শিরোনাম
ঢাকা, ১৫ মে, ২০২৪ (বাসস) : প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেছেন, আমাদের সকলের আন্তরিক চেষ্টায় বাংলাদেশের বিচার বিভাগ স্মার্ট ও অন্যান্যের কাছে অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে উঠবে। ‘স্মার্ট লিগ্যাল এইড, স্মার্ট দেশ- বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ’ এবং ‘উচ্চ আদালতে স্মার্ট আইনি সেবার প্রসার’ শীর্ষক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তৃতায় তিনি এ কথা বলেন।
সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইড কমিটির চেয়ারম্যান বিচারপতি নাইমা হায়দারের সভাপতিত্বে মঙ্গলবার বিকেলে আয়োজিত আলোচনা এ সভায় বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তৃতা করেন আপিল বিভাগের জেষ্ঠ্য বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম, আপিল বিভাগের বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন, এটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক সিনিয়র এডভোকেট শাহ মঞ্জুরুল হক, সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্টার জেনারেল মোঃ গোলাম রব্বানী, জাতীয় আইনগত সহায়তা সংস্থার পরিচালক আল মামুন। সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইড অফিসার ফারাহ মামুনের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তৃতা করেন সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইড কমিটির সদস্য সচিব অবন্তি নুরুল। অনুষ্ঠানে হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতিগণ, সুপ্রিম কোর্ট রেজিস্ট্রির বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাবৃন্দ, সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইড অফিসের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাগণ, প্যানেল আইনজীবীগন, ল' রিপোর্টার্স ফোরামের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেন, একটি দেশের শাসন বিভাগ স্মার্ট হলে, সেই দেশের সরকার স্মার্ট হবে এবং সেই দেশটিও স্মার্ট হবে। লিগ্যাল এইডকে স্মার্ট করতে গেলে, যে সমস্ত আইনজীবী আইনি সহায়তা দিবেন তাদের স্মার্ট হতে হবে। আর এই স্মার্ট পোশাকে নয়, তাদের আইন জানতে হবে। বিনামূল্যে আইনি সহায়তা দেবার মানসিকতা থাকতে হবে। তখনই একজন স্মার্ট আইনজীবী হওয়া যাবে। তিনি বলেন, আমাদের সংবিধানে আইনের দৃষ্টিতে সকলের সমতাকে মৌলিক অধিকারের মর্যাদা দেয়া হয়েছে। একইসাথে, মানুষের ন্যায়বিচার প্রাপ্তির অধিকারের নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে। তিনি বলেন, উলেখিত অধিকারগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো- 'ন্যায়বিচার প্রাপ্তিতে সাধারণ জনগণের আইনি অভিগম্যতা নিশ্চিতকরণ'। আর 'জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস'- এর তাৎপর্য কিন্তু এখানেই নিহিত। কেননা, আমাদের দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ন্যায়বিচার প্রাপ্তিতে অভিগম্যতায় একাধিক আর্থ-সামাজিক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। দেশের একজন নাগরিক, তিনি যত অস্বচ্ছলই হোন না কেন, আর্থিক অসঙ্গতি এখন তার ন্যায় বিচার প্রাপ্তির অভিগম্যতায় আর কোনো প্রতিবন্ধকতা নয়। দেশের সকল অধস্তন আদালতের পাশাপাশি ২০১৫ সাল হতে সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইড অফিস দেশের উচ্চ আদালতে বিচারাধীন বিভিন্ন মামলায় অসচ্ছল বিচারপ্রার্থীকে আইনি সেবা প্রদানের নিমিত্ত বিনা খরচে প্যানেল আইনজীবী নিযুক্ত করছে। ফলে দেশের দূর দূরান্ত হতে আগত একজন নাগরিক বিনা ভোগান্তিতে সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইড অফিসের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় আইনি সেবা পাচ্ছেন। এজন্য আমি সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইড অফিসকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি।
তিনি বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ হতে আমরা এখন স্মার্ট বাংলাদেশের পথে যাত্রা শুরু করেছি। এই যাত্রা তখনই সফল হবে, যখন আমরা ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণী নির্বিশেষ সকলের জন্য ন্যায়বিচার প্রাপ্তির অভিগম্যতা নিশ্চিত করতে পারবো। আর, আইনি প্রক্রিয়ায় সকলের অভিগম্যতা ছাড়া টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন অসম্ভব একটি ব্যাপার। তাই এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদেশের আইনগত সহায়তা কার্যক্রম বা লিগ্যাল এইড গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আমি বিশ্বাস করি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমাদের দেশের আদালতসমূহে অবস্থিত লিগ্যাল এইড
