ঢাকা, ২২ মে, ২০২৫ (বাসস) : ৮৬ বছর বয়সী লিদিয়া ইসায়েভা বসবাস করছেন একা, একটি সেলারে। সেখানে তিনি আশ্রয় নিয়েছেন রুশ হামলা থেকে বাঁচতে—হামলায় ধ্বংস হয়েছে তার অ্যাপার্টমেন্ট আর শহরের একাংশ।
লাইম্যান শহরটি পূর্ব ইউক্রেনে ফ্রন্টলাইনের কাছাকাছি হলেও, সেখানে থেকে যাওয়ার প্রশ্নে তার উত্তর দৃঢ়: 'কখনোই না!'
'এখানেই আমার স্বর্গ,' ইসায়েভা এএফপিকে বলেন। তিনি কথা বলছিলেন সেই সরু ভূগর্ভস্থ করিডোরে, যা তার রান্নাঘর হিসেবে ব্যবহৃত হয়; রান্না করা পেঁয়াজের গন্ধে ভুরভুরে ছিল বাতাস।
তার স্বামীকে কবর দেওয়া হয়েছে এই শহরেই, এবং তার থেকে আলাদা হয়ে যাওয়ার কথা তিনি ভাবতেই পারেন না। 'আমি ওর কাছে থাকতে চাই, অন্য কোথাও না।'
গত বছর থেকে এএফপি তার সঙ্গে কয়েকবার দেখা করেছে। প্রতিবারই তার উত্তর এক:
'আমরা ঘরেই আছি, ঘরেই মরব।'
সব ঝুঁকি সত্ত্বেও অনেকে ইউক্রেনে নিজেদের ধ্বংসপ্রায় শহরে থেকে যাচ্ছেন। স্মৃতির ভার, জীবনের বহু বছর—এসব ফেলে যাওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব নয়।
এদের অনেকেই প্রবীণ, যারা হয়তো অন্য কোথাও যাওয়ার সাহস বা জায়গা খুঁজে পাচ্ছেন না, অথবা যাদের পক্ষে জীবনজুড়ে গড়া পরিবেশ ছেড়ে যাওয়া কষ্টকর।
বেগুনি সোয়েটার ও নরম স্লিপার পরা ইসায়েভা বললেন, 'কখনও ভাবিনি আমার জীবন এভাবে কাটবে।'
আর্মচেয়ারে বসে থাকা ইসায়েভা প্রতিদিন একটি করে দিন পেরোনোর চিহ্ন রাখেন তার ক্যালেন্ডারে।
গত এক দশকে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চল থেকে লাখ লাখ মানুষ পালিয়ে গেছে—প্রথমে ২০১৪ সালে রুশপন্থী বিদ্রোহ শুরু হলে, পরে ২০২২ সালে রাশিয়ার পূর্ণমাত্রার আগ্রাসনের পর।
- বিপজ্জনক আশাবাদ -
তবে কেউ কেউ ফিরেও এসেছেন।
ইসায়েভার প্রতিবেশী ভ্যালেন্তিনা রোমেন্সকা বলেন, তিন বছর আগে তাকে কিয়েভে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল।
সব কিছু ভালোই চলছিল, যতক্ষণ না ৮৬ বছর বয়সী এই পেনশনার বুঝতে পারলেন যে নতুন ঘরে ছারপোকা বাসা বেঁধেছে।
তখন তিনি ফিরে এলেন লাইম্যান শহরে—ফ্রন্ট থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার (৬ মাইল) দূরে। এখন আর ওখানে ফিরে যাওয়ার কোনো কারণ দেখেন না।
বিস্ফোরণ তার কানে তেমন লাগে না—'আমি একটু বধির,' বলেন তিনি।
আর তার মতে, একটি ধাতব স্ক্রু দিয়ে তিনি ভাগ্য গণনা করেন, যা সম্প্রতি বলেছে, 'মে মাসেই শান্তি আসবে।'
রাশিয়া ঘোষিত দুটি স্বল্পমেয়াদি যুদ্ধবিরতি লড়াই বন্ধ করতে পারেনি—বরং অনেক সময় তা উদ্ধার অভিযানে সমস্যা সৃষ্টি করেছে।
