শিরোনাম
ঢাকা, ১১ জানুয়ারি, ২০২৫ (বাসস) : মুক্তিযোদ্ধার স্বপক্ষে কোন প্রমাণ ছাড়াই সুবিধা দাবি করছেন অডিট অধিদপ্তরের সাবেক অডিটর মো. মজিবুর রহমান।
মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তার দাখিল করা প্রত্যায়ন পত্র যাচাইয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় হতে জানানো হয় যে, ‘এরকম কোন প্রত্যয়নপত্র মন্ত্রণালয় হতে ইস্যু করা হয়নি এবং ভূয়া-জাল প্রত্যয়নপত্র দাখিলকারীর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ করা হয়।’
মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি নিয়ে তিনি প্রতিবারই মুক্তিযোদ্ধা সনদ প্রদানে ব্যর্থ হয়েছেন বলে জানায় সংশ্লিষ্টরা।
অডিট ডাইরেক্টর পলাশ বাগচী বাসস’কে বলেন, পেনশন সুবিধা নিষ্পত্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক কাগজসহ মুক্তিযোদ্ধা সনদ যাচাইয়ের সময় প্রতীয়মান হয় তার কোথাও মুক্তিযোদ্ধা সনদ নেই এবং প্রাতিষ্ঠানিক সনদেও অসংগতি রয়েছে। মজিবুর রহমানের প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল-১ এ আনা মামলার আদেশের বিষয়ে অডিট অধিদপ্তর আইনগত পদক্ষেপ নিবেন। পলাশ বাগচি বলেন, মুক্তিযোদ্ধা ও একাডেমিক সার্টিফিকেট বস্তুনিষ্ঠ না থাকার পরও চাকরি জীবন শেষ করে সরকারি বাসা দখলে রেখে তিনি ২০ লাখ টাকার মত রাষ্ট্রের আর্থিক ক্ষতি করেছেন।
এ বিষয়ে মজিবুর রহমানের বক্তব্য জানতে তার মোবাইলে ফোন দিলেও সেটি আর ব্যবহৃত হচ্ছে না বলে অপারেটর জানায়।
সাবেক অডিটর মো. মজিবুর রহমান ১৯৭৯ সালের ৭ জুলাই জুনিয়র অডিটর পদে যোগদান করে সংস্থাপনে অন্তর্ভুক্তি হয়েছিলেন। যোগদানের সময় তিনি নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আবেদনে উল্লেখ করলেও কোন প্রকার মুক্তিযোদ্ধা সনদ দাখিল করেননি। চাকরির ৩৭ বছর পূর্তিতে ২০০৯ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি তিনি এলপিআর-এ যান। ৫৭ যছর পূর্তিতে এলপিআরে যাওয়ার মাধ্যমে আর্থিক সুবিধাদি (ল্যামগ্রান্ট) গ্রহণ করেন। তবে এলপিআর ভোগকালীন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ২০০৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর এক সিদ্ধান্তে মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তাদের চাকরির মেয়াদ ২ বছর বাড়ানো হয়। তখন মজিবুর রহমান ২০১০ সালের ৭ জানুয়ারি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আরো ২ বছর চাকরি করার আবেদন করেন। মো. মজিবুর রহমান ১৯৭৭ সালের ১৬ নভেম্বর চাকুরিতে যোগদানকালে আবেদন পত্রের ক্রমিক নং-১০ এ নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে উল্লেখ করেন। সেখানে তার মূল মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট কেন্দ্রীয় সংসদে জমা আছে বলে উল্লেখ করেন। বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলে তার সনদ জমা রয়েছে উল্লেখপূর্বক চাকরিতে প্রবেশে সুপারিশ করা হলেও তিনি কখনো দেখাতে পারেননি যে তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। তার কাছে বার বার মুক্তিযোদ্ধা সনদ চাওয়া হলে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত তিনি কোন সনদপত্র দাখিল না করে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদে মুক্তিযোদ্ধা সনদ প্রাপ্তির জন্য শুধু মাত্র একটি আবেদন পত্রের কপি জমা দেন।
