে বিদ্রূপ, ঠাট্টা, এবং বুলিং-এর কারণে তারা হীনমন্যতায় ভুগতে পারে। অনেক সময় বিষণ্নতা ও মানসিক চাপ তাদের জীবনের অংশ হয়ে দাঁড়ায়।

সামাজিক প্রভাব: দৈহিক সীমাবদ্ধতার কারণে তারা অনেক সময় শিক্ষার ক্ষেত্রে এবং পেশাগত জীবনে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ে।

চিকিৎসা ও সমাধান

১. প্রাথমিক সনাক্তকরণ: শিশুর বৃদ্ধি স্বাভাবিক নয় মনে হলে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত।

২. গ্রোথ হরমোন থেরাপি: যেসব শিশুর হরমোনের ঘাটতির কারণে বামনত্ব হয়, তাদের জন্য গ্রোথ হরমোন থেরাপি কার্যকর। তবে এটি নিয়মিত পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে করতে হয়।

৩. অস্ত্রোপচার: হাড়ের গঠনের ত্রুটি সংশোধনের জন্য সার্জারি একটি কার্যকর পদ্ধতি।

৪. ফিজিওথেরাপি ও পুনর্বাসন: শারীরিক শক্তি বাড়াতে এবং হাঁটাচলায় সহজতা আনতে ফিজিওথেরাপি সহায়ক।

৫. মানসিক সহায়তা: মনোবিজ্ঞানী বা পরামর্শদাতা শিশুর আত্মবিশ্বাস বাড়াতে সাহায্য করতে পারেন।

৬. পুষ্টি নিশ্চিতকরণ: সঠিক পুষ্টি শিশুর সামগ্রিক স্বাস্থ্য উন্নত করতে সাহায্য করে।

চিকিৎসকের দৃষ্টিকোণ

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশু এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আবদুল হাই বলেন, 'বামনত্ব মূলত জিনগত বা হরমোনজনিত কারণে হয়ে থাকে। তবে সঠিক সময়ে চিকিৎসা এবং পরিবারের সমর্থন শিশুর জীবনে বড় পরিবর্তন আনতে পারে। প্রতিটি শিশুকে স্বাভাবিক জীবনের সুযোগ দিতে আমাদের সচেতন হতে হবে।'

অন্যদিকে, জাতীয় শিশু হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. সায়মা আহমেদ বলেন: "শিশুর বৃদ্ধি ব্যাহত হওয়ার সমস্যা দেখা দিলে প্রথমেই বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত। দ্রুত সনাক্তকরণ এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা শিশুকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে।"

পরিবার ও সমাজের ভূমিকা

পরিবার এবং সমাজ শিশুদের মানসিক বিকাশে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে।

পরিবারের সমর্থন: শিশুর প্রতি ভালোবাসা এবং স্বাভাবিক আচরণ তাকে মানসিকভাবে শক্তিশালী করে।

সমাজের সচেতনতা: বামনত্ব নিয়ে ভুল ধারণা দূর করতে হবে এবং তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে হবে।

সামঞ্জস্যপূর্ণ পরিবেশ: শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে তাদের সমান সুযোগ দেওয়া জরুরি।

সফলতার গল্প

দৈহিক সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও অনেকেই নিজেদের প্রতিভা দিয়ে সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছেছেন।

পিটার ডিংক্লেজ, যিনি 'গেম অব থ্রোন্স' সিরিজে অভিনয় করে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পেয়েছেন।

এছাড়াও বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনেকেই বামনত্ব জয় করে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

উপসংহার

বামনত্ব কোনো অভিশাপ নয়; এটি একটি শারীরিক অবস্থা, যা সঠিক চিকিৎসা, পরিবার ও সমাজের সমর্থনে সহজেই মোকাবিলা করা সম্ভব। আমাদের দায়িত্ব হলো, তাদের প্রতি সমান মনোভাব পোষণ করা এবং তাদের জন্য একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক পরিবেশ তৈরি করা। শারীরিক সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও এই শিশুরা তাদের প্রতিভা দিয়ে সমাজে অসাধারণ অবদান রাখতে পারে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
সাবেক প্রতিমন্ত্রী বিপুর ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ, গাড়ি-এ্যাপার্টমেন্ট জব্দ
ব্যাংককে ভবনধস: সংশ্লিষ্ট কোম্পানির চীনা নির্বাহী গ্রেফতার
দিনমজুর থেকে ফল ব্যবসায়ী : সততা আর শ্রম দিয়ে মোখলেছ আজ স্বাবলম্বী
ট্রাম্পের আমলে অতি ধনী ও টেক জায়ান্টদের ওপর কর আরোপ থেমে গেছে
মার্কিন শুল্কনীতির কারণে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস কমাতে পারে আইএমএফ: ব্লুমবার্গ
কুমিল্লায় আলুর ন্যায্য মূল্য নিয়ে বিপাকে কৃষকরা 
পুতিনের ইস্টার যুদ্ধবিরতির মধ্যেও রুশ হামলা অব্যাহত: জেলেনস্কি
গাজা সহায়তা নিয়ে হামাস নেতাদের সাথে তুরস্কের গোয়েন্দা প্রধানের বৈঠক
বর্ষা আসলেই বাঁধ ভাঙে, শঙ্কায় তিস্তা পারের মানুষ, দ্রুত বেড়িবাঁধ সংস্কারের দাবি রংপুরবাসীর
সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে নতুন দুই বিচারপতিকে সংবর্ধনা
১০