ঢাকা, ২১ মে, ২০২৫ (বাসস): ইসরাইল জাতিসংঘের কয়েক ডজন ট্রাক প্রবেশের অনুমতি দেওয়ার কথা জানালেও ত্রাণ প্রবাহ বৃদ্ধি এবং তীব্র সামরিক অভিযান বন্ধ করার জন্য আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পড়ার পর বুধবার গাজার বাসিন্দারা অত্যাবশ্যকীয় সরবরাহের জন্য মরিয়া হয়ে অপেক্ষা করতে থাকে।
যুদ্ধবিধ্বস্ত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের উদ্ধারকারীরা এএফপি’কে জানিয়েছেন, রাতভর ইসরাইলি হামলায় এক সপ্তাহের নবজাতক শিশুসহ কমপক্ষে ১৯ জন নিহত হয়েছেন।
গাজা সিটি থেকে এএফপি এই খবর জানায়।
ইসরাইল জানিয়েছে, মঙ্গলবার ৯৩টি ট্রাক গাজায় প্রবেশ করেছে কিন্তু অভিযোগ উঠেছে, প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম সাহায্য পাঠানো হয়েছে। জাতিসংঘ জানিয়েছে, সাহায্য আটকে রাখা হয়েছে।
সোমবার বিশ্ব সংস্থাটি ঘোষণা করেছে, ২ মার্চ ইসরাইল সর্বাত্মক অবরোধ আরোপের ফলে খাদ্য ও ওষুধের তীব্র ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এর পর প্রথমবারের মতো সাহায্য পাঠানোর অনুমতি পেয়েছে।
গাজা শহরের একটি এলাকায় বসবাসকারী বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনি ৫৩ বছর বয়সী উম্মে তালাল আল-মাসরি পরিস্থিতিকে ‘অসহনীয়’ বলে উল্লেখ করেছেন।
তিনি এএফপি’কে বলেছেন, ‘কেউ আমাদের কিছু বিতরণ করছে না। সবাই সাহায্যের জন্য অপেক্ষা করছে, কিন্তু আমরা কিছুই পাইনি।’
‘আমরা রুটি তৈরির জন্য ডাল এবং পাস্তা পিষে নিচ্ছি, এছাড়া আমরা দিনে আর কোনো খাবারও খুব একটা বানাতে পারছি না।’
ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস (এমএসএফ) বলেছে, ইসরাইল গাজায় যে পরিমাণ সাহায্য দিতে শুরু করেছে তা ২৪ লক্ষ জনসংখ্যার জন্য যথেষ্ট নয়। এটিকে ‘অবরোধ শেষ হওয়ার ভান করার ধোঁয়ার পর্দা’ হিসাবে বর্ণনা করেছে।
দক্ষিণ গাজা শহরের খান ইউনিসে এমএসএফের জরুরি সমন্বয়কারী প্যাসকেল কোইসার্ড বলেছেন, ‘মাসের পর মাস ধরে বিমান অবরোধের পর গাজায় হাস্যকরভাবে অপর্যাপ্ত পরিমাণে সাহায্য পাঠানোর ইসরাইলি কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, তারা গাজার মানুষদের ক্ষুধার্ত থাকার অভিযোগ এড়াতে চাইছে। কিন্তু বাস্তবে তাদের খুব একটা বাঁচিয়ে রাখছে না।’
বুধবার আমিরাতের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, গাজায় ‘জরুরি মানবিক সহায়তা’ সরবরাহের অনুমতি দেওয়ার জন্য সংযুক্ত আরব আমিরাত ইসরাইলের সাথে একটি চুক্তিতে পৌঁছেছে।
চুক্তিতে বলা হয়েছে, ‘প্রাথমিক পর্যায়ে গাজা উপত্যকার প্রায় ১৫ হাজার বেসামরিক নাগরিকের খাদ্য চাহিদা পূরণ করবে এই সহায়তা’।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাহায্য কখন গাজায় পাঠানো হবে তা তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি। এএফপি ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের মন্তব্য জানতে চেয়েছে।
গাজার হামাস শাসকদের পরাজিত করার অঙ্গীকার করে ইসরাইলি সেনাবাহিনী সপ্তাহান্তে তাদের আক্রমণাত্মক পদক্ষেপ জোরদার করে। হামাসের ৭ অক্টোবর, ২০২৩ সালে ইসরাইলের ওপর আক্রমণ যুদ্ধের সূত্রপাত করেছিল।
ইসরাইলি পক্ষ থেকে দক্ষিণ গাজার এএফপিটিভি ফুটেজে বুধবার সকাল জুড়ে একাধিক হামলার দৃশ্য দেখানো হয়েছে।
খান ইউনিসে, ধর্মঘটের পর পরিবারের সদস্যদের শহরের নাসের হাসপাতালে আনার সময় বিচলিত আত্মীয়স্বজনরা কাঁদছিলেন।
