ঢাকা, ৯ আগস্ট, ২০২৫ (বাসস) : জাপানের নাগাসাকি শহরে পরমাণু বোমা হামলার ৮০তম বার্ষিকী উপলক্ষে শনিবার হাজার হাজার মানুষ নীরবতা পালন করেন। একই সঙ্গে শহরের ক্যাথেড্রালের দুটি ঘণ্টা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে মানবজাতির ইতিহাসকে চিরতরে বদলে দেওয়া সেই ঘটনার পর প্রথমবার একসঙ্গে ঘণ্টা বাজানো হয়।
১৯৪৫ সালের ৯ আগস্ট সকাল ১১:০২ মিনিটে, হিরোশিমায় পরমাণু হামলার তিন দিন পর, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নাগাসাকিতে একটি পরমাণু বোমা ফেলে।
শনিবার সকাল ভারি বৃষ্টি হওয়া সত্ত্বেও অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার আগ মুহূর্তে বৃষ্টি থেমে যায় এবং নাগাসাকি মেয়র শিরো সুজুকি বিশ্বকে ‘অস্ত্র বিরতি অবিলম্বে বন্ধ করার’ আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, ‘আশি বছর পেরিয়ে গেছে, আর কার কথা ভাবতে পারত যে পৃথিবী এমন অবস্থায় পৌঁছাবে? একটি এমন সংকট যা মানবজাতির অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলছে, যেমন পরমাণু যুদ্ধ।”
নাগাসাকি শহরে প্রায় ৭৪,০০০ জন নিহত হন, হিরোশিমার নিহত ১,৪০,০০০ জনের বেশি মানুষ। পরবর্তী ১৫ আগস্ট, ১৯৪৫ সালে, জাপান আত্মসমর্পণ করে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসান ঘটে।
ঐতিহাসিকরা এই হামলাগুলো সত্যিই জীবন রক্ষা করেছিল কিনা এবং যুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে ভূমি আক্রমণ রোধ করেছিল কিনা তা নিয়ে বিতর্ক করেন।
তবে হামলা থেকে বেঁচে যাওয়া অনেকের জন্য এই হিসাবের কোনো গুরুত্ব ছিল না। তারা দশকের পর দশক শারীরিক ও মানসিক আঘাতের সঙ্গে লড়াই করেছেন, এবং অনেক সময় ‘হিবাকুশা’ বা বোমা আক্রান্ত হিসেবে কলঙ্ক বয়ে চলেছেন।
বেঁচে যাওয়া ৯৩ বছর বয়সী হিরোশি নিশিওকা বোমা বিস্ফোরণের স্থান থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে ছিলেন, তিনি অনুষ্ঠানে যুবক অবস্থায় তিনি কী ভয়ঙ্কর দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেছিলেন তার বর্ণনা দেন।
তিনি স্মরণ করেন, ‘যারা সৌভাগ্যবান (যারা গুরুতর আহত হননি) ধীরে ধীরে তাদের মাড়ি থেকে রক্তপাত শুরু হয়, চুল পড়তে থাকে, আর তারা একে একে মারা যায়।’
নাগাসাকির বাসিন্দা আটসুকো হিগুচি এএফপিকে জানান, ‘সবাই শহরের নিহতদের স্মরণ করছে বলে আমি খুশি।’
তিনি বলেন, ‘এগুলো অতীতের ঘটনা হিসেবে না দেখে, আমাদের মনে রাখতে হবে এগুলো বাস্তব ঘটনা।’
শনিবার নাগাসাকি ইম্যাকুলেট কনসেপশন ক্যাথেড্রালের দুটি ঘণ্টা ১৯৪৫ সালের পর প্রথমবার একসঙ্গে ঘণ্টা বাজানো হয়।
লাল ইটের বিশাল এই ক্যাথেড্রাল, যার দুটি ঘণ্টার টাওয়ার একটি পাহাড়ের মাথায় অবস্থিত, ১৯৫৯ সালে পুনর্নির্মাণ করা হয়। এটি বিস্ফোরণে প্রায় সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।
