ঢাকা, ৬ আগস্ট, ২০২৫ (বাসস): ইতালি সরকার সিসিলি দ্বীপকে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত করতে বুধবার ১৩.৫ বিলিয়ন ইউরো (১৫.৬ বিলিয়ন ডলার) ব্যয়ে বিশ্বের দীর্ঘতম ঝুলন্ত সেতু প্রকল্প অনুমোদন করেছে।
রোম থেকে এএফপি জানায়, প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনির জোট সরকার এই রাষ্ট্রায়ত্ত প্রকল্পকে ইতালির দারিদ্র্যপীড়িত দক্ষিণাঞ্চলের জন্য অর্থনৈতিক উত্তরণ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। তবে সমালোচকরা সতর্ক করে বলেছেন, এটি একটি আর্থিক ‘ব্ল্যাক হোল’ বা বিশাল অপচয়ের ফাঁদে পরিণত হতে পারে।
সিসিলি ও কালাব্রিয়া (ইতালির বুট আকৃতির মানচিত্রের পায়ের গোড়ার অঞ্চল) এর মাঝে অবস্থিত সরু জলরেখা, মেসিনা প্রণালীর ওপর একটি সেতু নির্মাণ নিয়ে ইতালীয় রাজনীতিকরা কয়েক দশক ধরে বিতর্ক চালিয়ে আসছেন।
কিন্তু মন্ত্রীদের দাবি, বুধবার সরকারি কমিটি সিআইপিইএসএস কর্তৃক অনুমোদনই এ প্রকল্পের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অগ্রগতি।
সমর্থকদের মতে, ২০৩২ সালের মধ্যে নির্মাণ সম্পন্ন হওয়ার কথা থাকা এই সেতু হবে প্রকৌশলের সর্বাধুনিক নিদর্শন। এটি এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে, যাতে ভূমিকম্পপ্রবণ দুটি টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে থাকলেও তীব্র বাতাস ও ভূমিকম্প প্রতিরোধ করতে পারে।
এই সেতুতে মাঝ বরাবর দুটি রেললাইন ও উভয় পাশে তিনটি করে যানবাহন চলাচলের লেন থাকবে। সেতুর ঝুলন্ত অংশ হবে ৩.৩ কিলোমিটার (২.০৫ মাইল)—যা হবে বিশ্ব রেকর্ড—এটি ৪০০ মিটার (১,৩০০ ফুট) উঁচু দুটি টাওয়ারের মধ্যে বিস্তৃত থাকবে।
পরিবহন ও অবকাঠামোবিষয়ক দায়িত্বপ্রাপ্ত উপপ্রধানমন্ত্রী মাত্তেও সালভিনি সাংবাদিকদের জানান, সেপ্টেম্বর বা অক্টোবরের মধ্যেই কাজ শুরু হতে পারে।
তিনি বলেন, সেতুটি ও সংশ্লিষ্ট নতুন সড়ক, রেললাইন ও স্টেশনগুলো সিসিলি ও কালাব্রিয়ার জন্য একটি ‘উন্নয়ন ত্বরান্বায়ক’ হিসেবে কাজ করবে—অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়াবে ও লক্ষাধিক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে, যার অনেকগুলোই হবে দক্ষ পেশা।
তবে প্রকল্পটি পরিবেশগত প্রভাব ও ব্যয় নিয়ে স্থানীয় পর্যায়ে প্রতিবাদ জন্ম দিয়েছে। সমালোচকদের মতে, এই বিপুল অর্থ অন্যত্র ব্যয় করা উচিত।
