শিরোনাম
।। নুসরাত সুপ্তি ।।
নারায়ণগঞ্জ, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ (বাসস) : জেলার দুটি সরকারি হাসপাতালের আইসিইউ অকেজো পড়ে আছে। অব্যবহারে নষ্ট হচ্ছে কোটি কোটি টাকার চিকিৎসা সরঞ্জাম। ফলে জেলার ‘নারায়নগঞ্জ ৩০০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল’ এবং ‘জেনারেল হাসপতাল (ভিক্টোরিয়া)’র ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট (আইসিইউ) থাকলেও সেবা পাচ্ছেন না মুমূর্ষু রোগীরা।
উনচল্লিশ লাখ মানুষ বসবাসরত এই জেলার সরকারি হাসপাতালের আইসিইউ’র শয্যা সংখ্যা ২০টি। যা প্রয়োজনের তুলনায় সামান্য। তা সত্বেও জনবলের অভাবে অকেজো হয়ে পড়ে আছে জেলার সরকারি হাসপাতাল দু’টির আইসিইউ। অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থেকে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে কোটি কোটি টাকার যন্ত্রপাতি। সুচিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন জেলাবাসী।
জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী , বারবার লোকবলের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করা হলেও হাসপাতাল দুটির আইসিইউ পরিচালনার জন্য কোনো লোকবল দেয়া হয়নি।
সরকার লোকবল না দেওয়ার কারণে আইসিইউ চালু করা সম্ভব হচ্ছে না বলে।
হাসপাতালের তথ্যানুযায়ী, করোনা মহামারীকালে ২০২০ সালের জুলাই মাসে নারায়ণগঞ্জ ৩০০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে চালু করা হয় ১০ শয্যার আইসিইউ। স্বল্প মূল্যে আইসিইউ সেবা পাওয়ায় হাসপাতালটি জনসাধারণের কাছে আশীর্বাদ হয়ে উঠে। কিন্তু করোনার প্রকোপ কমে যাওয়ায় পরবর্তীতে হাসপাতালের নিয়মিত কার্যক্রম শুরু হলে জনবলের অভাবে বন্ধ হয়ে যায় আইসিইউ সেবা।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, করোনার সময় ৩০০ শয্যা হাপাতালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে সংযুক্তির মাধ্যমে কয়েকজন চিকিৎসক কর্মরত ছিলেন। পরে ঐ চিকিৎসকরা বদলী হয়ে যান। পরবর্তীতে আাইসিইউ ইউনিট পরিচালনার জন্য দুই দফায় প্রয়োজনীয় সংখ্যক জনবল পদায়নের জন্য স্বাস্থ্য বিভাগের সচিব এবং পরিচালক বরাবর চিঠি দিয়ে আবেদন করা হয়। চাহিদার মধ্যে ছিল ৪ জন ক্রিটিক্যাল কেয়ার মেডিসিন স্পেশালিষ্ট, ১০ জন জুনিয়র কনসালটেন্ট (এ্যানেসথেশিয়া), ১৫ জন এ্যানেসথেসিওলজিষ্ট, ২ জন করে কার্ডিওলজিষ্ট, রেডিওলজিষ্ট, নেফ্রোলজিষ্ট ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ এবং ৫ জন মেডিকেল টেকনোলজিষ্ট।
অন্যদিকে জেনারেল ভিক্টোরিয়া হাসপাতালের ১০ শয্যা বিশিষ্ট আইসিইউ চালু করার মাত্র এক বছরের মধ্যে বন্ধ হয়ে যায়। এই হাসপাতালে আইসিইউ চালু রাখার জন্য প্রয়োজন দুইজন জুনিয়র কনসালটেন্ট , ৯ জন মেডিকেল অফিসার , ২০ জন নার্স এবং ৫ জন মেডিকেল ল্যাবরেটরি সায়েন্টিস্ট (এমএলএস)। আইসিইউ সেবা বন্ধ হওয়ার আগে একজন জুনিয়র কনসালটেন্ট , ৩জন মেডিকেল অফিসার , ৬ জন নার্স আইসিইউ বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন।
গুরুতর রোগীদের চিকিৎসায় আইসিইউ অতি গুরুত্বপূর্ণ। জেলার মধ্যে আইসিইউ ইউনিট থাকা স্বত্বেও হার্ট অ্যাটাকসহ গুরুতর সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে ছুটে আসা রোগীদের ঢাকার হাসপাতালে পাঠানো হয়। দুর্ভাগ্যবশত, কিছু রেফার্ড করা রোগী হাসপাতালের পথেই মারা যান। রোগীরা জরুরি প্রয়োজনে রাজধানীর সরকারি হাসপাতালে ছোটাছুটি করেন। কিংবা লাখ লাখ টাকা খরচ করে বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসা নেন।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, জেনারেল ভিক্টোরিয়া হাসপাতালের আইসিইউ বিভাগে রয়েছে অটোমেটেড মর্ডান আইসিইউ বেড ১০ টি, আইসিইউ পেশেন্ট মনিটর ১০ টি, ইসিজি মেশিন ২টি ও ১০টি মেকানিকাল ভেন্টিলেটরসহ আইসিইউ-এর ২১ টি নানান গুরুত্বপূর্ণ সরঞ্জাম। যা দিয়ে শুরু হয় হাসপাতালের আইসিইউ-এর কার্যক্রম। প্রায় একই সরঞ্জাম নিয়ে স্থাপন হয়েছিল ৩০০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালের আইসিইউ।
সম্প্রতি সরেজমিনে জেলার সরকারি দুটি হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, আইসিইউ-এর বেহাল দশা। ৩০০ শয্যা হাসপাতালের মূল ভবনের দ্বিতীয় তলায় স্থাপন করা হয়েছে আইসিইউ। দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখা যায় ৫ জন রোগী বেডে শুয়ে আছেন। সাথে তাদের স্বজনরা। তবে তারা কোন গুরুতর রোগী নন। কেউ শ্বাসকষ্ট , টিউমার কিংবা অন্যান্য রোগ নিরাময়ের জন্য ভর্তি হয়েছেন।
একটু ভেতরের দিকে এগুতেই দেখা যায় আবর্জনায় ঘেরা জায়গায় পড়ে আছে আইসিইউ-এর কোটি টাকার চিকিৎসা সরঞ্জাম। হাসপাতালের গ্যারেজে পড়ে আছে লাইফ সাপোর্ট সম্বলিত অ্যাম্বুলেন্স ।
জেনারেল ভিক্টোরিয়া হাসপাতালের চিত্র ভিন্ন। হাসপাতালের চার তলা জুড়ে আইসিইউ বিভাগ। রয়েছে চিকিৎসকদের নিজস্ব কক্ষ। সুসজ্জিত সরঞ্জামাদিসহ রয়েছে রোগীদের চিকিৎসা করার সব ধরনের ব্যবস্থাপনা। তবে এখানে এখন চিকিৎসা বন্ধ। আইসিইউ-এর পাশেই রয়েছে বিশ শয্যা বিশিষ্ট আইসোলেশন ইউনিট। সেখানেও রয়েছে বিশটি অটোমেটেড আধুনিক শয্যা। যেটি কোনদিন চালুই করা হয়নি।
ভিক্টোরিয়া জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসকরা মনে করেন হাসপাতালের আইসিইউ চালু থাকলে মুমূর্ষু রোগীদের চিকিৎসা সেবা দেওয়া সম্ভব।
জেনারেল ভিক্টোরিয়া হাসপাতালের আইসিইউ বিভাগের প্রধান ডা. আব্দুস সালাম বলেন, গত বছর আমরা এই আইসিইউতে ৩৯৯ জন রোগীকে চিকিৎসা সেবা দিয়েছি। গতবছর ডেঙ্গুর ভয়াবহ অবস্থায় আমাদের আইসিইউতে থাকা সকল ডেঙ্গু রোগীকে আমরা সুস্থ করতে পেরেছি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ৩০০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালের একজন কর্মকর্তা বলেন, হাসপাতালে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে আইসিইউ করা হয়েছে। কিন্তু চিকিৎসা দেওয়ার জন্য ডাক্তার নেই, পর্যাপ্ত নার্স নেই। তাহলে কেনো জনগণের এতো টাকা খরচ করে এসব ইউনিট তৈরি করা হয়? আইসিইউ বানিয়ে লাভ কি?
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জেনারেল ভিক্টোরিয়া হাসপাতালের দায়িত্বরত একজন চিকিৎসক বলেন, ভিক্টোরিয়া হাসপাতালে আইসিইউ নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার আগেই সকল যন্ত্রপাতি চলে এসেছে।
যন্ত্রপাতি ব্যবহার না হলেই নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আর এখন তো প্রকল্প বন্ধ। আমাদের হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ডেও ২০ টি শয্যা রয়েছে। এটা কোনদিন চালুই হয়নি। সম্পূর্ণ ব্যবস্থাপনা না করে এতো খরচ করা কেবল রাষ্ট্রীয় কোষাগারের অর্থ অপচয় ছাড়া কিছু নয়।
হাসপাতালে প্রয়োজনীয় জনবল না থাকায় একদিকে যেমন মুমূর্ষু রোগীরা উন্নত ও নিবিড় চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, অন্যদিকে কোটি কোটি টাকার যন্ত্রপাতি পড়ে পড়ে নষ্ট হচ্ছে। এ অবস্থায় সরকারের জরুরী হস্তক্ষেপ কামনা করেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
সিটি করপোরেশনের নিতাইগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা ফারহানা মুনা। ২০২১ সালে তার বাবাকে বুকে তীব্র ব্যাথা নিয়ে জেলার ইসলামী হার্ট সেন্টারে নিয়ে গেলে, সেখান থেকে দ্রুত লাইফ সাপোর্টে নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। সেসময় ঢাকার হাসপাতালে নেওয়ার পথেই তার মৃত্যু হয়।
ফারহানা মুনা হতাশা প্রকাশ করে বলেন, আমাদের জেলার সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ চালু করেও বন্ধ রাখা হয়েছে। দ্রুত লাইফ সাপোর্ট দেওয়ার ব্যবস্থা করতে পারলে হয়তো সেদিন আমার বাবা বেঁচে যেতেন। এতো এতো টাকা ব্যয় করেও আইসিইউ বন্ধ রাখার যুক্তিযুক্ততা নেই। মানুষকে বাধ্য হয়ে প্রাইভেট হাসপাতালের শরণাপন্ন হতে হয়। কারণ ঢাকার সরকারি হাসপাতালে একটি আইসিইউ শয্যা পাওয়া মানে হাতে সোনার হরিণ পাওয়া!
নারায়ণগঞ্জের সামাজিক সংগঠন 'আমরা নারায়ণগঞ্জবাসী'র সভাপতি হাজী নুরুউদ্দিন বলেন, সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে চিকিৎসা সেবা রাখার জন্য জেলার সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ শিগগিরই চালু করার দাবি জানাচ্ছি। সাধারণত আমাদের দেশের সরকারি হাসপাতালে যন্ত্রপাতি বক্সে রেখে নষ্ট করার প্রবণতা রয়েছে। হাসপাতালের ভিতরে রোগ নির্ণয় কার্যক্রম বন্ধ রেখে বাহিরের ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সাথে অনৈতিক আর্থিক ব্যবসা চলে।
তিনি বলেন, আইসিইউ সেবা বন্ধ করে কোটি কোটি টাকার যন্ত্রপাতি নষ্ট হচ্ছে আর জলে যাচ্ছে সরকারি টাকা। আইসিইউ চালু না রাখতে পারলে জনগণের ট্যাক্সের টাকা নষ্ট করার কোন অধিকার তাদের নেই।
জেলা সিভিল সার্জন মশিউর রহমান এ বিষয়ে বাসসকে বলেন, করোনা পরবর্তীকালে সরকারের কোভিড-১৯ ইআরপিপি প্রকল্পের আওতায় জেনারেল হাসপাতালে (ভিক্টোরিয়া) আইসিইউ ইউনিট খোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ২০২৩ সালের ৯ ডিসেম্বর এটার কার্যক্রম শুরু হয়। ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই প্রকল্পের মেয়াদ ছিল। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ায় প্রকল্পের ডাক্তারদের মেয়াদও শেষ হয়েছে। একারণেই আইসিইউ এর কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হলে আবার জেনারেল ভিক্টোরিয়া হাসপাতালে আইসিইউ চালু হবে।
জনবল সংকটের কারণে আইসিইউতে রোগীদের সেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না বলে স্বীকার করেছেন ৩০০ শয্যা হাসপাতালের চিকিৎসা তত্তাবধায়ক আবুল বাসার। তিনি বলেন, আমাদের আইসিইউ-এর সকল যন্ত্রপাতি আছে, সকল ব্যবস্থাপনা আছে। কিন্তু প্রয়োজনীয় চিকিৎসক নেই। এজন্য সব থাকা স্বত্তেও আইসিইউ সেবা দিতে পারছিনা। ৩০০ শয্যা হাসপাতালের আইসিইউ সেবা বন্ধ রয়েছে ।
আমরা বারবার লিখিতভাবে স্বাস্থ্য বিভাগে জানিয়েছি কিন্তু তাদের কাছ থেকে কোনো সাড়া পাইনি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) এ বি এম আবু হানিফ এ বিষয়ে বাসসকে বলেন, সরকারি হাসপাতালের আইসিইউ যদি জনবলের অভাবে বন্ধ হয়ে থাকে, তাহলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে এ বিষয়টি জানাতে হবে। তবে একাধিকবার চিঠি পাঠানোর বিষয়টি জানালে তিনি বলেন, হাসপাতাল দুটির জনবল সংকট সমাধান ও আইসিইউ চালুর বিষয়ে শিগগিরই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।