মাটির নিচ থেকে মাত্র একটি ঘণ্টা উদ্ধার করা গিয়েছিল, ফলে উত্তরের টাওয়ারটি নীরব ছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের চার্চগোত্রের অর্থায়নে একটি নতুন ঘণ্টা তৈরি করা হয় এবং তা টাওয়ারে পুনঃস্থাপন করা হয়, যা বোমা ফেলার মুহূর্তে বাজানো হয়।
ক্যাথেড্রালের প্রধান পুরোহিত কেনিচি ইয়ামামুরা বলেন, এই ঘণ্টার পুনর্স্থাপন ‘মানবতার মহত্ত্ব প্রদর্শন করে।’
তিনি বলেন, ‘এটা অতীতের ক্ষত ভুলে যাওয়ার ব্যাপার নয়, বরং সেগুলো স্বীকার করে তা মেরামত ও পুনর্গঠনে কাজ করা, এবং এভাবেই শান্তির জন্য একসাথে কাজ করা।’
তিনি এই ঘণ্টার বাজনাকে বিশ্বে বার্তা হিসেবে দেখেন, যেখানে নানা সংঘাত চলছে এবং নতুন একটি অস্ত্র প্রতিযোগিতা তীব্র হয়ে উঠেছে।
তিনি বলেন, ‘আমরা সহিংসতায় সহিংসতায় প্রতিক্রিয়া দেখাবো না, বরং আমাদের জীবনযাপন ও প্রার্থনার মাধ্যমে দেখাবো অন্যের জীবন নেয়ার কতটা অর্থহীন।’
প্রায় ১০০টি দেশ এ বছর স্মরণসভায় অংশগ্রহণ করে, যার মধ্যে রাশিয়াও রয়েছে। ইউক্রেন আক্রমণের কারণে দেশটিকে ২০২২ সালে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।
গাজার যুদ্ধের কারণে গত বছর যার রাষ্ট্রদূতকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি, তবে এবার ইসরাইল উপস্থিত ছিল।
আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক, যাঁর দাদা প্রথম পরমাণু বোমা তৈরির ম্যানহাটান প্রকল্পে যুক্ত ছিলেন তিনি এই ঘণ্টার প্রকল্পের উদ্যোগী ছিলেন।
নাগাসাকিতে তার গবেষণার সময় এক জাপানি খ্রিস্টান তাঁকে বলেন, জীবদ্দশায় তিনি ক্য থেড্রালের দুটি ঘণ্টা একসঙ্গে বাজতে শুনতে চান।
এই ধারণায় অনুপ্রাণিত হয়ে উইলিয়ামস কলেজের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক জেমস নোলান যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় এক বছর ধরে মূলত চার্চগুলোতে পরমাণু বোমা নিয়ে বক্তৃতা শুরু করেন।
তিনি নতুন ঘণ্টার জন্য আমেরিকান ক্যাথলিকদের কাছ থেকে ১ লাখ ২৫ হাজার ডলার তহবিল সংগ্রহ করেন।
নাগাসাকিতে যখন এটি উন্মোচন করা হয়, তখন নোলান বলেন, ‘প্রতিক্রিয়া অসাধারণ ছিল, অনেকেই চোখে জল নিয়ে ছিলেন।’
তিনি আরও জানান, তিনি দেখা অনেক আমেরিকান ক্যাথলিক নাগাসাকির খ্রিস্টানদের কষ্টকর ইতিহাস সম্পর্কে জানতেন না, যাদের বিশ্বাস ১৬শ শতকে প্রথম ইউরোপীয় মিশনারিদের মাধ্যমে গড়ে ওঠে এবং পরবর্তীতে জাপানি শোগুনদের দ্বারা ২৫০ বছর ধরে গোপনে টিকিয়ে রাখা হয়।
এই গল্পটি শুসাকু এন্ডোর উপন্যাস ‘সাইলেন্স’-এ বলা হয়েছে, যা মার্টিন স্করসেসের ২০১৬ সালের চলচ্চিত্রে রূপায়িত হয়।
নোলান বলেন, আমেরিকান ক্যাথলিকরা নাগাসাকির খ্রিস্টানদের পরমাণু বোমার পরও ধৈর্য ধরার কাহিনী শুনে ‘সহানুভূতি ও দুঃখ প্রকাশ করেছে।’
তারা ‘ক্ষমা ও পুনর্গঠনের ইচ্ছাশক্তি’ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছেন।