কাপ্তাই হ্রদে ফুল ভাসিয়ে পাহাড়ে বৈসাবি উৎসব শুরু

বাসস
প্রকাশ: ১২ এপ্রিল ২০২৫, ১৬:০৩
কাপ্তাই হ্রদে ফুল ভাসিয়ে পাহাড়ে বৈসাবি উৎসব । ছবি : বাসস

রাঙ্গামাটি, ১২ এপ্রিল, ২০২৫ (বাসস) : রাঙ্গমাটির কাপ্তাই হ্রদে ফুল ভাসানোর মধ্য দিয়ে আজ শুরু হয়েছে বৈসাবি উৎসব। এটি পাহাড়ে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর অন্যতম বৃহত্তম ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব।

এই বৈসাবী উৎসব ঘিরে পাহাড়জুড়ে বইছে আনন্দের বন্যা। বৈসাবি উপলক্ষে শনিবার সকালে রাজবনবিহার, গর্জনতলী ত্রিপুরা এলাকা, কেরানী পাহাড়সহ জেলা-উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকায় ফুল ভাসানোসহ চলছে বৈসাবির বর্ণাঢ্য আয়োজন।

ত্রিপুরা কল্যাণ ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে গর্জনতলী ত্রিপুরা এলাকায় বৈসাবি উৎসবে উপস্থিত ছিলেন রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কাজল তালুকদার, জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হাবিব উল্লাহ, জেলা পরিষদের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা খন্দকার মোহাম্মদ রিজাউল করিম, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোহাম্মদ রুহুল আমিন, জেলা পরিষদ সদস্য সাগরিকা রোয়াজা, ত্রিপুরা কল্যাণ ফাউন্ডেশনের সভাপতি বিদ্যুৎ ত্রিপুরা।  

বৈসাবি উপলক্ষে ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের উদ্যোগে কাপ্তাই হ্রদে ফুল ভাসানোসহ ত্রিপুরা ঐতিহ্যবাহী নানা কর্মসুচী ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। পরে বৈসাবী উপলক্ষে এলাকার বয়স্ক মুরুব্বী স্নান করানো হয়।

এদিকে বৈসাবী উপলক্ষে চাকমা সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে রাজবনবিহার এলাকা থেকে কাপ্তাই হ্রদে ফুল ভাসানোসহ নানা কর্মসূচি পালিত হয়। অনুষ্ঠানে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সহ-সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য ঊষাতন তালুকদারসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।

বৈসাবিকে চাকমা ভাষায় ‘বিঝু’, ত্রিপুরাদের ভাষায় ‘বৈসুক’, মারমাদের ভাষায় ‘সাংগ্রাই’, তংচঙ্গ্যাদের ভাষায় ‘বিজুু’ এবং অহমিয়াদের ভাষায় ‘বিহু’ নামে আখ্যায়িত করা হয়।

আজ উৎসবের প্রথম দিন কাপ্তাই হ্রদে ফুল ভাসানোর পর প্রত্যেকে বাসায় গিয়ে ফুল ও নিমপাতা দিয়ে ঘর সাজাবেন পাহাড়ের তরুণ-তরুণীরা।

পাহাড়ে-পাহাড়ে বৈসাবির আমেজ তিন দিনব্যাপি এই উৎসবের প্রথম দিনকে চাকমারা ‘ফুল বিজু বা ফুল বিঝু’ দ্বিতীয় দিনকে ‘মূল বিজু’ এবং তৃতীয় দিনকে ‘নুয়াবঝর বা গোজ্যা পোজ্যা’ দিন বলেন। আর ত্রিপুরারা প্রথম দিনকে হারিকুইসুক দ্বিতীয় দিনকে বুইসুকমা এবং তৃতীয় দিনকে বিসিকাতাল নামে পরিচিত।

উৎসবের প্রথমদিনকে চাকমারা বলে ‘ফুল বিজু বা ফুল বিঝু’। এই দিন বিঝুর ফুল তোলা হয় এবং ফুল দিয়ে ঘর সাজানো হয়। পরে সে ফুল দিন শেষে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। বিঝুর সময় ছোট ছেলে-মেয়েরা পরিচ্ছন্ন কাপড় পড়ে দল বেঁধে বাড়ি-বাড়ি বেড়াতে যায়। তারা সবাই বয়স্কদের সম্ভাষণ করেন এবং ঘরের হাঁস-মুরগিকে ধান, চাল ছিটিয়ে খেতে দেওয়া হয়।

এই সময় ঘরে ঘরে রান্না হয় সুস্বাধু ‘পাজোন’। এটি চাকমাদের বিখ্যাত খাবার। হরেক রকম সবজি দিয়ে রান্না করা হয়। এই উৎসবে সবার প্রিয় খাবার এটি। 

নববর্ষের দিন মজার-মজার সব খাবারের আয়োজন থাকে। এই দিন ভালো কিছু খেলে সারা বছরই ভালো খাবার সম্ভাবনা থাকে বলে বিশ্বাস করেন তারা।

