কুয়ালালামপুর, ১২ আগস্ট, ২০২৫ (বাসস): মালয়েশিয়া সফরের দ্বিতীয় দিনে আজ মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস সেদেশের প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের সঙ্গে পুত্রজায়ার পার্দানা পুত্রা ভবনে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেছেন।
এ সময় উভয়ে দুদেশের সম্পর্ককে আরও গভীর এবং কৌশলগত ভবিষ্যতমুখী অংশীদারিত্বে রূপান্তরের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন।
প্রথমে দুই নেতা একান্ত বৈঠক করেন। এরআগে সীমিত সংখ্যক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে একটি উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। পরে তারা বাণিজ্য, বিনিয়োগ, জনশক্তি ও জ্বালানি সহযোগিতা, নীল অর্থনীতি, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক বিনিময়সহ বিস্তৃত পরিসরের দ্বিপাক্ষিক বিষয় নিয়ে প্রতিনিধি পর্যায়ের বৈঠকে আলোচনা করেন।
প্রতিনিধি পর্যায়ের আলোচনার শুরুতে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমাদের দুই দেশের মধ্যে ইতিহাস, ধর্ম ও সাংস্কৃতিক সহানুভূতির ভিত্তিতে গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান। মানবসম্পদ, বাণিজ্য ও জনগণের পারস্পরিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে মালয়েশিয়া বাংলাদেশের অনন্য অংশীদার।’
প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম অধ্যাপক ইউনূসকে ‘মালয়েশিয়ার বন্ধু’ হিসেবে বর্ণনা এবং গত এক বছরে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য তাঁর প্রশংসা করেন। তিনি বাণিজ্য সম্প্রসারণ এবং প্রবাসী শ্রমিকদের কল্যাণ, শিক্ষা এবং রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে সহযোগিতা বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন।
একান্ত বৈঠকে অধ্যাপক ইউনূস প্রটোকল জটিলতার আওতায় আটকে পড়া ৮ হাজার বাংলাদেশি শ্রমিককে মালয়েশিয়ায় প্রবেশের সুযোগ প্রদান এবং মাল্টিপল এন্ট্রি ভিসা চালুর জন্য মালয়েশিয়াকে ধন্যবাদ জানান। এর ফলে শ্রমিকরা জরুরি প্রয়োজনে দেশে ফিরে গিয়েও চাকরি হারানোর ঝুঁকি এড়াতে পারবেন বলে তিনি উল্লেখ করেন।
দুই পক্ষই নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতা নিশ্চিত করার ওপর জোর দেন, যাতে খরচ কমে এবং শ্রমিকদের কল্যাণ সুরক্ষিত হয়।
প্রতিনিধি পর্যায়ের আলোচনায় আইন, বিচার ও প্রবাসী কল্যাণ উপদেষ্টা আসিফ নজরুল মালয়েশিয়াকে সরকার-টু-সরকার কাঠামোর মাধ্যমে আরও বেশিসংখ্যক দক্ষ বাংলাদেশি পেশাজীবী, যেমন চিকিৎসক ও প্রকৌশলী নিয়োগের আহ্বান জানান। তিনি উল্লেখ করেন যে বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বোয়েসেল বর্তমানে মালয়েশিয়ার কোম্পানিগুলোর জন্য শ্রমিক নিয়োগ পরিচালনার সক্ষমতা অর্জন করেছে। এছাড়া তিনি বাংলাদেশি নিরাপত্তারক্ষী ও সেবাকর্মীদের জন্য সুযোগ দেওয়া এবং মালয়েশিয়ায় অনিয়মিত বা অনিবন্ধিত বাংলাদেশি শ্রমিকদের নিয়মিতকরণের পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানান।
মালয়েশিয়ার কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেন, বাংলাদেশি শ্রমিকরা এখন মালয়েশিয়ার শ্রমিকদের সমান সামাজিক সুরক্ষা সুবিধা পাবেন এবং বাংলা ভাষায় অভিযোগ দায়ের করতে পারবেন।
বাংলাদেশ হাজারো শিক্ষার্থীর জন্য ‘গ্র্যাজুয়েট পাস’ ভিসা চালুর অনুরোধ জানায়, যারা বর্তমানে মালয়েশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে। বর্তমানে প্রায় ১০ হাজার বাংলাদেশি শিক্ষার্থী মালয়েশিয়ায় অধ্যয়নরত।
