ঢাকা, ২২ এপ্রিল, ২০২৫ (বাসস) : নাবিল (ছদ্মনাম) ডাউন সিনড্রোম নামক বিশেষ বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্ম নেওয়া এক বিশেষ শিশু। পুরান ঢাকার সূত্রাপুরের বাসিন্দা নাবিলের জীবন অন্য সব শিশুদের থেকে আলাদা। সাধারণ স্কুলে তার জন্য পড়াশোনা করা সম্ভব হয়নি। তাই তার মা-বাবা স্থানীয় ‘আর্থ অব চিলড্রেনস স্কুল’-এ ভর্তি করান। তবে শারীরিক দুর্বলতার কারণে নিয়মিত স্কুলে যাওয়াও সম্ভব হয়নি। বর্তমানে বাসায় একজন শিক্ষিকার তাকে পড়াচ্ছেন।
নাবিলের শারীরিক ও মানসিক উন্নয়নে সময় লেগেছে। শুরুতে তার আচরণ ছিল দুই-তিন বছরের শিশুর মতো। তবে নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও যত্নের মাধ্যমে সে এখন নিজের হাতে খেতে পারে, প্রয়োজনীয় কাজ করতে পারে। এমনকি অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগও করতে পারে।
ডাউন সিনড্রোম: বিজ্ঞান ও বৈশিষ্ট্য
ডাউন সিনড্রোম একটি জিনগত বৈশিষ্ট্য, যেখানে ২১তম ক্রোমোজমের একটি অতিরিক্ত কপি থাকে। এই বৈশিষ্ট্যকে ট্রাইসোমি ২১ নামেও চিহ্নিত করা হয়। বিশ্বে প্রতি ৭০০ শিশুর মধ্যে একজন এই বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। বাংলাদেশেও প্রতি বছর প্রায় ৫০০০ শিশু ডাউন সিনড্রোম নিয়ে জন্মায়।
এই বৈশিষ্ট্যের কারণে শারীরিক ও মানসিক বিকাশে জটিলতা দেখা দেয়। ডাউন সিনড্রোম শিশুরা সাধারণত চ্যাপ্টা মুখমণ্ডল, ছোট নাক ও কান, এবং দুর্বল মাংসপেশি নিয়ে জন্মায়। তাদের চোখে বাঁকানো আকৃতি এবং শরীর স্থুল হতে পারে। পাশাপাশি তাদের আইকিউ সাধারণত গড় মানের নিচে থাকে, যার ফলে তারা স্বাভাবিক শিক্ষার ধারা অনুসরণে ধীর।
লক্ষণ ও জটিলতা
ডাউন সিনড্রোমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন শারীরিক সমস্যাও দেখা যায়। এসব শিশুর মধ্যে জন্মগত হৃদরোগ, শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা, অন্ত্রের জটিলতা এবং থাইরয়েডের সমস্যার হার বেশি। পাশাপাশি তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকায় সংক্রমণের ঝুঁকিও বেশি।
তবে প্রতিটি শিশুর শারীরিক এবং মানসিক উন্নতি নির্ভর করে যত্ন, থেরাপি এবং সঠিক শিক্ষার ওপর। ফাহিমের মতো শিশুরা যদি সঠিক দিকনির্দেশনা এবং যত্ন পায়, তবে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনা সম্ভব।
গর্ভাবস্থায় ডাউন সিনড্রোম নির্ণয়
গর্ভাবস্থায় ডাউন সিনড্রোম শনাক্ত করা সম্ভব। আল্ট্রাসাউন্ড এবং হরমোন টেস্টের মাধ্যমে চিকিৎসকরা এ বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারেন। বিশেষত, গর্ভাবস্থার ২০ সপ্তাহের মধ্যে ডাউন সিনড্রোম নির্ণয়ের মাধ্যমে পরিবারকে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে সাহায্য করা যায়।
বাংলাদেশে সেবা ও সচেতনতার অভাব
