ঢাকা, ১৯ জুলাই, ২০২৫ (বাসস) : বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, ‘রাজনৈতিক শিষ্টাচার রক্ষা করে জাতীয় ঐক্যের বীজতলাটা আমরা সবাই মিলে একসাথে করব। সবাইকে নিয়ে আমরা দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ব।’
তিনি বলেন, ‘আগামীর বাংলাদেশটা কেমন হবে? আমি বলি আরেকটা লড়াই হবে। একটা লড়াই হয়েছে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে। আরেকটা লড়াই হবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে। এই দুর্নীতির মূলোৎপাটন করার জন্য যা দরকার, আমরা তারুণ্য এবং যৌবনের শক্তিকে একত্রিত করে সেই লড়াইয়েও যুক্ত হবো এবং বিজয়ী হবো ইনশাআল্লাহ।’
আজ শনিবার বিকেলে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে ৭ দফা দাবিতে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর উদ্যোগে আয়োজিত এক বিশাল জাতীয় সমাবেশে সভাপতির বক্তব্যে জামায়াত আমির এ কথা বলেন।
এদিকে সমাপনী বক্তব্য দেওয়ার সময় জামায়াত আমির ডা. শফিকুর রহমান হঠাৎ অসুস্থ হয়ে মঞ্চে পড়ে যান। এ সময় উপস্থিত নেতারা তাকে ধরাধরি করে বসান। পরে আবার দাঁড়িয়ে বক্তব্য শুরুর কিছুক্ষণ পর আবারও পড়ে যান তিনি। এ সময় মঞ্চে উপস্থিত নেতৃবৃন্দ তাকে উঠিয়ে বসান এবং মঞ্চে বসেই তিনি সমবেত লাখো জনতার উদ্দেশ্যে বক্তব্য দেন।
গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার ব্যাপক গণ-আন্দোলনের মুখে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর মুক্ত পরিবেশে এই প্রথম জামায়াতে ইসলামী রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিশাল এই জনসমাবেশের আয়োজন করে।
বক্তব্যের পর জামায়াত আমির শফিকুর রহমানকে ধানমন্ডি ইবনে সিনা হাসপাতালে নেওয়া হয়। জামায়াতের একজন দায়িত্বশীল নেতা বাসসকে জানান, তিনি (আমির) এখন সুস্থ রয়েছেন। তার ব্লাড প্রেশার স্বাভাবিক রয়েছে।
জামায়াত আমির সমাবেশে বলেন, যাদের ত্যাগ ও কোরবানির বিনিময়ে স্বৈরাচার বিদায় নিয়েছে, আমরা তাদের সকলের কাছে গভীরভাবে ঋণী। জামায়াতে ইসলামীর অস্তিত্ব যতদিন থাকবে. আল্লাহ যেন তাদের ঋণ পরিশোধ করার শক্তিটাও ততদিন আমাদেরকে দান করেন।
জামায়াত আমির বলেন, ‘এতগুলো মানুষ এমনি এমনি জীবন দেন নাই। জীবন দিয়েছে জাতির মুক্তির জন্য। যদি পুরোনো সবকিছুই টিকে থাকবে তাহলে কেন তারা জীবন দিয়েছিল? যারা ওই পচা ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশকে আবার ফিরিয়ে নিতে নিতে চান, তাদেরকে আমরা বলি, জুলাই যুদ্ধ করে যারা জীবন দিয়েছেন আগে তাদের জীবনটা ফেরত এনে দেন। যদি শক্তি থাকে ফেরত এনে দেন। আপনারা পারবেন না। যেহেতু পারবেন না। কাজেই নতুন ব্যবস্থায় নতুন বাংলাদেশ গড়ে তোলা হবে ইনশাআল্লাহ।’
তিনি বলেন, শহীদ আবু সাঈদরা যদি বুক পেতে না দাঁড়াতো, এ জাতির মুক্তির জন্য যদি বুকে গুলি লুফে না নিত; হয়তোবা আজকের এই বাংলাদেশটা আমরা দেখতাম না। ইতিমধ্যে হয়ত আরও অনেক মানুষের জীবন ফ্যাসিবাদীদের হাতে চলে যেত। চব্বিশে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধটা যদি না হতো তাহলে আজকে যারা বিভিন্ন ধরনের কথা এবং দাবি-দাওয়া পেশ করছেন তারা তখন কোথায় থাকতেন?