'অনেকবার এমন হয়েছে, আমরা কোনো ঠিকানায় যেতাম, আর মানুষ বলত, 'আমি কেন যাব? মনে তো হচ্ছে শান্ত রয়েছে',' বললেন ‘ইস্ট এসওএস’ নামক সংস্থার এডুয়ার্ড স্কোরিক। এই সংস্থা ফ্রন্টলাইন থেকে মানুষ সরাতে সহায়তা করে।
তার সহকর্মী, ৩৩ বছর বয়সী রোমান বুগায়ভ বলেন, মানুষ চায় সবকিছু ঠিক হয়ে যাক, এবং তাই তারা 'গুজবে' বিশ্বাস করতে রাজি থাকে।
'এটা এমন এক আশাবাদ, যা মৃত্যু ডেকে আনতে পারে,' বলেন তিনি।
স্কোরিক জানান, সম্প্রতি একটি বাড়িতে গিয়েছিলেন কিছু বাসিন্দাকে সরিয়ে নিতে, কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখেন, বাড়িটি রাশিয়ার হামলায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
- চলে যাওয়া ভয়ানক -
ফ্রন্টলাইনের কাছাকাছি বাসিন্দাদের নিয়মিতভাবে এলাকা ত্যাগ করার জন্য আহ্বান জানানো হয়, এবং সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে তা বাধ্যতামূলক।
কেউ কেউ যেতে অস্বীকৃতি জানালে, উদ্ধারকারী দল যারা নিজেরাও একসময় পালিয়ে এসেছেন, তারা হতাশ হয়ে পড়েন।
বুগায়ভ বলেন, 'কেউ কেউ যারা থেকে যান, তাদের নিয়ে আমি রাগান্বিত।'
পাভলো দিয়াচেঙ্কো নামের এক পুলিশ কর্মকর্তা, যিনি ‘হোয়াইট অ্যাঞ্জেলস’ ইউনিটে আছেন এবং উদ্ধার অভিযানে যুক্ত, জানান, কখনো কখনো একই পরিবারকে :দুই, তিন, এমনকি চারবার' স্থানান্তর করতে হয়।
অনেকে চলে গিয়ে পরে আবার ফিরে এসে হামলায় মারা গেছেন।
একটি ক্ষুদ্র অংশ রুশ সেনাবাহিনী আসার অপেক্ষায় চুপচাপ থেকে যায়। অন্যরা থেকে যান কারণ তারা মনে করেন, অন্য কোথাও গিয়ে তারা টিকতে পারবেন না।
আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের জন্য সরকার প্রাপ্তবয়স্কদের প্রতি মাসে প্রায় ৪৮ ডলার এবং শিশুদের জন্য ৭২ ডলার করে ভাতা দেয়।
ইসায়েভা বলেন, তার সঞ্চয় দিয়ে অন্য কোথাও টিকে থাকা সম্ভব নয়। 'এক ব্যাগ টাকা লাগবে আমাকে যেতে হলে,' বলেন তিনি।
দিয়াচেঙ্কো বলেন, অভিজ্ঞ উদ্ধারকারী দল সহজেই বুঝতে পারে, কেউ যাওয়া নিয়ে আগ্রহী কিনা—না হলে সময় নষ্ট হয়।
তবে কখনো কখনো বিস্ময়কর কিছু ঘটে।
তিনি বলেন, সম্প্রতি পোক্রোভস্ক শহরে এক নারীকে সরাতে গিয়েছিলেন, যিনি একেবারেই যেতে রাজি হচ্ছিলেন না।
শেষ পর্যন্ত উদ্ধারকারী দল তাকে তার বোনের একটি ভিডিও বার্তা দেখায়—যাকে তিনি দশ বছর ধরে দেখেননি।
ভিডিওতে বোন বলেছিলেন, 'আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করছি,' এবং তাকে অনুরোধ করেন এলাকা ত্যাগ করতে।
মুহূর্তের মধ্যেই তিনি ব্যাগ গুছিয়ে উদ্ধারকারী দলের সঙ্গে রওনা দেন।