বাংলাদেশে ডাউন সিনড্রোম নিয়ে সচেতনতা তুলনামূলকভাবে কম। ২০১৬ সালে গঠিত ‘বাংলাদেশ ডাউন সিনড্রোম সোসাইটি’ এ শিশুদের উন্নয়ন ও অধিকার নিশ্চিত করতে কাজ করছে। এছাড়াও বিভিন্ন এনজিও এ বিষয়ে উদ্যোগী হলেও জাতীয় পর্যায়ে এখনও সুসংগঠিত সেবা নিশ্চিত হয়নি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ডাউন সিনড্রোম শিশুদের জন্য বিশেষায়িত স্কুল এবং থেরাপি সেন্টারের অভাব রয়েছে। অধিকাংশ পরিবার এ বিষয়ে সচেতন নয় এবং অনেক সময় সামাজিক লজ্জা বা কুসংস্কারের কারণে সমস্যাটি গোপন রাখার চেষ্টা করে।
শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তা
ডাউন সিনড্রোম শিশুদের মানসিক এবং শারীরিক বিকাশে বিশেষ শিক্ষা অত্যন্ত জরুরি। তবে বাংলাদেশে এ ধরনের বিশেষায়িত শিক্ষার ব্যবস্থা সীমিত। সাধারণ স্কুলে তাদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা না থাকায় অনেক শিশুর শিক্ষার সুযোগ নষ্ট হয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই শিশুদের শেখার গতি ধীর হলেও ধৈর্য এবং সঠিক পদ্ধতিতে তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। থেরাপি, সাংস্কৃতিক কার্যক্রম, ও খেলাধুলার মাধ্যমে তাদের মানসিক উন্নয়ন ঘটানো যায়।
পরিবারের ভূমিকা
ডাউন সিনড্রোম শিশুদের ক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এই শিশুদের উন্নয়নের জন্য বাবা-মায়ের ধৈর্য, যত্ন, ও উৎসাহ প্রয়োজন। তবে বাস্তব চিত্র ভিন্ন। অনেক পরিবার এ ধরনের শিশুদের প্রতি প্রয়োজনীয় মনোযোগ দিতে ব্যর্থ হয়।
অভিভাবকদের কাউন্সেলিং এ ক্ষেত্রে বিশেষ সহায়ক হতে পারে। পরিবারে ইতিবাচক পরিবেশ তৈরি করে এবং নিয়মিত থেরাপি ও চিকিৎসার মাধ্যমে এই শিশুরা উন্নতির পথে এগিয়ে যেতে পারে।
সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি ও করণীয়
ডাউন সিনড্রোম শিশুদের জন্য দয়া নয়, সহযোগিতা প্রয়োজন। সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন এ ক্ষেত্রে অত্যন্ত জরুরি। এ ধরনের শিশুদের প্রতি সমান আচরণ এবং তাদের সঠিক অধিকার নিশ্চিত করা সমাজের দায়িত্ব।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ডাউন সিনড্রোম নিয়ে আরও গবেষণা, সচেতনতা বৃদ্ধি এবং প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। গণমাধ্যম এবং সামাজিক প্ল্যাটফর্মগুলো এই বিষয়ে ইতিবাচক বার্তা ছড়িয়ে দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
শেষ কথা
ডাউন সিনড্রোম শিশুদের জীবন একটি বিশেষ চ্যালেঞ্জ হলেও সঠিক যত্ন, শিক্ষা, এবং সামাজিক সহযোগিতার মাধ্যমে তাদের উন্নয়ন সম্ভব। ফাহিমের মতো শিশুরা প্রমাণ করে, ধৈর্য এবং সঠিক দিকনির্দেশনার মাধ্যমে তারা তাদের জীবনকে অর্থবহ করতে পারে। আমাদের কাজ হবে এই শিশুদের বোঝা হয়ে নয়, বরং তাদের উন্নতির অংশীদার হয়ে তাদের পাশে দাঁড়ানো।