বৈসুক: ত্রিপুরাদের ধর্মীয় এবং সামাজিক উৎসবের মধ্যে সবচে আকর্ষণীয় উৎসব বুইসুক বা বৈসুক। চৈত্রের শেষের দুইদিন ও নববর্ষের প্রথমদিন উদযাপন করা হয় এই উৎসব। চৈত্রের শেষ দুইদিনের প্রথমদিনকে ত্রিপুরারা ‘হারি বুইসুক’ এবং শেষ দিনকে ‘বুইসুকমা’ বলে থাকে। আর নববর্ষের প্রথমদিনকে তারা বলে ‘বিসিকাতাল’।

উৎসবের প্রথমদিন ত্রিপুরা ছেলে-মেয়েরা ফুল তোলে। ফুল দিয়ে ঘর সাজায়। কাপড় ধুয়ে পরিষ্কার করে। পরিচ্ছন্ন কাপড় পরে গ্রামে ঘুরে বেড়ায় ছেলে-মেয়েরা। তাদের বিচিত্র পিঠা আর বড়দের তাদের ঐতিহ্যবাহী পানীয় পান করানো হয়। বৈসুক শুরুর দিন থেকে ‘গরাইয়া নৃত্য দল গ্রামের প্রতি ঘরের উঠানে নৃত্য পরিবেশন করে।

পাহাড়ে পাহাড়ে বৈসাবির আমেজ প্রত্যেক ঘরের উঠোনে গরয়া নৃত্য শেষে শিল্পীদের মুরগির বাচ্চা, চাল প্রভৃতি দেওয়া হয়। এসব পেয়ে নৃত্যশিল্পীরা গৃহসত্ত’কে আশীর্বাদ করেন। নৃত্য শেষে শিল্পীরা উপঢৌকন হিসেবে পাওয়া সামগ্রী দিয়ে গরাইয়া দেবতার পুজা করে। এই লোকনৃত্যে ১৬ জন থেকে সর্বোচ্চ ৫০০ জন পযন্ত অংশ নিতে পারেন। এ নৃত্য দেখতে সারা দেশের শত-শত সংস্কৃতিকর্মী ও শিল্পী পার্বত্য চট্টগ্রামে ভিড় করে।

সাংগ্রাই: বৈসাবি উৎসবের ‘সা অক্ষরটি অন্যতম ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী মারমাদের ‘সাংগ্রাই’ উৎসব থেকে নেওয়া। মারমাদের অন্যতম সামাজিক উৎসব সাংগ্রাই। বছরের শেষ দুইদিন এবং নববর্ষের প্রথমদিন এ উৎসব উদযাপন করা হয়। সাংগ্রাই উৎসব উদযাপনের সময় মারমা যুবক-যুবতীরা পিঠা বানাতে চালের গুড়া তৈরি করেন। এই সময় ‘পানি খেলা বা জলকেলি’ হয়। সাংগ্রাই উৎসব এবং জলখেলা এখন যেন একে অপরের সমার্থক হয়ে গেছে। এই খেলায় যুবক-যুবতীরা একে অপরের দিকে পানি ছুঁড়েন। ভিজিয়ে দেন পরস্পরকে। এছাড়া, মারমারা বৌদ্ধ মন্দিরে গিয়ে ধর্মীয় বাণী শোনেন। চৈত্র সংক্রান্তি উপলক্ষে এই উৎসব হয়। সেজন্য সংক্রান্তি শব্দ থেকেই সাংগ্রাই শব্দটি এসেছে বলে ধারণা করা হয়।

আগামী ১৬-১৯ এপ্রিল রাঙ্গামাটিতে মারমাদের জলকেলি উৎসবের মধ্য দিয়ে পাহাড়ে সমাপ্ত হবে রঙিন বৈসাবি উৎসব।

বৈসাবিকে ঘিরে চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরাসহ অন্যান্য জনগোষ্ঠীরা মেতে উঠেছে আনন্দ উৎসবে। ১২ এপ্রিল থেকে ৩ দিনব্যাপী বৈসাবির আনুষ্ঠানিকতা শুরু হলেও পুরো এপ্রিল মাস জুড়েই চলে বৈসাবির বর্ণাঢ্য আয়োজন। বৈসাবিতে পাহাড়ী-বাঙালী সব সম্প্রদায়ের উপস্থিতিতে এই আয়োজন সম্প্রীতির মিলন মেলায় পরিনত হয়।

 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
সূর্যবংশীর রেকর্ড গড়া ম্যাচে হারল রাজস্থান
বিগত তিন নির্বাচনে অনিয়মে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি এনসিপি’র
ভোলায় তোফায়েলের ছেলে বিপ্লব ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
বিএমইউতে কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্ট সার্জারি ট্রেনিং প্রোগ্রাম অনুষ্ঠিত
জলবায়ু সংকট উপকারী প্রজাতির প্রাণীর বিলুপ্তি ত্বরান্বিত করছে
গণহত্যা মামলায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন যেকোনো দিন : চিফ প্রসিকিউটর
চট্টগ্রামে জাহাজ থেকে কর্ণফুলী নদীতে পড়ে নাবিক নিখোঁজ
ওবায়দুল কাদেরসহ ৪৫ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন ২০ জুলাই
বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটিতে ৫ দিনব্যাপী ভর্তি মেলা শুরু
ঝালকাঠিতে ১০ শহীদের পরিবারকে অর্থ সহায়তা প্রদান
১০