মো. মুজিবুর রহমানের ঘটনা তদন্তে ২০২০ সালের ২৭ জুলাই একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটি তার বিরুদ্ধে ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদের প্রত্যয়নপত্র দাখিল ও বিনা অনুমতিতে সিএজি কার্যালয়ের বাসায় বসবাস বিষয়টি তদন্ত করেন।
ভূয়া ও জাল মুক্তিযোদ্ধা সনদের প্রত্যয়ন দাখিলের কারণে তার বিরুদ্ধে ফৌজদারী ব্যবস্থা গ্রহণের মতামত দেন তদন্ত কমিটি। পাশাপাশি ২০১০ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি হতে ২০১৮ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত ৮ বছর ১ মাস ২৩ দিন অননুমোদিতভাবে বসবাসের জন্য স্ট্যান্ডার্ড রেটে বাসা ভাড়া এবং সরকারি পাওনা আদায় করারও পরমর্শ দেন কমিটি।
পরে মো. মজিবুর রহমান প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল-১, ঢাকায় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অতিরিক্ত ২ বছর চাকরিকাল গণনাসহ পেনশন সুবিধা প্রাপ্তির জন্য মামলা দায়ের করেন (মামলা নং-৭২, ২০২১)। চাকরিতে প্রবেশের আবেদনের সময় নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দাবী করার প্রেক্ষিতে একটি রায় হয়। প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের এক স্মারক উল্লেখ করে রায়ে বলা হয়, মুক্তিযোদ্ধা গণকর্মচারীদের সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সময় নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ঘোষণা সংক্রান্ত যে নির্দেশনা রয়েছে তা বজায় থাকবে, তবে ঘোষণা সংক্রান্ত প্রমাণাদি যাচাই করে নিতে হবে। এ রায়ের বিষয়ে আপিলের কাজ চলমান রয়েছে বলে জানান অডিট ডাইরেক্টর পলাশ বাগচি।
গত ২০২৪ সালের ৪ মে আদালতের নির্দেশনার প্রেক্ষিতে পেনশন সুবিধাদি দাবী করে এবং মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অতিরিক্ত ২ বছর চাকরিকাল গণনা করে পিআরএল মঞ্জুরীর আবেদন করেন মজিবুর রহমান।
মজিবুর রহমানের সনদপত্র যাচাইকালে চাকুরিতে প্রবেশকালে নূন্যতম যোগ্যতা এইচএসসি হলেও সনদপত্রে বেশ কিছু অসঙ্গতি পরিলক্ষিত হয়। তিনি এসএসসি পাশ করছেন ১৯৭০ সালে এবং এইচএসসি পাশ করছে ১৯৭২ সালে, এইচএসসি রেজিস্ট্রেশন নম্বর ৫৩১২/১৯৬৭-১৯৬৮, যা থেকে প্রতীয়মান হয় তিনি এসএসসি পাশের পূর্বেই এইচএসসি’র রেজিস্ট্রেশন করেছেন। অডিট কার্যালয় মজিবুরের এইচএসসি’র সনদের রেজিষ্ট্রেশনের সঠিকতা নিশ্চিতকরণের জন্য যশোর শিক্ষা বোর্ড বরাবর চিঠি প্রেরণ করে।
অডিট অধিদপ্তরে নথিপত্র যাচাই করে দেখা যায় যে, দীর্ঘ সময় মুক্তিযোদ্ধা দাবী করে চাকরি করে আসা কর্মকর্তা মজিবুরের মুক্তিযোদ্ধা ও একাডেমিক সার্টিফিকেট বিতর্কিত। তা সত্ত্বেও বিগত সময়ে এক অদৃশ্য শক্তির প্রভাবে তার বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা কার্যকর করা সম্ভব হয়নি।
ন্যায়বিচার নিশ্চিত ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ এ প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি অক্ষুন্ন রাখার স্বার্থে তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী ও আইনানুগভাবে মজিবুরের বিষয়টি নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হওয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করেন অডিট অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্টরা।