জামায়াত আমির বলেন, ‘যাদের ত্যাগের বিনিময়ে আল্লাহ তায়ালার এই নেয়ামত পাওয়া, তাদেরকে যেন অবজ্ঞা-অবহেলা না করি। অন্য দলকে যেন তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য না করি। অরাজনৈতিক ভাষায় আমরা যেন কথা না বলি। যদি এগুলো আমরা পরিহার করতে না পারি তাহলে বুঝতে হবে ফ্যাসিবাদের রোগ আমাদের মধ্যে নতুন করে বাসা বেঁধেছে। রাজনৈতিক শিষ্ঠাচার রক্ষা করে জাতীয় ঐক্যের বীজতলাটা আমরা সবাই মিলে একসাথে তৈরি করবো ইনশাআল্লাহ।’
জামায়াত আমির দ্বিতীয়বার অসুস্থ হয়ে পড়ার পর আবার উঠে দাঁড়িয়ে বক্তব্যে বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালার শুকরিয়া আদায় করছি। আবার আপনাদের সামনে দাঁড়াতে পেরেছি। আমি বলেছিলাম, দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ সবাইকে নিয়ে আমরা গড়বো। আল্লাহ যত সময় হায়াত দিয়েছেন, তত সময় মানুষের জন্য লড়াই করবো ইনশাল্লাহ। লড়াই বন্ধ হবে না, বাংলার মানুষের মুক্তি লাভ না করা পর্যন্ত আমাদের লড়াই অব্যাহত থাকবে।’
তিনি বলেন, ‘জামায়াত যদি আল্লাহর ইচ্ছা এবং জনগণের ভালোবাসায় ভবিষ্যতে দেশের মানুষের সেবা করার সুযোগ পায়, তবে মালিক হবে না, সেবক হবে, ইনশাআল্লাহ।’ তিনি আরও বলেন, ‘আজ আমি ঘোষণা দিচ্ছি, জামায়াত থেকে যারা আগামী দিনে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হবেন, যদি আল্লাহর ইচ্ছায় ও জনগণের ভালোবাসায় জামায়াত থেকে সংসদ সদস্যরা নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করেন, তাহলে কোনো এমপি-মন্ত্রী আগামী দিনে সরকারি কোনো প্লট গ্রহণ করবেন না। কোনো এমপি ও কোনো মন্ত্রী ট্যাক্স বিহীন কোনো গাড়ি নেবেন না। কোনো এমপি ও কোনো মন্ত্রী যদি তার নির্দিষ্ট কোনো কাজের জন্য বরাদ্দ পেয়ে থাকেন, কাজ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের কাছে তারা তার প্রতিবেদন তুলে ধরতে বাধ্য থাকবেন। চাঁদা আমরা নেব না, দুর্নীতি আমরা করব না। চাঁদা আমরা নিতে দেব না, দুর্নীতি সহ্য করব না। এই বাংলাদেশটাই আমরা দেখতে চাই। যুবকদের স্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই, তোমাদের সঙ্গে আমরা আছি।’
ডা. শফিক বলেন, ‘আমি এখানে জামায়াতের আমির হিসেবে নয়, ১৮ কোটি মানুষের একজন প্রতিনিধি হিসেবে এসেছি। শিশুদের বন্ধু, যুবকদের ভাই, প্রবীণদের সহযোদ্ধা হয়ে এসেছি, এই জাতির মুক্তির প্রত্যয়ে। আমি বলতে চাই, বাংলাদেশের কোনো নির্দিষ্ট শ্রেণির মুক্তির জন্য আমাদের লড়াই নয়। রাস্তার একজন পরিচ্ছন্নতা কর্মী, চা বাগানের একজন শ্রমিক, রক্ত পানি করা ঘাম ঝরানো রিকশা চালক ভাই, মাঠে ময়দানে বাংলাদেশের মানুষের মুখে যারা এক মুঠো ভাত তুলে দিতে চায় আমার সেই কৃষক বন্ধুটির জন্য তাদের হয়ে আজকে কথা বলতে এসেছি। আমি কোনো অভিজাত শ্রেণির হয়ে কথা বলতে আসিনি।’
তরুণ প্রজন্মের উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, ‘তোমরা শুধু দর্শক হয়ে থাকবে না, এই দেশ গঠনের কাজে অংশগ্রহণ করবে। এটা শুধু কোনো শ্রেণির যুদ্ধ নয়, এটা চাষি, মজুর, ছাত্র, যুবক সব শ্রেণির মানুষের যুদ্ধ। এই লড়াই শুধু জামায়াতের নয়, এই লড়াই সবার। নতুন বাংলাদেশ গড়তে চাইলে, দায়িত্বশীল রাজনৈতিক সংস্কৃতি চাইলে আসুন আমরা সবাই মিলে এগিয়ে যাই।’
সমাবেশে জামায়াতে ইসলামীর নির্বাহী পরিষদ সদস্য এ টি এম আজহারুল ইসলাম, নায়েবে আমির সাবেক এমপি অধ্যাপক মুজিবুর রহমান, হেফাজতে ইসলামের নায়েবে আমির মাওলানা মুহিউদ্দিন রাব্বানী, জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের, সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসচিব মাওলানা ইউনুস আহমদ, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্য সচিব আখতার হোসেন, খেলাফত মজলিসের মহাসচিব ড. আহমদ আব্দুল কাদের, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নূর, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের