শিরোনাম
।। ফারাজী আহম্মদ রফিক বাবন ।।
নাটোর, ২১ জানুয়ারি, ২০২৫ (বাসস): নাটোরে এডেনিয়াম রাজ্য গড়ে তুলেছেন সুমনা। শীত ছাড়া সারা বছরজুড়ে এডেনিয়াম রাজ্যের গাছগুলো বাহারী রঙ ছড়িয়ে যায়, ছড়ায় মুগ্ধতা। শখের বশে মেলা থেকে এডেনিয়াম কিনে এনে এই এডেনিয়ামই এখন সুমনার ধ্যান-জ্ঞান, পেশা। পেয়েছেন সফলতা।
এডেনিয়াম বা ডেজার্ট রোজকে বলা যেতে পারে মরু গোলাপ। এই ফুল গাছের উৎপত্তি সাব-সাহারান আফ্রিকার মরুভূমি এবং আরব উপদ্বীপে। এডেনিয়াম মূলত সাকুলেন্ট প্রজাতির ছোট্ট একটা রূপ-যা ১৭৫২ সালে সর্বপ্রথম কেনিয়াতে খুঁজে পাওয়া যায়। মরুভূমি উৎপত্তিস্থল হলেও বর্তমানে পৃথিবীর সর্বত্র এডেনিয়ামের দেখা পাওয়া যায়। ফুলের রঙের বৈচিত্রতা, অদ্ভুত সুন্দর বনসাই আকার আর অতিমাত্রায় খরা সহনশীলতার কারনে বিশ্বব্যাপী এটি সমাদৃত।
স্নাতকোত্তর শেষ করে গৃহিণী পেশায় অফুরান সময় সুমনার। এক যুগ আগে বৃক্ষমেলায় তার নজর কাড়ে একটা এডেনিয়াম। বাড়িতে এনে পরম মমতায় শুরু করেন পরিচর্যা। বাহারী ফুলে প্রশান্তির পরশ। কৌতূহলী মনে শুরু করেন এডেনিয়ামের অনলাইন সব ভিডিও চিত্র দেখার কার্যক্রম। দেখতে দেখতে মুগ্ধতায় জড়িয়ে যাওয়া। শুরু হলো এডেনিয়াম গাছের সংগ্রহ অভিযান। সুমনার বাড়ির ছাদে এখন তাইওয়ান, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড আর ফিলিপাইনের হাজারো ভ্যারাইটি। সম্প্রতি সংগ্রহ করেছেন ইন্দোনেশিয়ার বাহারী রঙের ৩৫টি গাছ। শুধু সংগ্রহ নয়, একই সাথে চলে সিড আর গ্রাফটিং এর মাধ্যমে নতুন চারা তৈরি। এ যেন জার্মপ্লাজম সেন্টার, প্রায় আড়াই হাজার বর্গফুটের বাড়ির ছাদ পেরিয়ে এডেনিয়ামের আরও একটা উদ্যান গড়ে তোলার পরিকল্পনা চলছে মধুখালীতে।
দু’জন কর্মী ছাদ বাগানে কাজ করলেও সুমনা নিজের হাতেই গ্রাফটিং এর কাজ করেন। গাছের আবাস মিডিয়াগুলো বিশেষ প্রক্রিয়ায় পাতা পচা, হাড়কুচি, শিংকুচি, ধানের চিটা, ডোমার বালি আর ভার্মিকম্পোস্ট দিয়ে তৈরি। মিডিয়াগুলোর উপাদান শীতের শেষে একবার পরিবর্তন করা হয়-যখন গাছগুলো শীতনিদ্রা শেষে নতুন ফুল-পাতাতে সুশোভিত হওয়া শুরু করে। এখন মিডিয়া উপাদান পরিবর্তনের প্রস্তুতি চলছে। এরপর শুরু হবে গ্রাফটিং।
এখন শীত। গাছগুলো যেন শীত নিদ্রায়, সুমনার ছাদ উদ্যানে শীতকাল ছাড়া সারা বছর জুড়ে বাহারী ফুলের প্রাচুর্য। কিছু রঙ তো রীতিমত বিস্ময়ের। যেন এই রঙের কোনো নাম নেই। সিংগেল লেয়ার, তাইওয়ান-২, ম্যাপল, পারপেল ওয়াইন্ডমিল, ইয়োলো ইমপেরর, ব্লাক লাভার, এঞ্জেলা, সুগার ম্যাপল, জলি, গোল্ডফিশ, এ্যাডাম, ক্রীসপাম, পার্পেল স্টর্ম, ডাবল স্টার, পমিগ্রানেটসহ আরো অনেক। কিছু গাছের পাতা আকর্ষণীয়। আবার গাছের কাণ্ডই যেন অপার বিস্ময়। এমনই বাদামী রঙের নোভা তাঞ্জানিয়া গাছটা সংগ্রহ করেছেন সুমনা ৩০ হাজার টাকায়। আছে আরব-ইয়েমেনের অবেসাম।
সুমনার ছাদ উদ্যান খানিকটা লোকচক্ষুর অন্তরালে। মূলত গাছের কেনাবেচা চলে অনলাইনে। গত জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সুমনা বিক্রি করেছেন সাড়ে এগারো লাখ টাকার গাছ।
সুমনা বলেন, আমার আছে দুই কন্যা। কিন্তু সব গাছই আমার সুকন্যা। পরম মমতায় ওদের আগলে রাখি। বাহারী রঙের এডেনিয়াম ফুল দীর্ঘদিন ধরে ফুটে থাকে। তাই বাড়ির ছাদ, উঠোন বা সূর্যের রোদবহুল বাড়ির লনে এডেনিয়াম গাছ শোভাবর্ধন করে। শুধু শীতকালে ঘুমিয়ে থাকা গাছগুলো প্রায় সারাবছর জুড়ে ফুল দেয়। শীত আর অতিবৃষ্টি ছাড়া সব পরিবেশেই এসব গাছ টিকে থাকে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে সুমনা বললেন, এডেনিয়াম ফুলকে সর্বজনীন করতে চাই। সব বাড়ি যেন হয় এডেনিয়ামের বাড়ি, ফুলে ফুলে শোভিত। এডনিয়ামের প্রাচুর্যে থাইল্যান্ড অগ্রগামী, বাহারী রঙে এগিয়ে তাইওয়ান এবং ফিলিপাইন আর বাজার ও বিপণনে এগিয়ে দুবাই। দুবাইয়ের বাজারে আমরা যেতে চাই। আর আসন্ন মৌসুমে একটা প্রদর্শনী করতে চাই।
নাটোর হর্টিকালচার সেন্টারের উপ-পরিচালক ড. জাহাঙ্গীর ফিরোজ বলেন, নাটোরে এডেনিয়াম ফুলের পথিকৃৎ সুমনা। ইতোমধ্যে মেধা আর একনিষ্ঠতা দিয়ে তিনি এগিয়ে গেছেন অনেকদূর।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর নাটোর জেলা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মো. আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, সুমনা এডেনিয়ামকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন বহুদূরে, আমরা তাকে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে চাই। শীতের সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে এডেনিয়ামকে সারা বছরের উপযোগী করতে কৃষি বিভাগের নির্ধারিত প্রকল্প থেকে সুমনাকে একটি পলিনেট হাউজ তৈরি করে দেওয়ার জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছি।