কাশেম মাহমুদ
ঢাকা, ১৭ জুলাই, ২০২৫ (বাসস) : জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ১১ মাস অতিবাহিত হয়ে গেলেও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তাদের দায়ের করা মামলাগুলো পরিচালনার জন্য সারাদেশের জেলা বার ও উচ্চ আদালতে দুদকের ১৩৫ আওয়ামী দোসর আইনজীবীদের সরিয়ে নতুন নিয়োগ দিতে পারেনি।
দুদক সূত্র জানিয়েছে, ফেব্রুয়ারি মাসে দুদক প্যানেল আইনজীবী নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি এখনো সেই নিয়োগের কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। বরং হচ্ছে, হয়ে যাবে বলে কাল ক্ষেপন করা হচ্ছে। ফলে বিচার প্রক্রিয়ায় গতি হারাচ্ছে দুদকের মামলাগুলোর। মামলার বাদী দুদক কর্মকর্তারা কমিশন এবং ঊর্ধ্বতনদের কাছে আওয়ামী শাসনামলে স্বৈরাচারের মদদপুষ্ট এবং তৎকালীন আইনমন্ত্রীর অনুগ্রহ প্রিয় নিয়োগ পাওয়া প্যানেল আইনজীবীদের বিরুদ্ধে মামলার শুনানিতে গাফলতি, আদালতে অনুপস্থিতিসহ নানা অভিযোগ উত্থাপন করে কোনো প্রতিকার পাচ্ছে না।
দুদকের লিগ্যাল শাখা জানিয়েছে, দুদকের মামলা পরিচালনার জন্য অভিজ্ঞ আইনজীবীদের কাছ থেকে তালিকাভুক্তির আবেদন আহ্বান করা হয়েছে। কিন্তু আশানুরূপ সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। যারা আবেদন করেছে তাদের আবেদনগুলো লিগ্যাল শাখায় যাচাই বাছাই করা হচ্ছে।
অপরদিকে দুদকের প্যানেল ল’ইয়ার হতে ইচ্ছুক কয়েকজন আইনজীবীর সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, দুদক যেসব যোগ্যতায় আইনজীবীর আবেদন আহ্বান করেছে তা পূরণ করা কঠিন এবং আর্থিক ব্যয় সাপেক্ষ। আইনজীবীদের মামলা পরিচালনার অভিজ্ঞতা, আইনজীবীর করা মামলার রায় হওয়া সার্টিফাইড কপি দিয়ে আবেদন করতে হবে। তা ছাড়া বিজ্ঞপ্তির শর্ত নিয়েও অনেকের আপত্তি রয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পক্ষে মামলা পরিচালনায় সুপ্রিম কোর্ট ও সারা দেশে জেলাভিত্তিক সম্পূর্ণ অস্থায়ীভাবে কেস টু কেস ভিত্তিতে প্যানেল আইনজীবী/পিপি নিয়োগ দেওয়ার কথা বলা হলেও শর্ত নিয়ে আইনজীবীদের মধ্যে সমালোচনামূলক আলোচনা রয়েছে।
কমিশনের ওয়েবসাইটে গত ১১ ফেব্রুয়ারি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে ১৫ দিনের মধ্যে কমিশনের সচিব বরাবর আবেদন করতে বলা হয়েছিল। কিন্তু বিজ্ঞপ্তির সাড়ে ৪ মাস অতিক্রান্ত হলেও এখনো দুদক আইনজীবী নিয়োগ দিতে পারেনি।
জেলা পিপি নিয়োগের যোগ্যতায় বলা হয়েছে , বার কাউন্সিলের তালিকাভুক্ত আইনজীবী হিসেবে জেলা ও দায়রা জজ আদালতসমূহে ন্যূনতম ১০ বছর সক্রিয়ভাবে মামলা পরিচালনার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। আইনজীবী হিসেবে পরিচালিত দায়রা জজ ও বিশেষ জজ আদালতে ন্যূনতম ১০টি মামলা বা আপিল নিষ্পত্তির অভিজ্ঞতা (এন আই অ্যাক্ট ও দণ্ডবিধির ৩৮৫/৩৮৭ ধারার মামলা বাদে) থাকতে হবে। তন্মধ্যে ন্যূনতম একটি হত্যা বা দুর্নীতি মামলা, দায়রা আদালতে একটি আপিল দায়েরকৃত থাকা আবশ্যক।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীদের যোগ্যতায় বলা হয়েছে, হাইকোর্ট বিভাগে ন্যূনতম ১০ বছর সক্রিয়ভাবে মামলা পরিচালনার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। আইনজীবী হিসেবে পরিচালিত হাইকোর্ট বিভাগ বা আপিল বিভাগে ন্যূনতম ১০টি মামলা নিষ্পত্তির অভিজ্ঞতা (জামিন বাদে) থাকতে হবে। তন্মধ্যে ন্যূনতম একটি আপিল ও একটি ফৌজদারি রিভিশন দায়েরকৃত থাকা আবশ্যক।
অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ, অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজদের ক্ষেত্রে আইনজীবী হিসেবে মামলা পরিচালনার অভিজ্ঞতার শর্ত শিথিলযোগ্য। তবে দায়রা জজ হিসেবে ন্যূনতম ১০টি মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রদানের অভিজ্ঞতা থাকা আবশ্যক। মামলা পরিচালনার জন্য কমিশন কর্তৃক নির্ধারিত হারে পারিশ্রমিক প্রদান করা হবে।
কোনো রাজনৈতিক দলের পদে থাকলে, কোনো ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত বা সাজাপ্রাপ্ত হলে, নৈতিক স্খলনের দায়ে চাকরিচ্যুত হলে, কোনো উগ্র মতাদর্শে বিশ্বাসী হলে, ঋণ খেলাপি/বিল খেলাপি হলে তারা প্যানেল আইনজীবী হিসেবে অযোগ্য বিবেচিত হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দুর্নীতির বিরুদ্ধে দুদকের তদন্ত-অনুসন্ধানে সাফল্য থাকলেও মামলা ট্রায়ালের ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ছে। মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ আমলে নিয়োগ পাওয়া আইনজীবীদের বিরুদ্ধে শৈথিল্য মনোভাবের অভিযোগ উঠেছে দুদক কর্মকর্তাদের অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে।
দুদকের মামলা পরিচালনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বাদী ও তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত উপ-পরিচালক এবং সহকারী পরিচালক পদের কর্মকর্তারা ঊর্ধ্বতনদের কাছে এসব আইনজীবীদের বিরুদ্ধে অসহযোগিতার মৌখিক নালিশ করেছেন।
দুদকের মামলা পরিচালনার জন্য পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নিয়োগ পাওয়া আইনজীবীদের সরকার পরিবর্তনের ১১ মাসেও পরিবর্তন করা হয়নি। ফলে গত ১১ মাসে আওয়ামী লীগ ও তাদের দোসরদের বিরুদ্ধে শতাধিক মামলা রুজু, গ্রেফতার, হাজার হাজার কোটি টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ক্রোক, অবরুদ্ধ আদেশ পাওয়ার পরও আওয়ামী সরকার নিয়োগকৃত এ সব দুদক আইনজীবীদের অসহযোগিতামূলক আচরণের কারণে বিচার প্রক্রিয়া শেষ করার গতি পাচ্ছে না।
দুদক উপ-পরিচালক (জনসংযোগ) আকতারুল ইসলাম বাসসকে জানান, দুদকের প্যানেল আইনজীবী নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রচার হলেও এখনো প্যানেল আইনজীবী নিয়োগ হয়নি। তিনি বলেন, আইনজীবী প্যানেল নিয়োগ লিগ্যাল সাইট যিনি দেখাশোনা করছিলেন তিনি অন্যত্র বদলি হয়েছেন। নতুন করে এখনো কেউ যোগদান করেননি। আশা করছি দ্রুত এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত আসবে।
দুদক প্রধান কার্যালয়ের একজন পরিচালক ও তিনজন উপ-পরিচালক পর্যায়ের কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপকালে তারা জানান, উচ্চ আদালতসহ সারাদেশের আদালতগুলোতে দুদকের মামলা পরিচালনার জন্য নিয়োগকৃত ১৩৫ জন আইনজীবীর মধ্যে ৫ আগস্টের পর ৩/৪ জন আইনজীবী নিজ থেকে পদত্যাগ করেছেন। প্রধান প্যানেল ল’ইয়ার খোরশেদ আলম খান দীর্ঘদিন আদালতে আসছেন না। মোশাররফ হোসেন কাজলসহ অধিকাংশ আইনজীবী আদালতে অনুপস্থিত কিংবা অনিয়মিত থাকায় মামলা সংক্রান্ত কাজে তাদেরকে পাওয়া যাচ্ছে না। আওয়ামী আইনজীবী ফোরাম কিংবা দলের সঙ্গে সরাসরি জড়িত কেউ কেউ ৫ আগস্টের পর গা ঢাকা দিয়েছেন।
দুদক জানিয়েছে, উচ্চ আদালতে মামলা পরিচালনার জন্য প্রধান আইনজীবী হিসেবে আছেন খোরশেদ আলম খান। তার সঙ্গে ছিলেন আরও ১৫ আইনজীবী। খোরশেদ আলম খান দুদকের আইনজীবী হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার আগে এই পদে ছিলেন সাবেক আইনমন্ত্রী (বর্তমানে হত্যা মামলাসহ দুর্নীতি ও জ্ঞাত বহির্ভূত মামলায় কারান্তরীণ) আনিসুল হক। যিনি বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে দুদকের ফরমায়েশি মামলা দিয়ে হয়রানি করিয়েছেন। তারই বিশ্বস্ত মোশাররফ হোসেন কাজল ঢাকার বিশেষ জজ কোর্টে মামলা পরিচালনার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আওয়ামী লীগের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করেছেন।
অপরদিকে খোরশেদ আলম খান হাইকোর্টে বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে নিম্ন আদালতের রায়ের সাজার মেয়াদ বাড়ানোর জন্য আবেদনসহ নানা আপত্তিকর মন্তব্য করেছিলেন। এই মামলায় বেগম খালেদা জিয়া সাজা খাটলেও শেষ পর্যন্ত ২০২৫ সালের ১৫ জানুয়ারি বেগম খালেদা জিয়াসহ অন্যান্যরা খালাস পেয়েছেন।
দুদক কর্মকর্তাদের মতে, স্বৈরাচারের পতনের পর গত ১১ মাসে দুদক মামলার তদন্ত, অনুসন্ধানে সর্বোচ্চ সাফল্য দেখিয়েছে। কিন্তু আওয়ামী মনোভাবাপন্ন দুদক আইনজীবীদের কারণে মামলার বিচারকাজ ত্বরান্বিতে গতি পাচ্ছে না। তারা বিভিন্ন অজুহাতে আদালতে অনুপস্থিত ও সময় ক্ষেপন করছে। প্যানেল আইনজীবী নিয়োগের বিজ্ঞপ্তির পর তারা বিভিন্ন ছলচাতুরীপনায় আদালতে দাড়াচ্ছেন না।
দুদক জানিয়েছে, ঢাকায় ১৩ টি আদালতে এবং ঢাকার বাইরে প্রতিটি জেলায় দুদকের মামলা রুজু ও পরিচালনার জন্য আদালত রয়েছে। ঢাকায় বিশেষ জজ আদালত-১ থেকে বিশেষ জজ আদালত-১০ পর্যন্ত মোট ১০টি, মহানগর দায়রা জজ আদালত, বিভাগীয় স্পেশাল জজ আদালত এবং জেলা ও দায়রা জজ আদালত। ঢাকার বাইরে প্রতিটি জেলায় জেলা ও দায়রা জজ আদালত পদাধিকার বলে সিনিয়র স্পেশাল জজ হিসেবে দুদকের মামলা পরিচালনা করে থাকে।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দলের প্রতি অনুগত ও আওয়ামী লীগ নেতাদের আস্থাভাজন আইনজীবীরা সে সময় দেশের উচ্চ আদালতসহ বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ে আদালত সমূহে দুদকের মামলা পরিচালনার জন্য নিয়োগ পেয়েছিল। বিগত ৫ আগস্ট পতিত স্বৈরাচার আওয়ামী লীগের পতনের পর দুদক দুর্নীতি দমনে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে। কমিশন কোনোরূপ হস্তক্ষেপ ছাড়াই মামলার তদন্ত, অনুসন্ধান, চার্জশিট দাখিল, আসামি গ্রেফতার এবং মামলার বিচার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার পদক্ষেপ নিলেও আদালতে দুদক আইনজীবীদের অনুপস্থিতি, অনাগ্রহ, ঢিমেতালে মনোভাবের কারণে মামলার গতি পাচ্ছে না। দুদক তাদের কাছ কোনো কার্যকর পরামর্শও পাচ্ছে না। ফলে গত ১১ মাসে পলাতক আওয়ামী লীগ ও তাদের দোসরদের শত শত কোটি টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির সন্ধান, অনুসন্ধান, ক্রোক, গ্রেফতারকৃত আসামিদের বিচার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার বিষয়ে আদালতে আওয়ামী লীগের প্রতি অনুগত এসব আইনজীবীদের ঢিমে তালে ভাব মামলার গতি বাধাগ্রস্ত করছে।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সেক্রেটারি ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস বাসসকে বলেন, দুদক জুলাই গণঅভ্যুত্থানের স্পিরিট বুঝতে সক্ষম না হলে তা হবে জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক। জুলাই আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে যারা শহীদ হয়েছেন তারা এদেশে আওয়ামী লীগের লুটতরাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে বুলেটের সামনে বুক পেতে দিয়েছে। কমিশন ১১ মাসেও আওয়ামী লীগের অনুগত আইনজীবী পরিবর্তন করতে না পারা দুঃখজনক। পতিত স্বৈরাচার ও তাদের দোসরদের আইনের আওতায় আনতে না পারলে দুদক প্রতিষ্ঠান হিসেবে তার মর্যাদা হারাবে।
জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এডভোকেট গাজী কামরুল হাসান সজল বাসসকে বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রায় একবছর শেষ হতে যাচ্ছে। আমরা আবু সাঈদ, মুগ্ধ, ওয়াসিমসহ হাজার হাজার শহীদের রক্তের সঙ্গে বেঈমানি করতে পারি না। যদি আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের রাষ্ট্রীয় কোষাগার লুটপাট, দুর্নীতির বিচার আগামি ৫ আগস্টের আগে অনন্ত দুয়েকটি মামলার বিচারও যদি করতে না পারি তাহলে জাতির কাছে লজ্জিত ও দায় থাকতে হবে।