মেঝেতে বিছিয়ে রাখা কম্বলের নিচ থেকে মৃতদের, যার মধ্যে একটি ছোট শিশুও ছিল, পোড়া পা দৃশ্যমান ছিল।
তীব্র আক্রমণ বন্ধ করতে এবং গাজায় ত্রাণ সরবরাহের অনুমতি দেওয়ার জন্য ইসরাইলকে ব্যাপক চাপের সম্মুখীন হতে হয়েছে। এতে ইসরাইলের ঐতিহ্যবাহী মিত্ররাও রয়েছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্র নীতি বিষয়ক প্রধান কাজা কালাস মঙ্গলবার বলেছেন, ২৭-জাতির ব্লকের ‘শক্তিশালী সংখ্যাগরিষ্ঠ’ পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা ইসরাইলের সাথে তাদের বাণিজ্য সহযোগিতা পর্যালোচনার পদক্ষেপকে সমর্থন করেছেন।
তিনি বলেছেন, ‘দেশগুলো দেখছে, গাজার পরিস্থিতি অস্থিতিশীল এবং আমরা যা চাই তা হল মানবিক সাহায্য প্রবেশের অনুমতি দেয়া।’
সুইডেন জানিয়েছে, তারা ইসরাইলি মন্ত্রীদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য ইইউ’র ওপর চাপ সৃষ্টি করবে।
ব্রিটেন ইসরাইলের সাথে মুক্ত-বাণিজ্য আলোচনা স্থগিত করেছে। ইসরাইলি রাষ্ট্রদূতকে তলব করে বলেছে, তারা ইসরাইলের যুদ্ধ পরিচালনার বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত তাদের কঠোরতম পদক্ষেপ হিসেবে অধিকৃত পশ্চিম তীরে বসতি স্থাপনকারীদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে।
পোপ লিও চতুর্দশ গাজার পরিস্থিতিকে ‘উদ্বেগজনক এবং বেদনাদায়ক’ বলে বর্ণনা করেছেন এবং ‘পর্যাপ্ত মানবিক সাহায্যের প্রবেশের’ আহ্বান জানিয়েছেন।
ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস ইসরাইলের ‘অবরোধ’ এবং ভূখণ্ডের ‘অনাহার’-এর আন্তর্জাতিক প্রত্যাখ্যানকে স্বাগত জানিয়েছেন।
ইসরাইলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, ইইউ’র এই পদক্ষেপ ‘ইসরাইল যে জটিল বাস্তবতার মুখোমুখি হচ্ছে তার সম্পূর্ণ ভুল বোঝাবুঝির প্রতিফলন ঘটায়’।
ইসরাইল জানিয়েছে, মঙ্গলবার ‘বেকারির জন্য আটা, শিশুদের জন্য খাবার, চিকিৎসা সরঞ্জাম এবং ওষুধসহ মানবিক সাহায্য বহনকারী ৯৩টি জাতিসংঘের ট্রাক গাজায় প্রবেশ করেছে।’ তবে জাতিসংঘ সরবরাহ গ্রহণে অসুবিধার কথা জানিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সোমবার ঘোষণা করেছেন, ইসরাইল তার নতুন প্রচারণার মাধ্যমে ‘সমস্ত ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ নেবে।’
দুই মাসের যুদ্ধবিরতির অবসান ঘটিয়ে ১৮ মার্চ গাজা জুড়ে পুনরায় অভিযান শুরু করে ইসরাইল।
ইসরাইল এবং হামাসের আলোচকরা সপ্তাহান্তে দোহায় নতুন পরোক্ষ আলোচনা শুরু করেছেন।
বুধবারের শেষের দিকে, নেতানিয়াহুর কার্যালয় হামাসকে চুক্তি মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানানোর অভিযোগ করে বলেছে, ইসরাইল তার জ্যেষ্ঠ আলোচকদের প্রত্যাহার করছে কিন্তু দোহায় তাদের কিছু দলের সদস্যদের রেখে যাচ্ছে।
সরকারি পরিসংখ্যানের ওপর ভিত্তি করে এএফপি’র এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৩ সালের অক্টোবরে হামাসের হামলায় ইসরাইলে ১,২১৮ জন নিহত হন, যাদের বেশিরভাগই বেসামরিক নাগরিক।
হামাস যোদ্ধারা ২৫১ জনকে জিম্মি করে। এদের মধ্যে ৫৭ জন গাজায় রয়ে গেছে, যার মধ্যে ৩৪ জন নিহত বলে সেনাবাহিনী জানিয়েছে।
হামাস নিয়ন্ত্রিত গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় মঙ্গলবার জানিয়েছে, ১৮ মার্চ থেকে ইসরাইলের হামলা পুনরায় শুরু হওয়ার পর থেকে কমপক্ষে ৩,৪২৭ জন নিহত হয়েছে। এতে যুদ্ধে মোট মৃতের সংখ্যা ৫৩,৫৭৩ জনে দাঁড়িয়েছে।