অফিসসমূহ কেবল অস্বচ্ছল মানুষকে আইনি প্রতিকার প্রদান নয় বরং অদূর ভবিষ্যতে সকল শ্রেণীর বিচারপ্রার্থীর নির্ভরতার আস্থারস্থল হিসেবে স্থান করে নেবে।
প্রধান বিচারপতি অসহায় ও দুস্থ বিচারপ্রার্থীদের আইনি সহায়তা দিতে গড়ে তোলা জাতীয় আইনগত সহায়তা সংস্থা পরিচালনায় অসামঞ্জস্যও তুলে ধরে বলেন, প্রধান বিচারপতির কোনও প্রতিনিধি সেখানে নেই। রেজিস্ট্রার জেনারেল (সুপ্রিম কোর্টের) সেখানে সদস্য কিন্তু পদাধিকার বলে। লিগ্যাল এইড আইনি সেবায় প্রধান বিচারপতির কোনও রোল নেই, জাতীয় আইনগত সহায়তায়। আর সুপ্রিম কোর্টে যে লিগ্যাল এইড কমিটি আছে, সেটা কার অধীনে, কার সঙ্গে কাজ করে। প্রধান বিচারপতি এখানে একজনকে মনোনীত করবেন, তিনি এর সভাপতি হবেন। তিনি হবেন হাইকোর্ট বিভাগের একজন বিচারপতি, তার সঙ্গে কে থাকবেন সেটাও বলা আছে। কিন্তু তিনি কার কাছে জবাবদিহি করবেন- তা বলা নাই। জাতীয় আইনগত সহায়তার কাছে, নাকি প্রধান বিচারপতির কাছে? এ বিষয়গুলো এলামনি আছে। প্রধান বিচারপতি বলেন, বাজেট যদি না থাকে আপনি যাই বলেন, কিছু করতে পারবেন না। আপনি লিগ্যাল এইড দিচ্ছেন। যে আইনজীবী আমাদের এই সহায়তা দিচ্ছেন, তাকে কি আমরা সামান্য কিছু আর্থিক সহায়তা দিতে পারছি? এ সময় প্রধান বিচারপতি ভারতের জাতীয় আইনগত সহায়তা (ন্যাশনাল লিগ্যাল সার্ভিস অথরিটি) সংস্থার উদাহরণ টেনে বলেন, সেখানের প্রধান হচ্ছেন প্রধান বিচারপতি, আর তার প্রধান নির্বাহী হচ্ছেন প্রধান বিচারপতির মনোনীত একজন। সিনিয়র ডিস্ট্রিক্ট জাজরা সেখানে নির্বাহী দায়িত্ব পালন করছেন। সবখানে কিন্তু বিচার বিভাগের প্রাধান্য। আর আমাদের লিগ্যাল এইড কমিটিতে মন্ত্রী আছেন, যদিও তিনি একজন আইনজীবী। তিনি বাদে বাকি যারা আছেন, সবাই কিন্তু আমলা। পৃথিবীর সব থেকে বড় গণতান্ত্রিক দেশ ভারত, তাদের চিন্তা আর আমাদের চিন্তার মধ্যে পার্থক্য দেখুন।
তিনি বলেন, আমরা বাংলাদেশে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন তৈরি করলাম, এ কমিশনের প্রধান ছিলেন একজন বিচারপতি। তারপর থেকে কী হলো। তারপর যাকে ইচ্ছা তাকে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে, যা আপনারা দেখছেন। মানবাধিকার এবং আইনগত জাতীয় সহায়তা এসব যা আছে, তা নিয়ে সরকারকে অনেক অনেক বেশি ভাবতে হবে। এটা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা দরকার বলে তিনি মন্তব্য করেন।
প্রধান বিচারপতি বলেন, দেশের বাহিরে আইনজীবীদের জন্য প্রশিক্ষণের বিষয়ে চিন্তা করছি। তথ্য প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। বিচার বিভাগে কিভাবে এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করা যায়, সে বিষয়ে কাজ করছি আমরা। তিনি প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, আইনজীবীদের জন্য একটি রিসার্চ ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠায় সহায়তা চেয়েছিলাম। প্রধানমন্ত্রীর দ্রুতই আমাদেরকে কক্সবাজারে সেটির জন্য জমির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। পরবর্তী প্রজন্মের আইনজীবীরা এর সুফল ভোগ করবে বলে প্রধান বিচারপতি আশা প্রকাশ করেন।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তৃতায় আপিল বিভাগের বিচারপতি এম, ইনায়েতুর রহিম বলেন, সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের প্রতিটি বেঞ্চ যদি মাসে কমপক্ষে একটি করে এবং আপিল বিভাগ যদি মাসে কমপক্ষে দুটি করে লিগ্যাল এইডের মামলা নিষ্পত্তি করে, তাহলে সুপ্রিম কোর্টের লিগ্যাল এইডের মামলা খুব দ্রুত নিষ্পত্তি হবে।
আপিল বিভাগের বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, বঙ্গবন্ধু তার জীবনে ক্ষমতা নয় সমতা চেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুই একমাত্র ব্যক্তি যিনি আমাদের দেখিয়ে গেছেন সমতা কাকে বলে। আমরা সেই সমতা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছি কিন্তু আজও আমরা সেই সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। প্রত্যেকের উচিত নিজের যায়গা থেকে সমতার মধ্যে থাকার চেষ্টা করা।
আলোচনা সভায় সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইড কমিটির চেয়ারম্যান বিচারপতি নাইমা হায়দার স্মার্ট লিগ্যাল এইড প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আইনজীবীদের মন-মানসিকতার পরিবর্তনের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইড অফিসের বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা তুলে ধরেন।