নায়েবে আমির মাওলানা ইউসুফ আশরাফ, ইসলামী আন্দোলনের প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন, ইসলামী ছাত্রশিবিরের সভাপতি জাহিদুল ইসলাম, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সার্জিস আলম, জামায়াতে ইসলামীর সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান ও ড. হামিদুর রহমান আযাদ, নেজামে ইসলাম পার্টির মহাসচিব মাওলানা মুসা বিন ইজহার, জামায়াতে ইসলামীর নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের আমির মো: নুরুল ইসলাম বুলবুল, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী উত্তরের আমির মোহাম্মদ সেলিম উদ্দিন, জামায়াতের সাবেক আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর পুত্র ব্যারিস্টার নাজিবুর রহমান মোমেন, জাতীয় হিন্দু মহাজোটের মহাসচিব গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক, বাংলাদেশ ল’ইয়ার্স কাউন্সিলের সভাপতি অ্যাডভোকেট জসিম উদ্দিন সরকার, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টির সভাপতি আনোয়ারুল ইসলাম, খেলাফত আন্দোলনের নায়েবে আমির মাওলানা মুজিবুর রহমান হামিদী, আরেক অংশের আমির মাওলানা আবু জাফর কাসেমী, জাগপার মুখপাত্র রাশেদ প্রধান, ছাত্রশিবিরের সেক্রেটারি জেনারেল নুরুল ইসলাম সাদ্দাম, শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আতিকুর রহমান, বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব ড. ফয়জুল হক, যুক্তরাজ্য প্রবাসী মাওলানা মওদুদ হাসান, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ছাত্র সমন্বয়ক সাদিক কায়েম, জুলাই আন্দোলনে শহীদ আবু সাঈদের বড় ভাই রমজান আলী, শহীদ ইমাম হাসান তামিমের ভাই রবিউল আউয়াল তামিম, শহীদ শাহরিয়ারের বাবা আবুল হাসান, চট্টগ্রামে শহীদ ফয়সাল আহমেদ শান্তর পিতা জাকির হোসাইন, বুয়েটে ছাত্রলীগের হাতে শহীদ আবরার ফাহাদের পিতা বরকতউল্লাহ, জুলাই আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির ছাত্র এস এম মোস্তাফিজুর রহমান, রেদওয়ান নাবিল প্রমুখ বক্তব্য দেন।
দলের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল, প্রচার ও মিডিয়া বিভাগের প্রধান এহসানুল মাহবুব জুবায়ের, প্রচার ও মিডিয়া বিভাগের সেক্রেটারি মতিউর রহমান আকন্দ, কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের সেক্রেটারি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ এবং কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী উত্তরের সেক্রেটারি ড. রেজাউল করিম অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করেন।
এর আগে দুপুর ২টায় জামায়াতে ইসলামীর উদ্যোগে পবিত্র কুরআন তেলওয়াতের মাধ্যমে সমাবেশের কার্যক্রম শুরু হয়। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে সমাবেশে সাত দফা দাবি জানানো হয়েছে। এগুলো হচ্ছে- লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিতকরণ, জুলাইসহ সকল গণ-হত্যার বিচার, প্রয়োজনীয় মৌলিক সংস্কার, জুলাই সনদ ও ঘোষণাপত্র বাস্তবায়ন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ ও আহতদের পরিবারের পুনর্বাসন, পিআর পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচন এবং এক কোটির বেশি প্রবাসীর ভোটদানের ব্যবস্থা।
জামায়াতের জাতীয় সমাবেশে রাজধানীতে মানুষের ঢল নামে। সমাবেশ শুরুর অনেক আগেই দলটির নেতাকর্মী ও সমর্থকদের উপস্থিতিতে প্রায় কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে যায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও আশপাশের এলাকা। বাস, লঞ্চ ও ট্রেন বোঝাই করে নেতাকর্মীরা সমাবেশস্থলে আসেন। সমাবেশের পরিধি রমনা পার্ক, শাহবাগ মোড়,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি, দোয়েল চত্বর, হাইকোর্ট মোড়, জাতীয় প্রেস ক্লাব, মৎস্য ভবন মোড়সহ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে।