ঢাকা, ১৩ জুলাই, ২০২৫ (বাসস): ইউরোপের সব দেশই মার্কিন বাজারের প্রতি সমানভাবে নির্ভরশীল নয়। তাই প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি ইউরোপীয় ইউনিয়নের ওপর ৩০ শতাংশ শুল্ক আরোপের হুমকি বাস্তবায়ন করেন, তাহলেও সব দেশ একই ধরনের ক্ষতির মুখে পড়বে না।
প্যারিস থেকে বার্তা সংস্থা এএফপি জানায়, আয়ারল্যান্ড ও জার্মানি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানিকারক। বিশেষ করে ওষুধ, গাড়ি, ইস্পাত ও যন্ত্রপাতির ক্ষেত্রে। ফলে তাদের ওপর এই শুল্কের প্রভাব বেশি পড়তে পারে।
ফ্রান্স তুলনামূলকভাবে কম ঝুঁকিপূর্ণ, যদিও দেশটিতে বিমান শিল্প, খাদ্য, ওয়াইন ও বিলাসবহুল পণ্যের কোম্পানি রয়েছে, যেগুলো বাজার হারানোর আশঙ্কায় রয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য বিভাগের অধীনস্থ ব্যুরো অফ ইকোনমিক অ্যানালাইসিস (বিইএ) অনুসারে, পুরো ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বার্ষিক বাণিজ্য উদ্বৃত্ত ২৩৫.৬ বিলিয়ন ডলার, যা কেবল চীনের পরেই দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আয়ারল্যান্ডের বার্ষিক বাণিজ্য উদ্বৃত্ত ৮৬.৭ বিলিয়ন ডলার। যা ইইউর মধ্যে সবচেয়ে বেশি। এর প্রধান কারণ হলো যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বড় বড় ওষুধ কোম্পানি যেমন ফাইজার, এলি লিলি এবং জনসন অ্যান্ড জনসনের উপস্থিতি। এসব প্রতিষ্ঠান আয়ারল্যান্ডে তাদের কার্যক্রম গড়ে তুলেছে ১৫ শতাংশ কর্পোরেট কর সুবিধা নেওয়ার জন্য, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রে এই হার ২১ শতাংশ।
এই কোম্পানিগুলো তাদের ওষুধের পেটেন্ট আয়ারল্যান্ডে নিবন্ধন করে এবং সেখান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বিক্রি করে, যেখানে ওষুধের দাম বিশ্বের অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় অনেক বেশি।
আয়ারল্যান্ডে মার্কিন প্রযুক্তি জায়ান্ট অ্যাপল, গুগল এবং মেটার ইউরোপীয় সদরদপ্তরও অবস্থিত। তারাও কম করহার ও করবান্ধব আইরিশ ব্যবস্থার কারণে সেখানে ঘাঁটি গেড়েছে।
ইউরোস্ট্যাটের তথ্য অনুযায়ী, ইউরোপীয় ইউনিয়নের যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানির ২২.৫ শতাংশই আসে ওষুধ খাত থেকে। অনেক বড় কোম্পানি ইতিমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রে বড় বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের বৃহত্তম অর্থনীতি জার্মানি বর্তমানে বিশেষ চাপে রয়েছে। কারণ দেশটির অর্থনীতি অনেকটাই রপ্তানিনির্ভর। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে জার্মানির বাণিজ্য উদ্বৃত্ত ৮৪.৮ বিলিয়ন ডলার। যার পেছনে বড় ভূমিকা রাখছে দেশটির বিশাল আকারের অটোমোবাইল, রাসায়নিক, ইস্পাত এবং যন্ত্রপাতি শিল্প।
মার্সিডিজ বেঞ্জ-এর মোট আয়ের ২৩ শতাংশই আসে মার্কিন বাজার থেকে। যদিও এর একটি অংশ যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি এসইউভি রপ্তানি থেকে আসে, তবুও ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষ থেকে সম্ভাব্য প্রতিশোধমূলক শুল্কের আওতায় পড়ে যেতে পারে এই রপ্তানি।
ফেডারেশন অব জার্মান ইন্ডাষ্ট্রিজ (বিডিআই) শনিবার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘোষণা সম্পর্কে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানায়। তারা ইইউ ও যুক্তরাষ্ট্রকে দ্রুত সমাধান খোঁজার এবং উত্তেজনা বাড়ার ঝুঁকি এড়ানোর আহ্বান জানিয়েছে।
মার্কিন পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ইতালি ও ফ্রান্স যথাক্রমে ৪৪ বিলিয়ন ডলার ও ১৬.৪ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত ধরে রেখেছে (যদিও ফরাসি পরিসংখ্যানে উদ্বৃত্ত অনেক কম দেখানো হয়েছে)। এই কারণে ধারণা করা হচ্ছে, তারা তুলনামূলকভাবে কম ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবে কিছু খাত রয়েছে যেগুলো শুল্কের প্রভাবে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। বিশেষ করে খাদ্য ও ওয়াইন শিল্প দুটি দেশেই শুল্কের কারণে বড় ধরনের আঘাত পেতে পারে, যেমনটা স্পেনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
ফরাসি কৃষক ইউনিয়ন এফএনএসইএ-এর আঙ্গুরচাষ শাখার প্রধান জেরোম ডেস্পে শনিবার বলেছেন, ৩০ শতাংশ শুল্ক ফরাসি ওয়াইন ও স্পিরিট খাতের জন্য এক কথায় ‘বিপর্যয়’ হবে।
ইতালির প্রধান কৃষি সংস্থা কোল্ডিরেত্তি শনিবার জানিয়েছে যে ৩০ শতাংশ শুল্কের ফলে মার্কিন ভোক্তা এবং ইতালীয় খাদ্য উৎপাদনকারীদের প্রায় ২.৩ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হবে।
জার্মানির মতো, ইতালিও তার মোটরগাড়ি খাত নিয়ে উদ্বিগ্ন। এই অনিশ্চয়তার কারণে ফ্রাঙ্কো-ইতালীয় নির্মাতা স্টেলান্টিস (বিশেষ করে ফিয়াট এবং পিউজো) বছরের জন্য তার পূর্বাভাস স্থগিত করেছে।
ফ্রান্সের ঝুঁকিপূর্ণ খাতগুলোর মধ্যে রয়েছে বিমানশিল্প ও বিলাসবহুল পণ্যের খাতও। বিশ্বের বৃহত্তম বিলাসবহুল সামগ্রীর গ্রুপ এলভিএমএইচ। তাদের মোট বিক্রির এক-চতুর্থাংশই করে যুক্তরাষ্ট্রে।
এছাড়াও, যুক্তরাষ্ট্রে ফ্রান্সের মোট রপ্তানির প্রায় এক পঞ্চমাংশই আসে মহাকাশ খাত থেকে। যার বড় একটি অংশ এয়ারবাস-এর তৈরি বিমান ও প্রযুক্তি।
অস্ট্রিয়া ও সুইডেন যথাক্রমে ১৩.১ বিলিয়ন ও ৯.৮ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য উদ্বৃত্তের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইতিবাচক অবস্থানে রয়েছে।