গ্রিনস অ্যান্ড লেফট অ্যালায়েন্সের সংসদ সদস্য নিকোলা ফ্রাতোইয়ানি বলেন, এটি একটি ‘মেগা প্রকল্প যা বিশাল পরিমাণ রাষ্ট্রীয় সম্পদ সরিয়ে নেবে’ এবং ‘একটি বৃহৎ কালো গহ্বরে পরিণত হওয়ার ঝুঁকি রাখে।’
২০২৪ সালের বাজেট মূল্যায়নে ইতালির হিসাব নিরীক্ষা আদালত এই প্রকল্পে ঋণে জর্জরিত রাষ্ট্রের অতিরিক্ত বিনিয়োগের সমালোচনা করেছে।
মধ্য-বামপন্থী ডেমোক্রেটিক পার্টি সতর্ক করেছে যে প্রকল্পটি ‘পরিবেশগত, নিরাপত্তা ও ইউরোপীয় মানদণ্ড—এবং সাধারণ জ্ঞান—সবই লঙ্ঘন করছে।’
মেসিনা শহরের পাবলিক প্রসিকিউটর সম্প্রতি সতর্ক করেছেন যে সংগঠিত অপরাধচক্র এই প্রকল্প থেকে লাভবান হতে পারে। তবে সালভিনি বুধবার জোর দিয়ে বলেন, সরকার মাফিয়াদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সর্বোচ্চ পদক্ষেপ নেবে।
বর্তমানে বিশ্বের দীর্ঘতম ঝুলন্ত সেতু হলো তুরস্কের ১৯১৫ চানাক্কালে ব্রিজ, যার মূল ঝুলন্ত অংশ ২.০২৩ কিলোমিটার (১.২৫৭ মাইল), যা ২০২২ সালে উদ্বোধন করা হয়।
অনেকেই বিশ্বাস করেন, ইতালির এই উচ্চাকাঙ্ক্ষী প্রকল্প আদৌ বাস্তবায়ন হবে না, কারণ অতীতে অনেক সরকার এ ধরনের মহাপরিকল্পনার ঘোষণা দিলেও বাস্তবায়ন করতে পারেনি।
এই প্রকল্পের প্রাথমিক নকশা তৈরি হয় ৫০ বছরেরও বেশি আগে।
২০০৬ সালে ইতালীয় নির্মাণ প্রতিষ্ঠান ওয়েবিল্ড-এর নেতৃত্বাধীন ইউরোলিঙ্ক কনসোর্টিয়াম দরপত্র জেতে, কিন্তু ইউরোজোন ঋণ সংকটের কারণে সরকার প্রকল্পটি বাতিল করে।
এখনো সেই একই কনসোর্টিয়াম পুনর্জীবিত প্রকল্পের দায়িত্বে রয়েছে।
এইবার, রোম সরকার একটি নতুন কৌশল নিচ্ছে—সেতু নির্মাণ ব্যয়কে ‘প্রতিরক্ষা খাতের ব্যয়’ হিসেবে দেখানোর উদ্যোগ।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দাবির প্রেক্ষিতে ইতালি তার সামরিক ব্যয় জিডিপির ৫ শতাংশে উন্নীত করতে সম্মত হয়েছে। এর মধ্যে ১.৫ শতাংশ সাইবার নিরাপত্তা ও অবকাঠামোসহ ‘প্রতিরক্ষাসংশ্লিষ্ট’ খাতে ব্যয় করা যাবে—এবং সরকার আশা করছে মেসিনা সেতু এ শ্রেণিতে পড়বে, বিশেষ করে সিসিলিতে একটি ন্যাটো ঘাঁটি থাকায়।
বর্তমানে মেসিনা প্রণালী পার হতে ফেরিতে গাড়িতে কমপক্ষে এক ঘণ্টা এবং ট্রেনে প্রায় দুই ঘণ্টা লাগে—ট্রেনের প্রতিটি বগি আলাদাভাবে ফেরিতে তোলা হয়। তবে এই সেতু চালু হলে যাত্রাকাল গাড়িতে ১০ মিনিট ও ট্রেনে ১৫ মিনিটে নামিয়ে আনা যাবে।
মেলোনি বুধবার জোর দিয়ে বলেন, এটি ‘ইতালির ইচ্ছাশক্তি ও প্রযুক্তিগত দক্ষতার প্রমাণ’, যা ‘আরও দ্রুত ও আধুনিক রাষ্ট্র গঠনের মেরুদণ্ডে পরিণত হবে।’