উভয় নেতা বাংলাদেশকে আসিয়ানের সঙ্গে সম্পৃক্ততা গভীর করার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে আলোচনা করেন, যার মধ্যে রয়েছে সেক্টরাল ডায়ালগ পার্টনার মর্যাদা পাওয়ার প্রচেষ্টা। এ বিষয়ে ড. ইউনূস আসিয়ানের চেয়ার হিসেবে মালয়েশিয়ার সমর্থন কামনা করেন।
অধ্যাপক ইউনূস মালয়েশিয়াকে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে সেপ্টেম্বর মাসে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক রোহিঙ্গা সম্মেলনে অংশ নেওয়ার আমন্ত্রণ জানান। তিনি রোহিঙ্গা জনগণের প্রতি মালয়েশিয়ার একের পর এক সমর্থনের জন্য ধন্যবাদ জানান।
অর্থনৈতিক বিষয়ে, দুই পক্ষ বাংলাদেশ-মালয়েশিয়া মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির আলোচনাকে ত্বরান্বিত করা, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের মাধ্যমে বিনিয়োগ সহযোগিতা জোরদার করা এবং মালয়েশিয়া বাংলাদেশ যৌথ ব্যবসা পরিষদ সক্রিয় করার বিষয়ে একমত হন।
দুই বন্ধুত্বপূর্ণ দেশের মধ্যে ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য ঘাটতির কথা উল্লেখ করে ঢাকা বাংলাদেশের ওষুধ, ব্যাটারি, জুতা, সিরামিক ও পাটজাত পণ্যের জন্য মালয়েশিয়ার বাজারে আরও প্রবেশাধিকার চেয়েছে।
বাংলাদেশ নীল অর্থনীতি ও হালাল শিল্প উন্নয়নে মালয়েশিয়ার সহায়তা কামনা করে, যার মধ্যে ঢাকার বাইরে একটি হালাল অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন অন্তর্ভুক্ত। এছাড়া আঞ্চলিক বিস্তৃত অর্থনৈতিক অংশীদারিত্বে (আরসিইপি) যোগদানের আগ্রহ প্রকাশ করে।
দুই দেশই তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) সরবরাহ ও জ্বালানি সহযোগিতার নতুন সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরকে স্বাগত জানায় এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানি অংশীদারিত্ব অন্বেষণে সম্মত হয়। তারা প্রতিরক্ষা, সংস্কৃতি ও পর্যটন ক্ষেত্রেও সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা করেন।
প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখার প্রশংসা করেন এবং প্রখ্যাত এশীয় সাহিত্যিক ও চিন্তাবিদদের নিয়ে একটি সাংস্কৃতিক সম্মেলন আয়োজনের প্রস্তাব দেন।
এর আগে অধ্যাপক ইউনূস পুত্রজায়ায় মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পৌঁছালে তাঁকে লাল গালিচা সংবর্ধনা এবং গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়।
উভয় নেতা প্রতিরক্ষা সহযোগিতা, এলএনজি সরবরাহ ও জ্বালানি সহযোগিতা, বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ ও মালয়েশিয়ার ইন্সটিটিউট অব স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ (আইএসআইএস)-এর মধ্যে সহযোগিতা, বাংলাদে-মালয়েশিয়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি ও মালয়েশিয়ান ইন্সটিটিউট অব মাইক্রোইলেকট্রনিক সিস্টেমস (এমআইএমওএস)-এর মধ্যে সহযোগিতা এবং এফবিসিসিআই (এফবিসিসিআই) ও এনসিসিআইএম (এনসিসিআইএম)-এর মধ্যে সহযোগিতা সম্পর্কিত একাধিক সমঝোতা স্মারক বিনিময় প্রত্যক্ষ করেন।
তারা কূটনৈতিক প্রশিক্ষণ, হালাল শিল্পখাত এবং উচ্চশিক্ষা সহযোগিতা সম্পর্কিত নোটও বিনিময় করেন।
বৈঠকের পর প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম প্রধান উপদেষ্টার সম্মানে মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন করেন।